কুমিল্লা নগরীর যানজট: বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
সারা পৃথিবীর অনেক বড় বড় নগরীর একটি বড় সমস্যা যানজট। কুমিল্লা প্রাচীন শহর হলেও নতুন নগরী হিসেবে ব্যবসাকেন্দ্র-শিক্ষাকেন্দ্র-চিকিৎসাকেন্দ্র থাকায় যানজট সমস্যা এখানে প্রকট। নগরীর মানুষ দিনে বা সন্ধ্যায় কোথাও যেতে হলে কষ্ট করে। নগরী ক্রস করতে হলে বা একপাশ থেকে অন্যপাশে যেতে হলে অসহ্যরকম ভোগান্তিতে ভোগে। সময়, কর্মঘন্টার এমন অপচয় চিন্তা করা যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির খাঁচায় আটকে থেকে অসহায় পাখির মতো ছটফট করা কুমিল্লার নাগরিকদের নিত্যদিনের বাস্তবতা।
শাসনগাছা থেকে কান্দিরপাড় হয়ে রাজগঞ্জ-চকবাজার রোড, কান্দিরপাড় থেকে টমসন ব্রিজ হয়ে পদুয়ার বাজার, টমসন ব্রিজ বা সালাউদ্দীন হোটেল হতে মেডিক্যাল কলেজ তথা যেদিকেই কেউ যাক, ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকে থাকে। কান্দিরপাড় কেন্দ্র করে ২ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে যতরকম অলিগলি আছে প্রায় সবকটিতে জ্যামের জ্বালা পোহাতে হয়।
এর কারণ কি? দোষারোপের রাজনীতিতে একপক্ষ আরেকপক্ষকে দোষারোপ করবে। সিটি কর্পোরশনকে দোষবে একপক্ষ, আরেকপক্ষ দায়ী করবে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ বিভাগকে। অন্য পক্ষ দোষারোপ করবে ব্যবসায়ী কমিউনিটিকে, আরেকপক্ষ দায়ী করবে রিকশা বা গাড়ি বা অটো সংখ্যা বা অবৈধ পার্কিংকে, কেউ দোষারোপ করবে পার্কিংবিহীন বড় বড় মার্কেটকে। বুদ্ধিজীবীরা হয়তো সমাজব্যাবস্থা ও নাগরিক অসচেতনতার অভাবকে দোষ দিবে। কিন্তু দোষারোপ যতই করি সমাধান হবে না। দোষারোপ বাদ দিয়ে রিয়েলিস্টিক সমাধান ভাবতে হবে। তাহলে সমাধান কি? কান্দিরপাড় কেন্দ্র করে দুই কিলোমিটারের মধ্যে শত শত সরকারি অফিস, অনেক অনেক স্কুল-কলেজ, শতাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক-চেম্বার-ডায়াগনস্টিক, শতাধিক মার্কেট বা শপিংমল। সুতরাং সহজে এর সমাধান নেই। মানুষ আসবে, যানবাহনে চড়বে। যানজট হবে। তাহলে উপায়?
