কাঁঠালনামা: কাঁঠাল নারী না পুরুষ?
কাঁঠালকাহিনী: কাঁঠাল পুরুষ না মহিলা? জানতে পড়ুন।
……………………
আজ আপনাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবো। তথা আমি কাঁঠাল নিয়ে লিখবো আর আপনারা তা পড়বেন। পড়তে গিয়ে হাসি পেলে হাসবেন। কাঁঠাল আমার সবচাইতে প্রিয় ফলের একটা। শর্ত একটাই গাছপাকা সুন্দর শেইপের কাঁঠাল হতে হবে, আর ভিতরে রসে টইটুম্বুর কোষ থাকতে হবে।
২.
ছোটবেলায় নানাবাড়ির মসজিদ ছিল, যেখানে মক্তবে যেতাম। পাশে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। সেই কাঁঠাল গাছে এত কাঁঠাল ধরতো যে সারা গ্রামের সবাই ভাগ করে নিতে পারতো। আর এত মজার ছিল যে গ্রামের সবাই এ গাছের কাঁঠালের জন্য মুখিয়ে থাকতো। জীবনে অনেক কাঁঠাল খেয়েছি। সেই স্বাদ আর নেই। সেই গাছ থেকে আমরা মুচিও খেতাম। মুচি মানে হলো যে কাঁঠাল বড় হয়না, কাঁঠালের বাচ্চাকালে বড় হওয়া থেমে যায়। কিংবা বড় হতে না দিয়ে আমরা খেয়ে নিতাম। লবন-মরিচ দিয়ে মুচি খাওয়া ছিল রসনাবিলাস। সেটাও শিখেছিলাম ভল্লবপুর থেকে। এই মুচি বিষয়ে রবি ঠাকুরের একটা সুন্দর লাইন আছে।
‘‘কাঁঠালের গাছে উপযুক্ত সময়ে হুড়াহুড়ি করিয়া ফল তো বিস্তর ধরিল, কিন্তু যে ফলগুলা ছোটো ডালে ধরিয়াছে, যাহার বোঁটা নিতান্তই সরু, সেগুলা কোনোমতে কাঁঠাল-লীলা একটুখানি শুরু করিয়াই আবার অব্যক্তের মধ্যে অন্তর্ধান করে।‘‘
৩।
যে কথা বলছিলাম নানার বাড়ি ছাড়াও ভালো কাঁঠাল খেয়েছি জীবনে অনেক বার। ভারত সীমান্ত ঘেষা গোপীনাথপুর ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা প্রচুর কাঁঠাল হতো। সেখান থেকে ব্যাপারিরা কাঁঠাল নিয়ে ছড়িয়ে পড়তো পশ্চিমদিকে। আমাদের বাড়ি বড় রাস্তার পাশে ছিল। আমরা সব ব্যাপারির কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া দেখতাম। তারা কাঁঠালের ভার কাঁধে ঝুলিয়ে ছন্দে ছন্দে খুচি দৌঁড়ে হাঁটতেন। আব্বা মাঝে মাঝেই সেই সব ব্যাপারীদের থামাতেন। গাছপাকা কাঁঠাল দেখলেই সুন্দর দেখে বেছে নিতেন। আব্বার কেনা কাঁঠাল মাত্রই রসালো ভেতর আর গন্ধে ভরপুর। সব অমৃত । এছাড়া নিজেরাও পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়ে শখে শখে কাঁঠাল কিনে এনে খেয়েছি। মেহারি গ্রামে থাকার সময় প্রয়াত কালা মিঞার বাড়িতে দুটো গাছ ছিল। সেই গাছের কাঁঠাল যেমন শেইপ, যেমন গন্ধ তেমনি রসালো বড় বড় কোষ। এখনো ভালো কাঁঠাল খেতে গেলে সেগুলো মিস করি। পরে পড়াশোনা ও চাকুরির কারণে ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। গাছপাকা রসালো কাঁঠাল পাইনি। খুব কমই মনমতো হয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে কাজ করার সময় প্রচুর কাঁঠাল খেয়েছি। প্রতিটিই গাছপাকা ও রসালো। স্বাদ যেন সেই নানার বাড়ির গাছের কাঁঠাল কিংবা, বাবার হাতের কেনা।
