কবিতায় সমাজ বাস্তবতা যেভাবে আসে- ড. সফিকুল ইসলাম
কবিতায় সমাজ বাস্তবতা যেভাবে আসে
সমকালীন কবিতা বলতে কোন কালের কবিতাকে বোঝাবে- তা নির্ণয় করা কঠিন। যেমনটা কঠিন আধুনিকতার সময়কালের শুরু ও শেষ ঠাহর করা। সমকালীন কবিতায় কি রবীন্দ্রনাথের কাল আসবে, নাকি জীবনানন্দ, নজরুল, জসিম উদ্দিন থেকে শুরু হবে, নাকি শামসুর রাহমান আলমাহমুদদের সময় থেকে শুরু হবে, নাকি সত্তোর দশকের পরে এখনকার শূন্য দশক কেবল সমকালের হিসেবে আসবে? এ নিয়ে বিতর্ক করা যাবে। কেবল বর্ষ বা যুগ দিয়ে সীমানা ঠিক করা যাবে না, তবে বর্তমানের সাথে সংশ্লেষ আছে বা বর্তমানে প্রভাব ফেলে বা বর্তমানকে রূপায়িত করে –এমন সব কবিতাই সমকালের কবিতা হিসেবে আমলে নেওয়া সমীচীন। সুতরাং বিষয়টা কেবল কালের নয়, বিষয়টা মানুষ, সৃষ্টি, দেশ ও বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতা যেসব কবিতায় আমরা এখন পাই সেসব কবিতাকেই সমকালীন কবিতা হিসেবে মোটা দাগে বিবেচনা করা যায়। কবিরা সবসময়ই সমকালীন হবে। মোদ্দা কথা সমকালীন সাহিত্য বা contemporary Literature মানে বর্তমান সময়ের প্রতিনিধিত্বমূলক রচনা, বর্তমান সময়ের ধ্বনি ও ভাষা, বর্তমানের সুর, তাল, লয় ও অনুভূতি, বর্তমান বাস্তবতায় মানুষের কাজ, চিন্তা, বোধ ও লাইফস্টাইলের প্রতিফলন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে অনেক কবিতা কালকে ছাড়িয়ে যায়। এক কালে লেখা কবিতা পরবর্তীকালেও বাস্তবতার নিরীখে মানুষের কাছে সমান আবেদনময়ী হতে পারে।
কবিদের কবিতায় সমকাল উঠে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইংরেজ হঠাও আন্দোলন, দেশ বিভাজন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর অভ্যুথান, এবং গণতন্ত্রের প্রতিটি লড়াই তথা সব ধরণের ইস্যুই কবিদের লেখায় এসেছে। যখন আসে না তখন বুঝতে হবে সমকালীন কবিরা সমকালকে অনুধাবন করছে না। কিংবা করলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা লিখছে না। লিখলেও তা প্রকাশ করছে না। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সময়ে তখনকার প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা নিয়ে কয়জন কবি কয়টি কবিতা লিখেছিলেন তা যেমন বিবেচ্য, যা যা লেখা হয় নি তখন তাও বিবেচ্য। তেমনি ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সালে সমকালীন নানান ইস্যুতে কোন কোন কবি কী কী কবিতা লিখেছেন তা যেমন বিবেচ্য, যা যা লেখা হয় নি তাও বিবেচ্য। কেন, কখন, কী কী কারণে কারা কারা কী কী লিখতে পারে না – তা বিশ্লেষণ করলেই সমকালের কবিদের সফলতা ও ঘাটতিটুকু অনুধাবন করা যায়।
কবিতা তাই যা কবিতার শরীরে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখে, পাঠককে ভাববার ও কল্পনা করার সুযোগ দেয়, পাঠককে চিত্রকল্প, গল্প, চরিত্র, সময়, জীবনবোধ ও দর্শনে মাতাতে পারে। বর্তমানে সমকালীন কবিতার শরীর দেখলে এটা বোঝা যায় যে, কবিতার অবয়বে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পরিমিত কাব্যলঙ্কার, চিত্রকল্প, রূপক, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা, ও ছন্দ ইত্যাদি স্থান করে নিচ্ছে। একটি প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে কবিতায় কেবল শৈল্পিক দিক থাকলেই হবে নাকি বাস্তবতাও থাকা দরকার। বাস্তবতা বিবর্জিত শব্দভান্ডার ও ভাষার খেলা যতই শৈল্পিক