Detail

Home - গল্প - গল্প: ‘মজলুমের পথ পরিক্রমা’ – সফিকুল ইসলাম

গল্প: ‘মজলুমের পথ পরিক্রমা’ – সফিকুল ইসলাম

রহমতুল্লাহ আজ ভোরেই রওনা দিয়েছে। আগের মতো আর ভুল করে নি। গ্রাম থেকে ভোরে রওনা দিয়ে জেলার অফিসটিতে এসে হাজির হয়েছে। সকাল নয়টার আগেই পৌঁছতে পেরে কিছুটা আনন্দ ও নির্বার লাগছে। কারণ আগে একদিন আসতে আসতে বেলা ১২টা বেজে গিয়েছিল। তারপর অফিসে প্রবেশ করতে করতে মূল অফিস চিনতে চিনতেই বেলা ৪টা বেজে গিয়েছিল। তাই কাজটার কোনো অগ্রগতি করে যেতে পারেনি। আজ তাই সকালে উঠে পানতা ভাত খেয়েই রওনা দিয়েছে। অনেক পথ হেঁটে, কিছুপথ অটো দিয়ে, কিছু পথ বাসে করে এসে জেলা সদরে পৌঁছেছে। গেটে ঢোকতে যাবে, তখনই ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে একজন থামায়।

দাঁড়ান। কই যাবেন?

বড় স্যারের কাছে।

কোন বড় স্যার?

নাম জানি না। ওই যে তিনতলার ঐ পাশে বড় রুমটাতে বসেন, সেই স্যার।

ফ্রন্ট ডেস্কে বসা দুজন স্টাফ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। পরে প্রশ্ন করে কী কাজে এসেছেন?

রহমতুল্লাহ বলার চেষ্টা করে। ফ্রন্ট ডেস্কের তারা কিছুই বুঝতে পারে না। বলে আপনার কাছে কোনো কাগজ আছে?

লোকটি কাগজ দেখায়। ফ্রন্ট ডেস্কের লোকটি বলে, এটাতো ছোট কাজ। এর জন্য বড় স্যারের কাছে যাওয়া লাগে? আমাদের কাছে দিয়ে দেন।

রহমতুল্লাহ মনে মনে ভাবে, এর আগে দুদিন ফিরে গেছে। কাজ হয় নি এখনও। আর এরা এখানে বসেই করে দিবে। পারবে তো। রহমতুল্লাহর মনে একটু পানি পায়। মনে হয় তেমন বড় কোনো কাজ না। তবে যে বড় স্যারই করতে পারলো না!

ফ্রন্ট ডেস্কের লোকটি আবার বলে, এত ভাবতেছেন কি চাচা? আপনার কাজ হলেইতো হয়।

হয়, হয়- বলে মাথা নেড়ে সাঁয় দেয় রহমতুল্লাহ।

ফ্রন্ট ডেস্কের লোকটি রহমতুল্লার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, তয় কিছু খরচপাতি লাগবে।

রহমতুল্লাহর মুখটি কালো হয়ে যায়। সে রেগে গিয়ে তার কাগজটি ফেরত চায়।

এরই মাঝে আরও কয়েকজন লোক এসেছে। কেউ চিঠিপত্র জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ এসে তথ্য চেয়ে জিজ্ঞেস করে হন হন করে ভেতরে ঢোকে যাচ্ছে। কারও কারও সাথে ফ্রন্ট ডেস্কের লোকের কথা বার্তা চলছে। এসব ব্যস্ততার মধ্যেও রহমতুল্লাহর কাগজটা ফেরত দিচ্ছে না।

রহমতুল্লাহ একটু পর পর নরম গলায় কাগজটা ফেরত চাচ্ছে। রাগ করছে না। কারণ সে শুনেছে বড় অফিসের পিয়নেরও অনেক ক্ষমতা। যদি তারা গিয়ে কোনো প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়। যদি কাজটা পরে না হয়!