৪।
গত ৪ বছর কাঁঠাল খেতে পারিনি। অস্ট্রেলিয়াতে কাঁঠাল নেই বললেই চলে। পাওয়া গেলেও যা দাম তা সাধ্যের বাইরে। আর ওরকম গাছপাকা রসালো কাঁঠালো পাওয়ার চিন্তা করাও ভুল। তাই কাঁঠাল খাওয়া হয়নি।
এবার দেশে আছি। কিন্তু দারুইন্যা করোনার কারণে বের হওয়া হয়না। কাঁঠালও কেনা হয়না। এর মধ্যে অফিস থেকে একদিন ফিরছিলাম। পথে এক বিক্রেতাকে দেখলাম ভ্যানে কিছু কাঁঠাল নিয়ে দাঁড়িয়ে। কয়েকটা কাঁঠাল থেকে একটা কাঁঠাল কিনলাম। মুঠি চিকন, ওজনে ভারি, সুন্দর শেইপ। বাসায় এনে ভাঙ্গার পরে দেখা গেলো মুখের ২/৩টা কোষ ছাড়া বাকি সব পঁচা। লবন পানি ঢুকিয়ে বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে। যাক কাঁঠালে অনেক কোষ ছিল বিধায় বিচি পাওয়া গেলো। কিন্তু কোষ খাওয়া গেলনা।
এরপরে স্বপ্ন সুপারস্টোরে অর্ডার দিয়ে কাঁঠাল আনালাম আর পরেরদিন ভায়রা ভাই একটা কাঁঠাল কিনে পাঠালেন। আগের মতোই হাতে তেল মেখে পেশাদারিত্বের সাথে কাঁঠাল ভাঙ্গি। সকালে নাস্তায় ওটস+দুধ+কাঁঠালকোষ খাই। বড়ই ইয়াম্মি। খেয়ে দেখতে পারেন। দুপুরে বা রাতে অন্য খাবারের পরে দুধ-ভাতের সাথে কাঁঠালকোষ খাই। আর বিকেলে শুধু কাঁঠাল দিয়ে স্ন্যাক্স সারি। তবে গমের ছাতু ও কাঁঠালের কোষ দিয়ে হাতে মুঠি বানিয়ে মুখে পুরার জন্য মন আনচান করছে। আর নানুর হাতের ভাজা খৈ দিয়ে কাঁঠাল খেতেও ইচ্ছে করছে!
৫।
অনেকে আছেন কাঁঠাল ভাঙতে গিয়ে আঠাতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। সেই গল্পের মতো। আফগানরা ব্যবসা করতে এদেশে এসে গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখে অবাক হয়েছিলো। এক বাঙালীকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি?”বাঙাল বললো এটা আমাদের জাতীয় ফল,খুবই সুমিষ্ট। সেই সাথে শয়তানি বুদ্ধিও মাথায় আসলো। কীভাবে ওর দাড়িতে কাঁঠালের আঠা মাখায় দেওয়া যায়! বললো,খেয়ে দেখো, কিন্তু শিখালো না কীভাবে আঠা ছড়িয়ে খেতে হয়! আফগান কাঁঠালের মজা পেয়ে খেতেই থাকলো আর আঠা গিয়ে দাড়ি,মোচ সবখানে জটা পাকিয়ে দিলো।ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলোনা! এই সময় রাস্তায় এক জটাধারী এক বাউল যাচ্ছিলো।ওকে দেখে আফগানি বললো,”তুম ভি কাঁঠাল খায়া?”