হোক, তা কি গণমানুষের অনুভূতির কথা বলে? যদি না হয় তবে কবিতার কী কাজ? বিপরীত দিক থেকে ভাবলে কবির কাজ রাজনীতি না। কবির কাজ কবিতা লেখা। কবি কখন কেন কবিতা লিখে কবি নিজেও জানে না। কবিতা এসে যায়, কবিতা হয়ে যায়। এসে যাওয়া বা হয়ে যাওয়ার যে কবিতাসুলভ অনুভূতির রসায়ন তা চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাই কবিতা কেবল শৈল্পিক হবে নাকি কেবল বাস্তব হবে নাকি দু‘য়ের মিশেল হবে সেটা বলা মুশকিল। কবির উপর যা ভর করে তা-ই বের হয়। এখন কেউ কেউ বলতে পারেন যে কবিতো আকাশ থেকে আসেন না। কবি এ সমাজেই বাস করেন। কবির সমাজনিরীক্ষা, দেশ নিরীক্ষা, সময় নিরীক্ষা, ঘটনা নিরীক্ষা অন্যদের থেকে আলাদা হবে। কবিতো ‘‘সুম্মুম বুকমুন উময়্যুন ফাহুম লাইয়ারজিউন‘‘ সমস্যায় আক্রান্ত না। কবি সব দেখেন, বুঝেন ও অনুভব করেন এবং সবকিছু তার ভেতরে অনুরণিত হয়। সেসব অনুরণনের ফল যদি কবিতায় প্রকাশ না পায় তবে সমকালে তার প্রভাব কমে যায়। আর এসব অনুরণনের ফল যাদের কবিতায় প্রকাশ পায়, সেসব কবির প্রভাব থাকবে পরবর্তীকালেও। কবি তার নিজের মতোই লিখবেন। যেমনটা বলছেন আল মাহমুদ ‘‘‘আমি কবি/ আমি কথা বলে যাই নিজের ছন্দে/ আমার শব্দ আমারই গন্ধে -/ আনন্দে মাতে – দু’হাত তুলে’। কবি লিখে যাবেন স্বতস্ফুর্তভাবে, সেই স্বতস্ফুর্ততার মধ্যেই সমসাময়িক সমাজ ও মানুষের অনুভূতির নির্যাস উঠে আসবে কবিতায়। কবি বর্তমানকে ধারণ করেন কিনা, বর্তমানের সকল ঘটনা বা অনুষঙ্গগুলো কবিতায় আসে কি না- এসব প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার আগেই কবিতায় বর্তমান বহমান থাকা সমীচীন।
অতি সাম্প্রতিক তরুণদের সাহিত্যকর্মগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কবি সাহিত্যিকরা একটা অস্থির সময় পার করছেন। অনলাইন মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে নাগরিকরা যেমন অস্থিরতায় ভোগে, তরুণ কবি সাহিত্যিকরা এ ট্রেন্ডের বাইরে যেতে পারে না বলে মনে হয়। লেখালেখিতে আরও বেশি গভীরতার ছাপ থাকা দরকার যার জন্য কবিদের ধীর স্থির হওয়া যেমন উচিত, তেমনি, সময় ও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। অবশ্য কবিরা ঔচিত্যবোধের ধার ধারে না। কবিদের ভাবনার জগত ও চলার জগত সবসময়ই বাঁধভাঙ্গা। গভীরতার দৌঁড়ে বাঁধভাঙ্গা হোক। তবে মনে রাখা জরুরি যে, দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার যে নেশা সেই ফাঁদে পা না দেওয়া তরুণ লেখকগুষ্ঠীগুলোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জনস্রোতের বিপরীতে হাঁটতে হবে স্বভাবগতভাবে, সাধারণ বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করে গণমানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো অনুধাবন করে করে লিখতে হবে- এমনটাই সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রত্যাশা।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সম্প্রতি কবিতায় ও গল্পে বিদেশী বা ইংরেজি ভাষার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার দৃষ্টিকটুভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশী ভাষা বা ইংরেজি ভাষার ব্যবহার মন্দ নয়, বরং তা খুবই স্বাভাবিক। কারণ বিদেশী ভাষা যে কোনো ভাষায় প্রবেশ করবে, ইংরেজি ভাষাতেও তা ঘটে। কিন্তু সেটা হওয়া উচিত খুবই স্বতস্ফুর্তভাবে যেন পাঠক পড়ার সময় হোচট না খায়। খটমটে না লাগে। শুনতে আরাম লাগে এমনভাবেই ব্যবহার করা উচিত। যেমন যেসব বিদেশী শব্দ আমাদের বাস্তবজীবনে অহরহ ব্যবহৃত হয়, গণমানুষ সাধারণত ব্যবহার করে, সেসব শব্দ লেখায়ও আসতে পারে। অন্যথায় তা কেবল জোর করে মিশ্রণ হয়, তাতে ভাষা দুষিত হয় বলে মনে হয়, এবং পাঠকের জন্য তা সুখপাঠ্য হয় না।