ফ্রন্ট ডেস্কের লোকেরা অন্যদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, রহমতুল্লার কথা ভুলে যায়। কিংবা রহমতুল্লার নরম মিহি গলার অনুরোধ তাদের কানে বাজে না। বাজলেও তেমন গুরুত্ব দেওয়ার মতো না। অথবা যতক্ষণ আটকে রাখবে, ততই মক্কেল নরম হয়ে তাদের হাতে কাজটা বুঝিয়ে দিবে, খরচাপাতিসহ।

কিন্তু রহমতুল্লাহ নাসুরবান্দা। ঘন্টাখানিক অপেক্ষা ও কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তার কাগজ ফেরত দিলো। সেটা নিয়ে রহমতুল্লাহ তিনতলায় বড় স্যারের রুমের সামনে হাজির। দেখে বড় বড় মানুষ প্রবেশ করছে ও বের হচ্ছে। বুঝতে পেরেছে, এখান দিয়েই বড় স্যারের কাছে যেতে পারবে।

দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে, তখনই পিয়ন বাধা দেয়।

কী চাই।

বড় স্যারের সাথে দেখা করবো।

এদিক দিয়ে ঢোকা যাবে না। আপনি ওপাশ দিয়ে পিএর রুমে যান। ওখানে গিয়ে নাম লেখান।

আমিতো দেখলাম, এখান দিয়েই লোকজন ঢোকছে ও বের হচ্ছে, রহমতুল্লাহ প্রশ্ন করে।

পিয়ন হেসে ধমক দিয়ে ওঠে। আরেহ! আপনি আর তারা কি এক হলো?

কেন? আমাকে কি মানুষ মনে হয় না? রহমতুল্লাহ চিৎকার দিয়ে ওঠে।

পিয়ন আরও কড়া ধমক দিয়ে  তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। পিয়ন নিজেও নিচুতলার বাসিন্দা। হলেও সে নিজের কথা ভুলে গিয়েছে। ভুলে গিয়েছে যে সে নিজেও অন্য অফিসে গেলে তাকে কেউ ঢোকতে দিবে না।  আর সামাজিক বিভাজনে বাস করতে করতে তার মনন ও মগজও বিভাজন ও বৈষম্যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। সুতরাং উঁচুতলার লোকজন প্রবেশ করবে, অন্যরা করবে না।

পিয়নের সাথে না পেরে পরে পিএর রুমে গেলো রহমতুল্লাহ। পিএ টেলিফোনে ব্যস্ত। রহমতুল্লাহ দাঁড়িয়ে আছে। পিএ এক ফোন রাখতে রাখতেই আরেক ফোন আসে, সেই ফোন রিসিভ করে। এরই ফাঁকে রহমতুল্লাহ বলার চেষ্টা করে। পিএ হাত ঈশারায় থামিয়ে দেয়। রহমতুল্লাহ দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়ে থেকেই দেখে যে এর মধ্যে দুতিনজন লোক ভিতরে ঢোকেছে। পিএ ফোনে থেকেই তাদেরকে ইশারা দিয়েছে ভিতরে ঢোকার জন্য । রহমতুল্লাহও ভিতরে যেতে চায়। কিন্তু তাকে এখানে আরেক পিয়ন থামিয়ে দেয়। ধরে পিএর সামনে নিয়ে যায়। পিএ তাকে দাঁড়াতে বলে। একটি রেজিস্টার এগিয়ে দেয় নাম লেখার জন্য। রহমতুল্লাহ তাকিয়ে থাকে। পিয়নই তার নাম ও ঠিকানা ও কাজ কী জেনে রেজিস্টারে লেখে। রহমতুল্লাহ তার জরুরি দেখা করা দরকার, সেটা সবাইকে জানাতে চায়, কিন্তু এখানে সবাই ব্যস্ত। তার কথা কেউ শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখা যাচ্ছে।