একাডেমিক্যালি ভাবলে শহরের মোট জনসংখ্যা ও আগত জনতার হিসেব করে, রাস্তার ক্যাপাসিটির সাথে প্রয়োজনীয় যানবাহনের মেলবন্ধন করে একটি কাম্য মডেল উপহার দিতে হবে যাতে করে নাগরিকদেরও সমস্যা না হয়, আবার জ্যামও না লাগে। আরেকটু জটিল করে ভাবলে বলা যায়, রিমোট সেনসিং ডাটা সংগ্রহ করে, আরবান এরিয়া ম্যাপিং করে স্ট্রাটেজিক মডেল ও পদ্ধতি ব্যবহার করে রাস্তা ও যানের নানান বিকল্পের মাধ্যমে কাঙ্খিত সেবা প্রদানের উপায় বের করতে হবে।
এসব জটিলতার বাইরে গিয়ে আমার কাছে একটি সহজ ও গ্রীন সমাধান আছে। নেদারল্যান্ডের হেগে নগরী বা সুইজারল্যান্ডের বার্ন নগরীতে একটি বিষয় খেয়াল করেছিলাম। শহরের মাঝখানে প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে কেউ গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে না। সবাই হাঁটে। মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী, ভিআইপি, সিআইপি, সাধারণ, অসাধারণ সবাই হাঁটে। বা বড়জোর সাইকেল ব্যবহার করে। কিংবা এ মাথা থেকে ওমাথা এক-দুইটা ট্রাম ঘুরে আর ঘুরে। যারা হাঁটতে পারে না বয়স্ক, প্র্যাগনেন্ট বা বাচ্চা তাদের সুবিধার জন্য এগুলো কাজে লাগে। মূলত এসব নগরীতে মানুষ হাঁটে। নগরীর প্রাচীন স্থাপনা বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা ঘিন্জি পুরাতন শহরে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে না।
যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, কান্দিরপাড় কেন্দ্র করে দুই/তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গাড়ি ঢুকবে না। সবাই হাঁটবে। ভিআইপি সিআইপি সবাই। শহর থেকে বের হতে হলে বাইপাস রোডে যেতে হবে বা হেঁটে বা সাইকেলে শাসনগাছা, বা পদুয়ার বাজার রোড বা চকবাজার রোড ধরতে হবে। নগরীর কেন্দ্রে কোনো গাড়ি বা রিকশা বা টমটম কিছু চলবে না। এমনকি ভিআইপি সিআইপিও গাড়ি নিয়ে আসবে না। ব্যবসায়ীক মালামাল ঢুকবে কেবল গভীর রাতে। তাহলে আর কুমিল্লা নগরীতে জ্যাম থাকবে না। মূল নগরীর রাস্তা চিকন, চাইলেও এ রাস্তাগুলো এখন আর বড় করা যাবে না। যেহেতু নগরী ধীরে ধীরে শত বছর ধরে বেড়েছে, তা একদিনে সব ভেংগে করা যাবে না। তবে মাস্টার প্ল্যান মোতাবেক নতুন এলাকাগুলো পরিকল্পনা মাফিক করা যেতে পারে। সুতরাং বার্ন বা হেগের মতো একটি নির্দিষ্ট র্যাডিয়াসের নগরীতে গাড়ি বা রিকশা ঢুকতে না দেওয়াই স্থায়ী সমাধান।
এছাড়াও কুসিক এর সকল ওয়ার্ড পরিদর্শন করে, নাগরিকদের কমেন্ট ও নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে ছেঁকে গ্রুপিং ও রিগ্রুপিং করে কতিপয় সমাধান নিচে তুলে ধরা হলো। প্রথমত, প্রভাবশালী স্টেকহোল্ডাররা কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে। যেমন কান্দিরপাড় কেন্দ্র করে দুকিলোমিটারের মধ্যে সকল যানবাহন বন্ধ করা; বিকল্প হিসেবে চক্রাকারে কেবল ট্রামলাইনের চালু করা। কিংবা অটো একেবারে বন্ধ করে দেওয়া বা ব্যস্ত কয়েকটি রুটে অটো বন্ধ করে দেওয়া যেমন কান্দিরপাড় থেকে রাজগঞ্জ, রাজগঞ্জ থেকে টমসন ব্রিজ। প্রসংগত টাইম বিভাজন ও জোন বিভাজন করা যেতে পারে। যেমন স্কুল ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে চলবে, মালামালের ট্রাক কেবল গভীর রাতে ঢুকবে। পাশাপাশি, কিছু রাস্তা ওয়ান ওয়ে করা বা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদনসহ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক অটো, সিএনজি রিক্সা চলার ব্যবস্থা করা। এর বাইরে কেউ চলতে পারবে না। সিএনজি, অটো, রিকশার রঙ ভিন্ন ভিন্ন করে এলাকা ও রোড ভাগ করে দেওয়া। দক্ষ ও সৎ ট্রাফিক পুলিশিং, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেম, এবং সিটি করপোরেশনের সৎ ট্রাফিক স্টাফ নিয়োগ করাও জরুরি।