সমকালীন কবিতায় সমাজনিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করতে গেলে দেখা যায় যে, সমকালীন কবিদের অনেকেই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছেন। ক্ষমতাসীনের পক্ষে যেমন আছে ক্ষমতাহীনদের পক্ষেও আছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষের কবিদের কবিতা পড়লে ক্ষমতাসীনদের কোনো নেতিবাচক দিক পাওয়া যায় না। আবার বিরোধীদলের পক্ষের কবিদের কবিতা পড়লে বিরোধীদলগুলোর কোনো নেতিবাচক দিক পাওয়া যায় না। কবিতায় তাঁদের দেশপ্রেমটাও এমন পুতুপুতু হয় যে তাতে সত্যিকারের দেশপ্রেমটা ঠিক ফুটে উঠে না। রাজনৈতিক মেরুদন্ডহীনতা এখন অনেক কবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। যা অপ্রত্যাশিত। কবি হবে কবির মতো। কবির মনে যা আসবে, অনুভূতিতে যা খেলবে তাই তিনি লিখবেন। স্বাধীনভাবে লিখবেন। কোনো ঘরের খুঁটিতে নিজের চুল বাধা রেখে লিখবেন না। তাতে কবির সত্যিকারের কবিত্ব প্রকাশ পায় না।
সমকালীন কবিতায় বর্তমান সমাজ, সমাজের মানুষ, মানুষের জীবনাচরণ ও তাদের অনুভূতিগুলোর প্রকাশ কতটা হচ্ছে – তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে অবান্তর হবে না। কবিরা এ সমাজে বাস করে। সমাজের নানান শ্রেণি পেশার মানুষের কার্যক্রম ও জীবনধারা দেখছে। যদি দেখে থাকে, যদি এসব নিয়ে ভেবে থাকে, যদি কবির মন এসব দ্বারা দোলায়িত না হয়, যদি কবিতার ঝড় না ওঠে কবিদের মনে তবে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সেসব কবিরা দূরে বাস করে। বাংলা কবিতার ইতিহাস বলে কবিতা সমকালকে ধারণ করেছে। চর্যাপদের দোঁহা বৌদ্ধ ধর্মকে ধারণ করেছে, রামায়ন-মহাভারত হিন্দু ধর্মকে ধারণ করেছে, অনুরূপভাবে ইসলামি জাগরণ বা রেঁনেসা নিয়েও কবি ফররুখ আহমদদের যুগ গেছে। তাছাড়া মানুষের জীবন, সংগ্রাম, পরাধীনতা, নির্যাতিত হওয়া, নগরজীবন, পল্লীজীবন, দুর্ভিক্ষ মানবাধিকার নিয়ে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দিতে কবিদের ভূমিকার প্রমাণ রয়েছে। সে তুলনায় অতি সাম্প্রতিক সমকালীন কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধতা যদি কিছু পালিত হয়ে থাকে, তবে তা খুবেই ম্রীয়মান।
কবিতার আধুনিক যুগের শুরু থেকেই সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর চিত্রায়ণ কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরুপ কয়েকজনের কবিতা উল্লেখ করা যায়।
কবি কামিনী রায়ের ‘‘সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে‘‘,
রবীন্দ্রনাথের ‘‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুড়ি ভুড়ি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি‘‘,
কবি নজরুলের ‘‘গাহি সাম্যের গান‘‘,
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিষ্ণু দে‘র ‘‘অর্থের উৎপাতে ’/ পুরুষার্থ নির্ণিত যে সমাজের উঁচু নিচু স্তরে/যুগে যুগে ইতিহাস বাহ্য ভ্রান্তির নিষ্ঠুর‘‘,
সমর সেনের ‘‘বণিকেরা প্রাকার বানায়/দিনে দিনে চক্রবৃদ্ধি হারে/নিরন্ন বেকারের মজুরের ভিখারির সংখ্যা বাড়ে‘‘