এক কোণে দাঁড়িয়ে রহমতুল্লাহ ভাবতে থাকে। এর আগেও একবার এসেছিল। এ পর্যন্ত পৌঁছাতেই তার বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সেবার দেখা করতে পারে নি। পরে দ্বিতীয়বার এসে বড় স্যারের রুম পর্যন্ত  ঢোকতে পেরেছিল, রুমে ঢোকামাত্র তিনি জরুরি মিটিংয়ে যেতে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, বললেন পরে একদিন আসতে।

তৃতীয় দিন  আসার পরে দেখা হয়েছিল। সেদিন আবার সকল আবেদন নেওয়ার দিন ছিল। গণশুনানি নাকি কি যেন বলে। একে একে সবাইকে ডাকছিল, সেও ডাক পেয়েছিল।  আবেদনটা বড় স্যার নিয়ে টেবিলে রেখেছিলেন, বলেছিলেন যে তিনি ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু অদ্যাবধি ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। তাই আজকে আসা। সকাল সকাল এসেও দেখা যাচ্ছে, ওখান পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হবে। চোখেমুখে হতাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। লোকজনের আসা যাওয়া দেখছে। নথিপত্র নিয়ে ঢোকছে বের হচ্ছে। অফিসের লোকজন আসছে, ঢোকছে, বের হচ্ছে।

এর মধ্যে কয়েকজন এসে রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিলো। অমুক দলের অমুক পদে আছে, তাদেরকেও ঢুকতে দিলো। এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এসেও প্রবেশ করলো, কাজ সেরে চলে গেলো। কয়েকজন মহিলাও আসলো, কি যেন সংস্কৃতি না ক্লাবের নাম বললো। তারাও ঢুকলো। আবার কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু রহমতুল্লাহকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

রহমতুল্লাহ পিএর কাছে গিয়ে জানতে চায়

কখন ভিতরে যেতে পারবো?

পিএ বলে, আজতো পাবলিককে ঢুকতে দেবে না।

যারা ঢুকছে আর বের হচেছ দেখলাম, তারা পাবলিক না? তারা দেশের পাবলিক হলে, আমিওতো  এ দেশেরই পাবলিক।

পিএ বুঝতে পারে যে মুরব্বী রেগে যাচ্ছে। তাই কথা না বাড়িয়ে বললো যে, ‘‘আপনার নাম লিখেছি। স্যার ফ্রি হলে জানতে চাইবো, যদি স্যার সময় দেয় যে আপনার সাথে কথা বলবেন। আপনি ভেতরে গিয়ে কথা বলবেন।

সেটা কখন দিবেন?

স্যার যখন ফ্রি হবে।

স্যার কখন ফ্রি হবে?

সেটাতো আমি জানি না।

এখন যে এত লোক ঢুকছে বের হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে স্যারের ফ্রি হওয়া লাগবে না?

না, ভাই আপনার এত কথার উত্তর দেওয়ার সময় নেই।  বলে পিয়নকে বললো, এই লোককে পিএস স্যারের রুমে পাঠিয়ে দেন। পিএস স্যার পারলে দেখা করিয়ে দেবে। এবার পাশেই একটা এসি রুমে ঢুকলো। পিএস এর হাতে কাগজটা দিলো, পিএস কাগজটা দেখে ওনাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো যে আপনি সোফায় বসেন।

রহমতুল্লাহ বসতে পেরেই যেন একটু খুশি হলো। এসি রুম। ঠান্ডা। তাই মনে মনে একটু প্রশান্তি অনুভব করলো।

আজকে নিয়ে তিনদিন এলো। গ্রাম থেকে উপজেলা পেরিয়ে জেলা শহরে আসা তার জন্য কঠিন। তবু আসতে বাধ্য হলো। গ্রামের সবাই মিলে তার উপর জুলুম করছে। তাকে বাদ দিয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান উত্তরাধিকার সনদ দিয়েছে। সেটা দিয়ে তার ভাইয়েরা বাবার সকল জমিজমা তাদের নামে খারিজ করে নিয়ে নিয়েছে। রহমতুল্লাহ  পড়াশোনা জানে না, তাকে কেউ কিছু বলে নি। চেয়ারম্যান অফিসে বহুদিন ঘুরাঘুরি করেছে। চেয়ারম্যান ও তার পাড়ার দল সবাই তার ভাইদের সাথে হাত মিলিয়েছে। পরে কোনো উপায়ান্তর না দেখে মামলা করার কথা ভাবে। কিন্তু তারতো পথ ঘাট চেনা নেই।