দ্বিতীয়ত, আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা তথা সকল প্রকার অবৈধ অর্থের সংগ্রহ ও সরবরাহ বন্ধ করা। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের মানুষের স্বভাবে আছে চর দখলের অদম্য আকাঙ্খা। দোকানদার-হকার ফুটপাত দখল করে নিয়েছে বলে পথচারী নেমে আসে রাস্তায়। রাস্তার দুই পাশ পার্ক করা গাড়ির দখলে থাকে বলে পথচারীরা রাস্তার মাঝখানে হাঁটতে বাধ্য হয়, যার ফলে বটলন্যাক হয়ে সৃষ্টি হয় যানজট। বাসস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড ও সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে এসব যানবাহন ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো যান স্ট্যান্ড-পার্শ্বস্থ রাস্তায় দাঁড়াবে না। ফুটপাথ দখল করে দোকান বা রাস্তায় নির্মান সামগ্রী রাখা বা অটো/সিএনজি স্ট্যান্ড করা যাবে না। হকারদের উচ্ছেদ ও অবৈধ পার্কিং করে এমন গাড়ি সব উচ্ছেদ করতে হবে। সরকারি বেসরকারি লোকদের কারো ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে যেন এসব বিশৃংখলা না চলে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন গ্রুপ/সমিতি/অফিসের মাসিক বা দৈনিক চাঁদা বন্ধ না করলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।
তৃতীয়ত, জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার মিলে মিনি বা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন আন্ডারপাস বা ফ্লাইওভার করা, ফুটওভার ব্রিজ করা, সকল বাস ও ট্রাকস্ট্যান্ড শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া, মূল রোড ছাড়াও আরও বাইপাস ও বিকল্প রাস্তা বের করা, বিদ্যুৎ বিভাগের খুঁটি স্থানান্তর বা মাটির নিচে দিয়ে করা, সিসিটিভির মাধ্যমে মনিটরিং ও জরিমানার সঠিক ব্যবহার করা। পাশাপাশি সকল সরকারি জায়গা, রাস্তা ও পুকুর থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে উদ্ধার করা। সরকারি অফিস সবগুলো শহর থেকে সরিয়ে নিয়ে চট্রগ্রামের মতো সকল সরকারি অফিসের জন্য একটি জোন তৈরি করা। হাসপাতাল ও স্কুলগুলোকেও শহরের বাইরের ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা।
চতুর্থত, ব্যবসায়ী কমিউনিটিকে দায়িত্বশীল হতে হবে। তথা করপোরেট রেসপনসিবিলিটি পালন করতে হবে এবং নাগরিকদের ভোগান্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল করতে হবে। টমসনব্রিজ এলাকা, কান্দিরপাড় মোড় ও অন্য যেকোনো ব্যস্ত এলাকাতে সকল প্রকার দোকান বসানো বন্ধ করতে হবে। কিন্টারগার্টেন স্কুল, বড় শপিং কমপ্লেক্স ও হাসপাতালগুলোকে আবশ্যিকভাবে পার্কিংসুবিধাসহ তৈরি হতে হবে। সকল বড় বাস ও ট্রাক শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
পঞ্চমত, নাগরিকদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন, নিয়ম মানার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। গণউপদ্রব তৈরি না করা, অন্যের ক্ষতি বা বিরক্তি বা বিরম্বনার কারণ না হওয়ার চেষ্টা থাকা দরকার। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কবি নির্মলেন্দু গুণের মতে, প্রাইভেটকারের জন্যই যানজট এমন ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বললেন, ‘আমি কবি। আমার সময়ের দাম না হয় খুব বেশি নেই। কিন্তু যারা সময়কে টাকার অঙ্কে গোনেন, তাদের গাড়ি-ঘোড়াই তো যানজট তৈরি করেছে।’ সুতরাং সময়ের দাম যাদের বেশি যারা নানানভাবে ট্রাফিক জ্যামের জন্য দায়ী তারাই আবার ট্রাফিক জ্যামের কারণে সময় নষ্ট হয় ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।প্রসঙ্গত বলা যায়, ধর্ম ও নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। ধর্মেও যানজট সৃষ্টি করে মানুষকে কষ্ট না দিতে উতসাহিত করা হয়েছে। যেমন ‘রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে (মুসলিম, হাদিস : ১৬২)। অযথা অপচয় না করতে বলা হয়েছে, কারণ স্রষ্টা অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)
এরকম সুপারিশ ও বিকল্প ধারণা নিয়ে আমরা অনেকেই হাজির। কাজ করতে চায় খুব কমজনই। সকল অংশীজনকে কাজ করতে হবে। শুরু করবে কে? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ঘন্টা বাঁধার পরে বাকি সকল অংশীজনের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণও জরুরি।