৬।
লং স্টোরি শর্ট, গতকাল মাকে ফোন করেছিলাম। বললো বাড়ির গাছে কাঁঠাল ধরেছে কতগুলো। পাঠানোর কথা বলছিল। আমি বললাম, দরকার নেই। ঢাকায় কেনা যায়। এখন করোনার মধ্যে ঝামেলা করে পাঠানোর দরকার নেই। না পাঠালেও বাবা-মা প্রতিটি কাঁঠাল খাওয়ার সময় সন্তানদের মনে করবেন। সবার কাছে বাবা-মার জন্য দোয়া চাই। মনে পড়ছে, ছোটবেলায় সকালে একটা কাঁঠাল ভেঙ্গে একদফা খেয়ে মা রেখে দিতেন বাকি কাঁঠালটা। আমি সারাদিন খেলার ফাঁকে পড়ার ফাঁকে সেই রেখে দেওয়া কাঁঠাল থেকে কোষ মুখে পুরতাম। কখনো মাকে দেখিয়ে, কখনো লুকিয়ে। বিকেলে বা রাতে মা দেখতেন কাঁঠাল প্রায় শেষের দিকে।
আমার এত কথা দেখে অনেকে হয়তো ভাবছেন লেখা বেশি বড়ো হয়ে গেছে। এত লোক, এত ঘটনা, এত কথার হিজিবিজি না থাকলে লেখা আরো ভালো হত। কাঁঠাল ফল দেখে যেমন মনে হয়– প্রকৃতি একটা ফলের মধ্যে ঠেসাঠেসি করে বিস্তর কোষ না দিলেও পারতো। অযথা আয়তনে খুব বড় ও ওজনে খুব ভারী না করলেও পারতো। এত বড় যে একজন লোকের ছোট্ট্র পাকযন্ত্রের পক্ষে হজম অসম্ভব। এরই একটাকে ভেঙে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা ফল গড়লে সেগুলো দেখতে ভালো হতো। আমার একেকটা লেখাও একটি সাহিত্যকাঁঠাল-বিশেষ। বড় দেখে মানুষ আশ্চর্য হয় বটে, কিন্তু সৌন্দর্য দেখে মানুষ খুশি হয়। স্থায়িত্বের পক্ষে সহজ-সরলতা ও সৌন্দর্য যে প্রধান উপকরণ তাতে আর সন্দেহ নেই। আর এসব দেখে আমি ভাবি বড় লেখক হয়ে গেলোম। আসলে এ যেন আমার ‘গাছে কাঁঠাল গোফে তেল‘।
৬।
যারা এ পর্যন্ত পড়ে ত্যাক্ত বিরক্ত, তাদের জন্য একটি কাঁঠালকৌতুক বলি। অনেককাল আগে একবার সরকারের নীতি নির্ধারকদের একটি দল জটিল সমস্যায় পড়লেন। সমস্যাটা লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত। তো তারা গেলেন তদকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। গিয়ে প্রশ্ন করলেন ‘কাঁঠাল কোন লিঙ্গ? প্রধানমন্ত্রী বললেন, এটা নির্ধারণ করা কোনো সমস্যা না। আমি আজকেই বাংলা একাডেমীর ডিজিকে বলে দিচ্ছি। তিনি জানিয়ে দিবেন। কিন্তু দুইদিন গেল, ডিজি জানালেন না। তখন তারা গেলে সাবেক কবি কাম প্রেসিডেন্ট এরশাদ এর কাছে। এরশাদের ঝটপট জবাব-আরে কাঁঠাল হল পুং লিঙ্গ। কারণ কাঁঠালের বিচি আছে!
যাই হোক শেষ করি। নজরুলের ‘ভাঙারগান’ কাব্যগ্রন্থের ‘মিলনগান’ কবিতায় বহু প্রবাদের মতো কাঁঠাল নিয়েও একটি প্রবাদের সাক্ষাৎ মেলে। আংশিক দিলাম।
(মা’র) বন্ধ ঘরে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হলো দুই নয়ান।
(তোরা) শুনতে পেয়েও শুনলিনে তা মাতৃহন্তা কুসন্তান॥
(ওরে)তোরা করিস লাঠালাঠি (আর) সিন্ধু-ডাকাত লুঠছে ধান।
(তাই) গোবর-গাদা মাথায় তোদের কাঁঠাল ভেঙে খায় শেয়ান॥
(ছিলি) সিংহ ব্যাঘ্র, হিংসা-যুদ্ধে আজকে এমনি ক্ষিণ্ণপ্রাণ।
(তোদের) মুখের গ্রাস ঐ গিলছে শিয়াল তোমরা শুয়ে নিচ্ছ ঘ্রাণ॥
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কাঁঠালকে কাডল বলে । কাডলের অনেক খাদ্যগুণ আছে। আচে শর্করা, আমিষ আর ভিটামিন। বেশি করে কাডল খান, নজরুলের বয়ানমতো মেরুদন্ডের জোর বাড়ান।
১০ জুন, ২০২০।