সেটার জন্য গ্রামের এক উকিল ধরে জজ কোর্টে মামলা করে। বন্টননামা মামলা। সে মামলাতেও উত্তরাধিকার সনদ চেয়েছে। কিন্তু ইউনিয়ন চেয়ারম্যান উত্তরাধিকার সনদে তার নাম দেয় না। চেয়ারম্যান রহমতুল্লার ভাইদের সাথে যোগসাজশ করেই এমনটা করছে।

সেই জজ কোর্টের সিভিল মামলাও রায় হয়ে গিয়েছে এক তরফা। কারণ সে কোনো নোটিশ পায় নি। গ্রামের উকিলটিও তার ভাইদের সাথে গিয়ে যোগ দিয়েছে। সকল নোটিশ জারি দেখানো হয়েছে, কিন্তু রহমতুল্লাহ বাস্তবে কোনো নোটিশ পায় নি। গ্রামের উকিলটি জিজ্ঞেস করলে বলতো তারিখ পড়েছে, পরে জানতে পারবা। এমন করে কয়েক মাস চলে গেলো। বন্টননামা মামলার এক তরফা রায় করিয়ে উচ্ছেদ করার সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। কোনো দিন কোনো নোটিশ বাড়িতে আসে নি।

একদিন সকালবেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিনিধি, লাল কাপড়, পেশকার, নাজির, পুলিশ  এসে হাজির। তিনটি ঘরই ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। কারও কোনো কথা শুনে নি। গ্রামের কেউ এগিয়ে আসে নি। আদালতের রায় নাকি চূড়ান্ত । এর বাইরে কারও কিছু করার নেই।

ঘরহারা হয়ে বাইরে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে গত এক মাস ধরে। গ্রামের কারও মন গলে নি। যারা বা  একটু নরম হয়েছে, তারা প্রভাবশালীদের ভয়ে কারও পক্ষ নিতে আসে নি।

 

পরে রহমতুল্লাহ আদালতে ঘুরাঘুরি করে উকিল ধরে বন্টননামা মামলার রায়টির বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করে।

এদিকে তার ভাইয়েরা পুরো বাড়ি দখল নেওয়ার জন্য বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়ার পাঁয়তারা করে। বাধা দিয়ে সে পারছে না। তার ভাইয়েরা শত শত লোক নিয়ে মারধর করতে আসে।  তখন সে আরেক উকিল ধরে এডিম কোর্টে মামলা করে। ১৪৫ ধারার মামলায় তার আর্জি  সে তার পৈত্রিক ভিটায় ৩০ বছর যাবৎ বাস করছে। এখন জোরপূর্বক বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়ার চেষ্টা করছে। আদালত সরেজমিন তদন্ত করিয়ে দখলে থাকার বিষয়টি অবগত হয়ে তিনদিনেই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিবাদীদের উপর। যেন কোনো বাউন্ডারি ওয়াল না করতে পারে।

রহমতুল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞার আদেশ থানার মাধ্যমে গ্রামে জারি করায়। কিন্তু পরের দিন থেকেই আবার ওয়াল নির্মান শুরু করে। রহমতুল্লাহ থানায় গেলে সাথে সাথে পুলিশ আসে না। পরে আসবে বলে জানায়। সে বুঝে গেছে যে তার ভাইয়েরা এ নিষেধাজ্ঞা না মেনে পুলিশকে ম্যানেজ করে বাউন্ডারি ওয়াল করার কাজ চলমান রাখে। এ নিয়ে মারামারি ধরাধরি চলমান।