এমনকি নিকট অতীতের সুকান্তের কবিতাতেও শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের অধিকার ও বঞ্চনার কথা ধ্বনিত হয়েছে।
হালের বাংলাদেশের কবিতায় অবহেলিত শ্রেণীর উপস্থিতি সেরকমটা উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায় না। যতটা পাওয়া যায় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিশালীদের স্তুতি ও জয়গানের রেখা। কবিতায় বঞ্চিত শ্রেণীর নিদারুণ বাস্তবতা উঠে আসাটা স্বাভাবিক। প্রেমেন্দ্র মিত্র যেমন লিখছেন ‘‘আমি কবি যতটা কামারির আর কাঁসারির আর ছুতোরের/মুটে মজুরের/ আমি কবি যত ইতরের। অবহেলিতদের কথা যাদের কবিতায় আসে না তাঁদের জন্যও প্রেমেন্দ্র স্মর্তব্য। ‘‘কোমরের জোর কমে গেলো যার ভাই/ঘুণ ধরে গেলো কাঠে……।
বাংলাদেশের কবিতার চেতনাজগত নির্মিত হয়েছে জীবনবৈচিত্র্য, গতি ও সংঘর্ষ, সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা, শ্লাঘা ও বেদনা এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক যুদ্ধ, ঝড়ঝঞ্জার উত্তাল ঢেউ দিয়ে। ভারত পাকিস্তান বিভাজনের পরে বাংলাদেশ অঞ্চলের কবিতার দিকে তাকালে আমরা সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারবো। শামসুর রাহমাণের ‘‘আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো/ মিলি রাতের গভীর যামে/ তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা পড়েছে বোমা ভিয়েতনামে।‘‘
কিংবা আল মাহমুদের ‘‘তাড়িত দু:খের মত চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল/ রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখে উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে/ তীরের ফলার মতো/ নিক্ষিপ্ত ভাষার চিতকার‘‘।
অথবা শহীদ কাদরীর ‘‘শৃঙ্খলিত, বিদেশীর পতাকার নীচে আমরা শীতে জড়সড়/ নি:শব্দে প্রেমিকের দীপ্ত মুখ থেকে জ্যোতি ঝরে গেছে‘‘।
এসব কবিতায় ব্যক্তি বা সমষ্টিগতভাবে সমাজের মুক্তিকামী মানুষের দহণ অগ্নিগোলায় প্রকাশিত হয়েছে। বলার অধিকার, ভাষার অধিকার, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। অনুরূপভাবে স্মরণ করা যায় আহসান হাবীবের ‘‘কোথাও পড়ে না চোখে বধ্যভূমি, অথচ প্রত্যহ/ নিহতে সংখ্যা বাড়ে। কোথাও একটিও/ লাশ কিংবা কবর পড়ে না চোখে, অথচ প্রত্যহ/ শবাধার ব্যসত্ম হয়ে হেঁটে যায় এবাড়ি ও বাড়ি।‘‘
কিংবা আবুল হোসেনের ‘‘ অনেক শেখানো অনেক পড়ানো/ বহু পুরম্নষের মর্চে ধরানো/ ভাগ্যটার/ ঝুঁটি ধরে নাড়া দেবার সময়/ এসেছে এবার..‘‘
আর আজীজুল হকের ‘‘একটি কবিতা একজন কবির হৃৎপি-চিবিয়ে খাচ্ছে রক্ত/ একটি স্বপ্ন একজন প্রেমিকের চোখ উপড়ে নিচ্ছে রক্ত/রক্ত রক্ত রক্ত/ উন্মোচিত জরায়ুতে কি এতো রক্ত থাকে?‘‘
এভাবেই ভাষা আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম দেশ ও বিশ্বের বিস্তৃত হয়, গ্রামে গ্রামে সমাজের স্তরে স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। কবিদের মানসজগত তখন নতুন চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। বিদেশী হটিয়ে দেশীয় হন্তারকদের কবলে পড়ে দেশ, বর্গীদের রক্তচোষণে ক্ষয়ে যায় সমাজের সকল সম্পদ। কবিদের চোখ তা এড়ায় না। এড়াতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের বেঁচে থাকার বেদনা কবিদের