যেহেতু রহমতুল্লাহর  টাকা পয়সা নেই, যেহেতু গ্রামে লোকবল নেই, যেহেতু পড়াশোনা বা কূটবুদ্ধি নেই, সেহেতু রহমতুল্লাহ কোনোকিছুতেই পেরে উঠছে না। যেখানেই যাচ্ছে, হেরে যাচ্ছে। সে বুঝে গেছে মামলা করে, থানায় গিয়ে, লোকবল দিয়ে  এ সমস্যার সমাধান হবে না।

তাই সে বড় স্যারের কাছে এসেছে। সে শুনেছে যে বড় স্যারের অনেক ক্ষমতা। স্যারের কাছে আসলে সব সমস্যার সমাধান হয়। তাই সে এসেছে। কিন্তু তিনবার করে এসেও কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না।

আজকে স্যারকে সব বলে, একটা বিহিত করেই যাবে- এই তার পণ।

পিএস সাবের টেবিলের সামনে গিয়ে আবার দাঁড়ায় রহমতুল্লাহ। পিএস বলে, ‘‘চাচা আরেকটু বসেন, স্যার একটু ফ্রি হলেই আপনাকে পাঠাবো।‘‘

রহমতুল্লাহ আবার বসে। কত মানুষ ঢোকছে আর বের হচ্ছে। বড় বড় পাঞ্জাবি পরা, স্যুট কোট পরা নানান লোকজন ঢোকছে আর বের হচ্ছে। আর রহমতুল্লাহ চার ঘন্টা ধরে বসে আছে, তার সাথে দেখা করানোর কেউ নেই।

রহমতুল্লাহ কাপড়চোপড় পাল্টে আরও সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে আসা উচিত ছিল। মনে মনে ভেবে দেখে কী কী কাপড় সে পরে আসতে পারতো। পরে দেখে তার পরনের ছেড়া জীর্ণ জামাটি ছাড়া তার কোনো কাপড় নেই, বাইরে যাওয়ার মতো। পুরাতন কয়েকটি লুঙ্গী ও সেন্ডু গেঞ্জি আছে যা দিয়ে সে মাঠে কাজ করে।

সে বুঝে গেছে বয়স নয়, প্রয়োজন নয়। জামা কাপড় সুন্দর হলেই যে কোনো জায়গায় হুট করে ঢোকে যাওয়া যায়। কেউ আটকায় না।

ঘণ্টাখানিক পরে রহমতুল্লার ডাক পড়েছে। বড় স্যারের সাথে দেখা হতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন, কী সমস্যা? রহমতুল্লাহ ঘটনাটি খুলে বলে ও আগের সপ্তাহে দরখাস্তটি স্যারকে নিজে দিয়েছিলেন বলে জানায়। স্যার দরখাস্তটি রেখে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছিলেন।

বড় স্যার গত সপ্তাহের গণশুনানির সকল দরখাস্ত খুঁজে নিয়ে আসার জন্য হুঙ্কার দেন। এবার পিএস পিএ পিয়ন সব দৌড় লাগায়। শাখাতে খুঁজে কয়েক জনের কাছে ঘুরে, সংশ্লিষ্ট সকল রেজিস্টার চেক করে দেখা গেলো দরখাস্তের এন্ট্রি আছে রেজিস্টারে, তবে দরখাস্তের কপি নেই কোথাও।

বড় স্যার সবাইকে ধমকাতে থাকে। রহমতুল্লাহ বড় স্যারকে জানায়, ‘‘ স্যার আপনি লিখে দিয়েছিলেন, ব্যবস্থা নিতে, এ কারণে অফিসের কেউ হয়তো বিবাদীদেরকে ফোন করে জানিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। তাদের যোগসাজশে অফিস থেকে এ আবেদন গায়েব করা হয়েছে বলে আমার ধারণা। স্যার আজ আমি  আরেক কপি নিয়ে এসেছি। আপনি যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন…‘‘

বড় স্যার দরখাস্তটি মন দিয়ে পড়ে। পরে মুখ তুলে তাকায় রহমতুল্লাহর দিকে। বলে,

‘‘আপনার বিষয়টাতো বড় ঝামেলার। মামলা মোকাদ্দমা, জমি জমা, গ্রামের সালিশ কিছু বাদ রাখেন নি। এটার সুরাহাতো সহজে হওয়ার নয়, মনে হচ্ছে‘‘

স্যার ক্রিমিনাল কোর্ট থেকে ১৪৫ ধারার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে, এটা বাস্তবায়ন করলেই, আমার সমস্যাটা আপাতত সমাধান হয়। বাউন্ডারি ওয়াল ওরা তুলতে পারবে না। আর আমার ওয়ারিশ সনদটা যেন দেন, তা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে বলে দেন।

বড় স্যার প্রশ্ন করে, আপনি নিষেধাজ্ঞার আদেশ নিয়ে থানায় যান নি?

স্যার, গিয়েছি। থানা থেকে প্রথম দিন গিয়ে বলেও এসেছে। এরপর থেকে আর যাচ্ছে না, ওরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

আর ওয়ারিশ সনদ দিচ্ছে না কেন? বড় স্যার প্রশ্ন করে।

চেয়ারম্যান ওদের সাথে মিলেই আমার সাথে জুলুম করছে। আমার নাম বাদ দিয়েই বারবার ওয়ারিশ সনদ দিচ্ছে।

বড় স্যার বিষয়টার আইনি সমাধান সহজ পেলেও, বাস্তবায়ন কাজটি কঠিন সেটা বুঝতে পারে। পিএকে আদেশ দেয়, উপজেলার অফিসারকে ফোন দিতে।

উপজেলা অফিসারকে ফোনে বড় স্যার আদেশ দিয়ে দেয়। একটি লোকের আবেদন নিয়ে এসছে। তোমাকে পাঠাচ্ছি, তুমি সরেজমিন দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিবা। বলে ফোন রাখে।

আবেদনের কপিতে নিষেধাজ্ঞা বহালের জন্য থানায় পত্র দিতে, আর আর আইনানুনগ নিয়মে পেলে রহমতুল্লাহকে যেন ওয়ারিশ সনদ দেওয়া হয়- সেটা উল্লেখ করে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে পত্র দিতে আদেশ দেয়।  আর উপজেলার অফিসারকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়।

কপিটি নিয়ে বাইরে আসে পিএ। ফটোকপি করে রহমতুল্লাহকে দেয়, আর জানায় মূল কপি উপজেলার অফিসার, থানা ও ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে চলে যাবে।

রহমতুল্লাহ কিছুটা খুশি কিছু উদ্বিগ্নতা নিয়ে চলে আসে। পরের দিন উপজেলার অফিসে যাবে।

সেদিন ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। এসে জানতে পারে যে, বাড়িতে সে না থাকায় অন্যরা বাউন্ডারি ওয়াল করার চেষ্টা করেছে। তার স্ত্রী ও ছোট সন্তান বাধা দেওয়ায়, কয়েকজন মিলে ওদেরকে মেরেছে। যদিও বাউন্ডারি ওয়ালের কাজটা আপাতত আজকে বন্ধ রেখেছে কিন্তু তার স্ত্রী ও সন্তানের মাথায় বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান।