জানা। রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসান কবিতায় সমাজ মানসের সেই উজ্জীবন, পরাভবচেতনা ও উজ্জীবনের শক্তি উম্মোচনে বহুলাংশে সমর্থ হয়েছেন। সমাজজিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মপরিচয় উদঘাটনের মধ্য দিয়ে অনেক কবিই জীবনের নতুন সত্য অনুধাবনে সমর্থ হন ও কবিতায় রূপ দেন। সত্তোরের দশকে আবির্ভূত কবিদের কবিতায় যুদ্ধ পরবর্তী সমাজের অনিশ্চায়তার চিত্র পাওয়া যায়। স্বপ্ন ও প্রেমের পাশাপাশি স্বপ্নভঙ্গের গন্ধও রয়েছে নানান কবিতায়। ‘‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ‘‘ কিংবা ‘‘ আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই‘‘ ধরণের পঙ্তিগুলো সমাজ নিরীক্ষার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে কবিতায়। আশির দশকেও সেটা বহাল ছিল। কিন্তু নব্বই বা শূন্য দশকের পরে সমাজের নিপীড়িত ও অবহেলিত শ্রেণির শোষিত হওয়ার কথা কিংবা রক্তচোষাদের হুলি খেলার কথা কতটা কবিতায় পাই – তা নিয়ে প্রশ্ন দেদীপ্যমান। সত্তোর আশির দশকের কবিদের মধ্যে শ্রেণীচেতনা, আবেগ ও যন্ত্রণার যে তীব্রতা, শূন্য দশকের কবিদের মধ্যে নিকট অতীতের যুদ্ধাংদেহী চেতনা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। সমাজ ও জীবনের অব্যাহত ভাঙ্গন কবিদের মধ্যেও এনে দিয়েছে বিস্মৃতিভাব, দেখে না দেখার অভিনয়,, শুনে না শোনার ভাণ। যতসব এলোমেলো ভাব খেলা করে যেন হালের অনেক কবিদের মাঝেই। জীবনের একদিক গেলে আরেকদিক আসবে, সভ্যতার এক পার ভাঙলে আরেকপাড় ভাসবে, শিল্পসাহিত্যে আমরা এসব দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশে যে ক্রমাগত ভাঙ্গনের খেলাই দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। গণমানুষের অধিকারের বোধগুলো যে ঢালে বান্ধে বাসা, সে ঢালই যেন ভেংগে পড়ে। সেই ভেংগে পড়ার স্রোত থেকে কবিরাও যেন দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়াতে পারে না মেরুদন্ড সোজা করে স্রোতের বিপরীতে, কবিতার হাতিয়ার নিয়ে। আনোয়ার জাহিদ তাই লিখেন ‘‘এই জেনারেশন পায়নি কোনো প্রেম/ জেগে উঠবার পর থেকে শুনেছে শুধু/ভাঙ্গনের ঘন্টাধ্বনি/অগ্রজের দীর্ঘশ্বাস/অদ্ভূত রাজনীতির রঙিন ঠোঁটের হাসি….‘‘
যা-ই হোক, ব্যক্তিগত বিষয় ও আত্মকেন্দ্রিক শব্দ ও ভাষার খেলায় কবিগণ আত্মনিয়োগ করেন। তবে সমষ্টিগত সামাজিক, দেশীয় ও বৈশ্বিক বিষয়াদি কবিতায় এড়ানো যায় না। স্বতস্ফুর্তভাবেই চলে আসে কবির চরণে চরণে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষঙ্গগুলোর বাস্তব ক্রিয়া বিক্রিয়া খেলা করে কবির মানসজগতে। কবিকে করে আত্মঅনুসন্ধানী ও সত্যানুসন্ধানি। এর প্রভাব যখন পড়ে কবিতায় তখনই কবিতা হয়ে প্রাসঙ্গিক, টিকে যায় সেই কবিতা, হয় কালোত্তীর্ণ। বাংলাদেশের কবিতা সমাজবিচ্ছিন্ন কখনোই ছিল না। এখনো তা থাকবে এমনটা কাম্য নয়। বরং প্রত্যাশা, ব্যর্থতা কিংবা যন্ত্রণার যে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক রূপ তা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বহুমুখী ভাঙ্গা=গড়া ও উথানপতনে বহমান থাকবে। কবিতায়ও তা স্বতস্ফূর্তভাবে চিত্রায়িত হবে কাব্যিক সব লীলা নিয়ে।
(২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারিতে দ্যা ডেইলি স্টার বাংলার সাহিত্য বিভাগে প্রকাশিত)
https://bangla.thedailystar.net/literature/news-438806