পরের দিনই আবেদনটির ফটোকপি নিয়ে আবার উপজেলায় যায়। উপজেলার অফিসারকে আবেদনের ফাটোকপিটি দেখায়। উপজেলার অফিসার গতকাল ফোন পেয়েছিল বসের কাছ থেকে। সুতরাং মন দিয়ে পড়ে। রহমতুল্লাহকে বসায়, চা খাওয়ায়। আবেদনের কোণায় জেলার অফিসারের আদেশটি দেখতে পায়।  উত্তরাধিকার সনদ না দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে যে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে, তিনি একজন ক্ষমতাধর চেয়ারম্যান। মন্ত্রীর  ও উপজেলার নেতাদের সাথে সরাসরি কানেকশন। সহজে তাকে দমানো কঠিন। উত্তরাধিকার সনদ দেওয়ার ক্ষমতা কেবল চেয়ারম্যান, এটা নিয়ে জোর চলে না। অন্য কেউ হলে চাপ দিলে বা ফোন দিলেই দিয়ে দিতেন, কিন্তু এ চেয়ারম্যানকে কিছু বলা মানে উপজেলার অফিসার নিজেই ঝামেলায় পড়বেন।  আর থানাতে নিষেধাজ্ঞা আদেশ এসছে। পুলিশ কাজ করলে আদালতের আদেশ মোতাবেকই কাজ করার কথা। উপজেলার অফিসারের আদেশ শুনে পুলিশ দৌড়ে যাবে, সেই পুলিশ আর এখন নেই। যেখানে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নই করছে না।

নানা বিষয় চিন্তা করে, উপজেলার অফিসার রহমতুল্লাহকে বলে যে, আপনি এটার কপি রেখে যান। আমার কাছে জেলা অফিস থেকে মূল কপি এলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এখনও আমি মূল কপি পাই নি।

রহমতুল্লাহ বলে আমি তো নিজে দেখা করেছি, জেলায়। এ আবেদন পেয়েইতো কাল আপনাকে কল করেছে বড় স্যার। আপনি আরও অপেক্ষা করতে হবে কেন? স্যার আপনি একটু উদ্যোগ নিলেই আমার বড় উপকার হবে।

কোনো সুরাহা না পেয়ে রহমতুল্লাহ বাড়িতে ফিরে আসে। পরের দিন আবার যায় উপজেলায়। সেখানে দরখাস্ত পৌঁছে নি। সেদিনই আবার জেলার দপ্তরে যায়। গিয়ে সেখানে পিএকে ধরে। পিএ বলে পাঠাতে বলেছি তো। চলে যাবে। ডেসপাচ শাখায় গিয়ে খোঁজ নিতে বলে। সেখানে গিয়ে দেখে চিঠি পড়ে আছে।

রহমতুল্লাহ বলে আমাকে হাত হাতে দেন, আমি পৌঁছে দিব। ডেসপাচ শাখার স্টাফ বলে, এভাবে তো হবে না। সরকারি নিয়মে সরকারি জারিকারক পত্র নিয়ে যেতে হবে। কী আর করা! এ কথা সে কথার পরে ডেসপাচের এক জারিকারককে পাঁচশত টাকা দিলে সে আজই যেতে রাজি হয়। এবং রহমতুল্লাহর সাথে করে নিয়ে যায়। যাওয়ার অটোভাড়া ও বাসভাড়াও রহমতুল্লা দেয়। সেদিনই সন্ধ্যার মধ্যে চিঠি পৌঁছে। চিঠি জমা রেখেছে। তবে সেদিন অফিস শেষ। সন্ধ্যার পরে রহমতুল্লাহ বাড়ি ফিরে, ও পরের দিন আবার যায়।

এবার উপজেলার অফিসার আর কী  করবে! একদিকে লোকাল ঝামেলা ও প্রভাব প্রতিপত্তির চাপ, অন্যদিকে জেলার বড় স্যার বলেছে কাজটা করে দিতে। অথচ  এ কাজ করার ক্ষমতা তার কাছে নেই। এটা যদি নিজের অফিসের কাজ হতো তাহলে তো দ্রুত এক্ষুণি করে দিতো।

যাই হোক, তবু উপজেলার অফিসার ইউপি চেয়ারম্যানকে ফোন করে উত্তরাধিকার সনদ দিয়ে দেওয়ার জন্য। জবাবে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জানায় যে, রহমতুল্লাহ ওয়ারিশ সনদ পাবে না। কারণ সে তার বাবার সন্তান নয়। সে পালকপুত্র। লালন পালন করেছে তাকে, জন্মসূত্রে নয়। পালকপুত্র হিসেবে আদালত বা কোনো দপ্তরের কোনো প্রমানক নেই।

উপজেলার অফিসারের ফোন রাখার পরে রহমতুল্লাহ জানায় স্যার সে মিথ্যা বলতেছে। আমি আমার বাবার সন্তান। আপনি গ্রামে খবর নেন।

উপজেলার অফিসার গ্রামের কয়েকটি ফোন করে বুঝতে পারে যে রহমতুল্লাহর বক্তব্য সঠিক। তবে সেটা মেম্বারগণ ও চেয়ারম্যানের বাইরে গিয়ে প্রমাণ করার জন্য ডিএনএ টেস্টসহ নানান দীর্ঘসূত্রী প্রক্রিয়া লাগবে।

এদিকে উপজেলার অফিসার থানায়ও ফোন দেয়। রহমতুল্লাহ থানায় গেলে উপজেলার অফিসারের ফোনের প্রেক্ষিতে দুঘন্টা বসিয়ে রেখে একজন তদন্তকারী অফিসার আদালতের নিষেধাজ্ঞা আদেশসহ রওয়ানা দেয়। ঘটনাস্থলে  এসে দেখে কিছু অংশ বাউন্ডারি ওয়াল করে ফেলেছে। পুলিশের দল কয়েকটি ঘর হানা দেয়, একটু চোটপাট করে এবং পরে চলে যায়।

 

বিবাদি দলের আপাতত কেউ নেই। কারণ থানা থেকে আগেই খবর দেওয়া হয়েছে কেউ যেন ঘটনাস্থলে না থাকে। থাকলেই গ্রেফতার করতে হবে। আর কেন এত দেরি লাগলো, কেন দ্রুত বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ শেষ করছে না।

রহমতুল্লাহ উপজেলা অফিসার ও পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞ যে তারা কিছুটা কাজ করেছে।  আবার উদ্বিগ্ন যে কখন না তারা আবার কাজ শুরু করে দেয়।

পরের দুদিনের মধ্যেই নানান ঘটনা ঘটে। উপজেলায় জেলায় কেন নালিশ করেছে এ কারণে চেয়ারম্যানের লোকজন বাড়িতে এসে হুমকি ধামকি দিয়ে গিয়েছে। এতদিন চেয়ারম্যানের লোকজন নেপথ্যে ছিল, এখন সরাসরি নেমেছে। আর তার ভাই ও ভাইপোরা পরের দুদিনের মধ্যেই পুরো বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ শেষ করেছে।

রহমতুল্লার পরিবারকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয় নি। কয়েকশো লোক মিলে এ অনাচার  করা হয়েছে। হাউমাউ করে কান্না করা ছাড়া রহমতুল্লা ও তার পরিবারের কিছুই করার ছিলো না।

রহমতুল্রাহ বেদনার্ত চোখে দূরের আকাশে চেয়ে থাকে। বুঝতে পারে যে, গ্রাম, সমাজ, প্রতিবেশী সবাই যদি না চায়, তবে কারও কিছু করার নেই। স্থানীয় সরকার হয়তো সহযোগিতা করতে পারতো, তারাও তো অনাচারের পক্ষে! রাষ্ট্র  ও আদালত দূর থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। নিলেও আজকে কাজ করে দিয়ে যাবে, পরের দিন কে সুরক্ষা দিবে?

সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়েছে ‘ হে আল্লাহ তুমি এ জুলুমের বিচার করো, তুমি জুলুমকারীদের হেদায়েত করো, আমার ন্যায্য হক পাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও‘‘। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় বান্দার আর্জি সব শুনেন। নির্যাতিতের আর্তনাদ আল্লাহপাক কবুল করেন। শুনেন সাথে সাথেই, কবুল করেন সাথে সাথেই, তবে কবে বাস্তবায়ন করবে- কেউ জানে না।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart