Detail

Home - গল্প - গল্প: ‘দোয়া-প্রার্থনা’ – সফিকুল ইসলাম

গল্প: ‘দোয়া-প্রার্থনা’ – সফিকুল ইসলাম

দোয়া প্রার্থনা

 

মসজিদে দোয়া শুরু হয়েছে। সভাপতি সাহেব হজ্জ থেকে ফিরেছেন। তাই সবার জন্য এই আয়োজন। জুমআ শেষে দোয়া হবে মর্মে  আগেই এলান দেওয়া হয়েছে। সফেদ দাড়ির ইমাম সাহেবের শাদা পাঞ্জাবিতে মুখমন্ডলে নূরাণি ভাব ফুটে উঠেছে। পুরো মুখ উজ্জ্বল লাগছে। পান খেয়ে মুখ লাল করে রাখাতে ঠোঁট ও দাঁত কিছুটা খয়েরি রঙ ধারণ করেছে। চোখ বন্ধ করে তিনি কুরান তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ ও আস্তাগফির পাঠ করেছেন। আল্লাহুম্মা সাল্লিয়ালা বলে তিনি মিলাদ শুরু করলেন। সুরে সুরে সবাই মিলাদ পড়ছে। ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে পুরো মসজিদ গমগম করছে। একটা আলাদা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বিরাজ করছে।

ইমাম সাহেব সুন্নী ঘরাণার লোক। তাই মিলাদে কিয়াম করেন। তথা দাঁড়িয়ে দরুদশরীফ পড়েন। ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা, ইয়া হাবীব সালাম আলাইকা, সালাওয়াতুল্লাহ আলাইকা। মুসুল্লীদের অনেকে আবার দাঁড়িয়ে মিলাদ পড়াতে অনীহা। তারা দেওবন্দ মাদ্রাসাপন্থী। তাঁদের কেউ কেউ বসেই পড়েন । দাঁড়ান না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন মধ্যপন্থী। যেখানে ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েন,তারাও দাঁড়িয়ে পড়েন। যেখানে ইমাম সাহেব বসে পড়েন, সেখানে তারা বসে পড়েন। এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করেন না।

আজকের ইমাম সাহেব দাঁড়িয়েই মিলাদ পড়ছেন। ফাঁকে ফাঁকে আবার ওয়াজও করেন। হুজুর আবার পড়ছেন।

বালাগাল উলা বি – কামালিহী

কাশাফাদ্দুজা বি – জামালিহী

হাসুনাত জামিউ খিসালিহী

সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী ।

(যিনি (সাধনায়) পূর্ণতার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন ,

যাঁর সৌন্দর্যের আলোকে অন্ধকার দুর হয়েছে ,

যাঁর আচরণ – ব্যবহার ছিল সৌন্দর্যের আকর ,

দরুদ তাঁর এবং তাঁর বংশধরগণের উপর ।)

হুজুর গলা উঁচু করে জানান যে , এ দরুদটি লিখেছেন শেখ সাদী (রহঃ)। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হযরত শেখ সাদী (রহঃ) এই দরুদ শরীফের প্রথম দু’লাইন লেখার পর কি লিখবেন তা তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তন্দ্রাছন্ন হয়ে গেলেন। তন্দ্রার ভাব আসলে স্বপ্ন দিদারে তিনি রাসুল (সাঃ) এর দেখা পান । প্রিয় নবীজী (সাঃ) স্বয়ং তখন সাদী (রহঃ) কে বলেন –

হে সাদী ! তুমি লিখ –

‘‘হাসুনাত জামিউ খিসালিহী ,

সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী ।‘‘

তার মানে শেখ সাদী নবীজিকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসায় আকুল হয়ে নবীজীর উপর দরুদ রচনা করতে যান। এবং এক রচনা করতে গিয়েই ধ্যানে নবী করিম (স:) এর সাক্ষাত পেয়ে যায়।  ইমাম সাহেব বলেন সারা বিশ্বে এ দরুদশরীফ অত্যন্ত জনপ্রিয়। এত অল্প কথায় এর চাইতে ভালো ছন্দময় দরুদ আর হয় না।

মিলাদ কিয়াম শেষে ইমাম সাহেব দোয়া শুরু করলেন। ইমাম সাহেবের সাথে সবাই হাত তুললো। শুরুতেই যা কিছু পাঠ হয়েছে তা কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে এর ছওয়াব যেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইসে সাল্লামসহ সকল নবী রাসুল পায় সে দোয়া করলেন। এক ফাঁকে পৃথিবীর সকল মুসলমানকে আল্লাহ যেন ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন ও সমৃদ্ধি দান করলেন। দোয়া করতে করতে এক পর্যায়ে সবাইকে একবার সূরা ফাতিহা, সুরা এখলাছ তিনবার ও দরুদশরীফ এক বার পড়তে বললেন। পড়া শেষ হলে সবাইকে নিজ মকসুদ বা আশা কল্পনা করে আল্লাহ পাকের কাছে চাইতে বললেন। উপস্থিত মুসল্লি সকলে চোখ বন্ধ করে নিজ নিজ দোয়ার দরখাস্ত আল্লাহ পাকের কাছে পেশ করছেন। বড়ই মনোরম সে দৃশ্য-

সামনে বসা চেয়ারম্যান সাহেব চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে চাইলেন “ হে আল্লাহ আমাকে তুমি সামনের চেয়ারম্যান ইলেকশানে জিতিয়ে দাও, আমার প্রতিদ্বন্দী ফারুক যেন কোনোভাবেই নমিনেশন না পায় সে ব্যবস্থা করে দাও,  আর আমার বখাটে ছেলেটাকে একটু শান্ত করে দাও“।  দূরে বসা ফারুকও দোয়া করলো ‘‘ হে প্রভু, তুমি মেহেরবান, কত কষ্ট করে বছরের পর বছর রাজনীতি করতেছি, তুমি আমাকে চেয়ারম্যান ইলেকশনে নমিনেশন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। ও চেয়ারম্যান হওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।

একটু দূরে বসা মসজিদের ‍মুতাওয়াল্লি দোয়া করলেন “ আমার ছেলেটা পুলিশে চাকুরি করে, গত তিন বছরে বাড়িতে তিনতলা ভবনের কাজ শুরু করেছে। ভবনটা যেন আগামী বছরের মধ্যে তিনতলা করতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দাও, তার সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দাও আর তাকে সুস্থ রেখো“।

এরপরে বসা বৃদ্ধ মুসল্লি রহমান দোয়া করলো “প্রতিবেশী রাজীবের সীমানা পেরিয়ে যেটা দখল করেছি, সেটা যেন দখল থাকে, কোনোভাবেই সে আমার সাথে পেরে না ওঠে। আমার ছেলেটা দুবাই থাকে, তার ইনকাম বাড়িয়ে দাও। যেন দখল করা জায়গায় একটা ভবন করতে পারি, আর আমাকে আমার স্ত্রীকে সুস্থ রেখো, যেন সব দেখে যেতে পারি“। দূরে বসা রাজীব দোয়া করলো, ‘‘ হে আল্লাহ, রহিম রহমান, তুমিতো সব সময় বঞ্চিতের পক্ষে। তুমি রহমানের অন্যায়ের বিচার করো। সে আমার জায়গা দখল করে রেখেছে, তার হাত পা তুমি লুলা করে দাও। যেন আমি গিয়ে আমার জায়গা পুনরায় দখল নিতে পারি।‘‘

এরপরে বসা মাসুম নামের লোকটি দোয়া করলো “ হে আল্লাহ তুমি আমাকে মামলাটায় জিতিয়ে দাও, আমি জানি যে মামলাটা মিথ্যা মামলা। তবু তুমি আমাকে জিতিয়ে দাও। পাশের আফিল খুব বাড় বেড়েছে, ওকে শান্ত করতে হলে কিছুদিন জেল খাটাতে হবে। তোমার কুদরত ছাড়া এ মামলায় জেতা সম্ভবনা, জজ সাহেবের মনটা নরম করে দাও। আর আমার বউ এগারোতম বাচ্চা হওয়াতে অসুস্থ হয়ে আছে, তাকে সুস্থ করে দাও।“

পাশে বসা জমিরুদ্দি দোয়া করলো “হে আল্লাহ তুমি তো সব জানো, আমি গতরাতে ইউসুফের পুকুরে বিষ দিয়ে মাছগুলো মেরে ফেলেছি, ওরা খুব খোঁজ তালাস করতেছে, মামলাও নাকি করবে। আমাকে যেন সন্দেহ না করে বা বুঝতে না পারে সে ব্যবস্থা করে দাও। আর আমার ছেলেটা পড়ায় মনোযোগী না, ওর পড়ায় মনোযোগী করে দাও।“ দূরে বসা ইউসুফ দোয়া করলো, ‘‘হে আল্লাহ, তুমিতো দেখেছো কত কষ্ট করে আমি মাছ চাষ করেছি। মাছগুলো বড় হতে না হতেই বিষ দিয়ে দিল। কে দিলো কেন দিলো, তারে যেন ধরতে পারি। তার বিচার তুমি করিও।‘‘

কোণে বসা এক নেতা করিম দোয়া করলো ‘‘আগামী নির্বাচনে যেন পার্টির ইউনিয়ন শাখার সভাপতি হতে পারি সেই তৌফিক এনায়েত করে দাও।‘‘আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করলো।

পেছনের সারিতে বসা এক ছাত্র মনির দোয়া করলো ‘ হে আল্লাহ পরীক্ষায় যেন প্রথম হতে পারি, কলিমুদ্দির ছেলে কফিল যেন কোনোভাবেই প্রথম না হয়‘‘। পাশেই কলিমুদ্দির ছেলে কফিল বসা। সেও দোয়া করলো ক্লাসে প্রথম হওয়ার জন্য।

মাঝখানে বসা কলেজে পড়া তরুণ ফরিদ দোয়া করলো, ‘‘ আল্লাহ তুমিতো জানো আমি কতটা ভালোবাসি ফারজানাকে। ফারজানার মন তুমি নরম করে দাও। তার চোখে তুমি আমারে এত যোগ্য করে দাও, যেন সে আমারে ছাড়া আর কারও দিকে না তাকায়।‘‘ পাশেই বসা ফজলুও দোয়া করলো ‘‘ হে প্রভু, ফারজানা যেন কোনোভাবেই ফরিদকে পছন্দ না করে। আমার সাথে যেন জোড়া লাগে, আমার সাথে ফারজানার লাইনটা তুমি ক্লিয়ার করে দাও। তুমিতো খোদা সবই পারো।

সামনে বসা বৃদ্ধ বসিরুদ্দি দোয়া করলেন ‘‘ হে আল্লাহ, অনেকদিন ধরে ক্যান্সারে ভূগতেছি, তুমি আমারে কূল করে নাও। হয় নিয়ে যাও, না হয় সুস্থ করে দাও। সন্তানদের ও সন্তানদের বউদের কথার অত্যাচার আর নিতে পারতেছি না। যাদের কষ্ট করে বড় করলাম, তারাই আজ আমাকে দুটি ভাত দেয় আর সামান্য চিকিতসা করে। তাতে কথায় কথায় খোটা দেয়। এসব কথার খোঁচা ও খোটা নেওয়ার চাইতে মরে যাওয়া ভালো। বিষ  খেয়ে মরে যেতাম। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই সে পথে যাই নি। তুমি তো যখন তখন মানুষকে মৃত্যু দিতে পারো। আমাকে নিয়ে যাও।‘‘

বাদিকে পেছনে বসা রমিজ দোয়া করলো ‘‘ হে আল্লাহ, তুমি দেখেছো আমি বছরের পর বছর প্রবাসে দিন কাটিয়েছি। আয় করে বাড়িতে পাঠিয়েছি। এখন দেশে এসে শুনি আমার সব টাকা বউ কাজে লাগায় নি। কোথায় কত আছে কোনো হিসাব পাচ্ছি না। আবার লোকজন বলতেছে, ওর সাথে নাকি পাশের বাড়ির কার গোপন সম্পর্ক আছে। এসব অনাচার থেকে আমাকে উদ্ধার করো।  আমার বউকে আমার দিকে রুজু করে দাও। আমার সংসারে শান্তি এনে দাও। আর আমি যে আফ্রিকা থাকার সময় মিশরি মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করেছি, এ খবর যেন কেউ না জানে। তুমি সকল কিছু গোপন করে দাও।‘‘

পেছনের এক কোণায় বসা মতিন দোয়া করে ‘‘ হে প্রভু। তুমি তো জানো আমি কত কষ্ট করে ছোট ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছি। তাকে কোনো কাজ করতে দিই নি। বড় এডভোকেট বানিয়েছি। আমি নিজে বিয়ে করি নি। তিলে তিলে টাকা জমিয়ে ৫০ কানি জমি কিনেছি। যে ভাই কে এত কষ্ট করে বড় করলাম, সে ভাই এখন এডভোকেট হয়ে গ্রামের সমস্ত জমি একা ভোগ করতে চায়। আমাকে আমার জমির ভাগ দিতে চায় না। তুমি তাকে হেদায়েত করো। তোমার কাছে বিচার দিলাম।‘‘ পাশেই বসা তার ভাই লুকমান দোয়া করে ‘‘ আল্লাহগো তুমি তো জানো আমি বাপের সম্পদ প্রাপ্য। আমার ছোটবেলায় পড়াশোনা করিয়েছে , এটা তাদের দায়িত্ব। এখন এসব বলে আমাকে আমার সম্পদ বেচতে দেয় না। তুমি এটার একটা বিহীত করবা। তুমি সকল ক্ষমতার মালিক।‘‘

ইমাম সাহেব সময় দিয়েছে মাত্র এক মিনিট। এরই মাঝে সবাই যার যার দোয়ার চাহিদা খুলে বসেছে। কল্পনায় তুলে ধরেছে খোদার কাছে বিড়বিড় করে। এ এক আজব জায়গা। যেখানে এসে প্রতিটি মানুষ সব সত্য কথা বলে। নিজের দোষ, সমস্যা কিছুই লুকাতে পারে না। সব খুলে বলে আল্লাহর কাছে। আল্লাহর কাছে কিছু লুকায় না। মানুষ আল্লার কাছে সব বলে কেন? কারণ আল্লাহ পাক সব গোপন রাখে। প্রকাশ হবার সম্ভাবনা নেই। যেহেতু প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই তাই আল্লাহর কাছে সব বলে। তাছাড়া আল্লাহ পাক সব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন- এটাও মানুষের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই মানুষ আল্লাহর কাছে সব গোপন আর্জির ঝাঁপি খুলে বসে।

সবার সব দোয়া নিয়ে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে যায়। সাত আসমান পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে আল্লাহ পাঁকের কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ পাকতো সর্বত্রই বিরাজমান। তবে ফেরেশতাদের কেন কষ্ট করে এত উপরে আসতে হলো? ফেরেশতাদের আসলে কষ্ট হয় না। টুশ করে যখন তখন যেখানে সেখানে চলে যেতে পারে। ফেরেশতারা গিয়ে আল্লাহ পাককে কী অবস্থায় পেলো? আল্লাহ পাক ঘুমান না। কিংবা ঘুম বা জেগে থাকা ইত্যাকার মানবীয় বিষয় আল্লাহ পাকের নয়। ফেরেশতারা দোয়ার লিস্ট নিয়ে আল্লাহ পাককে দেয়। আল্লাহ পাক যদিও আগেই জানে বা সব শুনেছে বা দেখেছে। তবু লিস্ট উল্টে পাল্টে দেখে। কিংবা মানুষের কাঁধে বসা কেরামান কাতিবিন এর খাতার সাথে মিলিয়ে নেয়। আল্লাহ পাক হয়তো সব দোয়ার লিস্ট দেখে মুচকি হাসে। আর বলে, মানুষ আমার সেরা সৃষ্টি। মানুষই যদি এরকম হয়, তবে বাকিরা কীরকম! ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করে, সবার দোয়া কোনটি কবুল করবেন, আর কোনটি কোনটি  করবেন না? ফেরেশতাদের প্রশ্নে হয়তো আল্লাহ পাক কৌতুক বোধ করেন।

কারণ দোয়ার মধ্যেই যে প্যাঁচ লাগানো তা কবুল করতে গেলে ঝাঁমেলা বেঁধে যাবে। একজনের দোয়া কবুল করতে গেলে আরেকজনকে বঞ্চিত করতে হয়। মামলায় একজন জিতলে আরেকজন হারবে, ফারজানাকে একজন পেলে আরেকজন পাবে না, ইলেকশনে একজন জিতলে আরেকজন হারবে। তাই তাদের সবার দোয়া কবুল করা বা বাতিল করা কোনোটাই সম্ভব না। আল্লাহপাক এসব ছোট বিষয়ে নজর না দেওয়ার ভাব করে ধ্যানে থাকলেন। আর ফেরেশতারা গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেলেন। ‘‘লেট ইট বি। যা হওয়ার তাই হোক। প্রত্যেকে যার যার চেষ্টা ও কর্ম করুক। যার চেষ্টা ও কর্ম শতভাগ হবে, সে ততটুকু সফল হবে। মানুষকে আমি বি্দ্যা, বুদ্ধি, শারিরীক-মানসিক ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছি। মেসেঞ্জার পাঠিয়ে ভালো মন্দ পথ কি তা জানিয়েছি। এখন মানুষ যা করবে তার ফল পাবে। দুনিয়াতেও পাবে আখেরাতেও পাবে।  একারণেই রাখা হয়েছে পরকাল, বেহেশত দোজখ। সুতরাং মানুষ নিজেরা করুক। নিজেরা চেষ্টা করুক। নিজেরা করলে নিজেদের কাজের হিসেব নিজেরা দিবে।‘‘।

হুজুর দোয়া করার সময় প্রতিবারই বলে যে, ‘‘ চাওয়ার মতো চাইলে দোয়া কবুল হয়। সেরকমভাবে খালেস নিয়তে চাইতে হবে। চাওয়ার মধ্যে গলদ থাকলে বা বিশ্বাসে কমতি থাকলে পাওয়া যাবে না। আল্লাহর কাছ থেকে কেউ নিরাশ হয় না।

মুসল্লীদের মধ্য থেকে রহমান একদিন হুজুরকে প্রশ্ন করে, ‘‘হুজুর, আমিতো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আল্লাহপাকের ক্ষমতা সব। দোয়াও করি খালেস নিয়তে। তবু আমার দোয়া কবুল হয় না কেন?

হুজুর বলেন ‘‘মনে প্রাণে চাইলে তো কবুল হওয়ার কথা। কী চেয়েছিলেন আর কী পাননি জানলে উত্তর দেওয়া সহজ হতো। শুনে রহমান কাচুমাচু করে। কথা বলে না। হুজুর  ব্যখ্যা দেয় ‘‘মনে প্রাণে চাওয়ার অর্থ হলো যা চাইলেন তার জন্য আপনাকে কাজ করতে হবে। মনে প্রাণে চেষ্টা করতে হবে। আপনি অর্থ রুজি করতে চান। সেক্ষেত্রে সেরকমভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, বুদ্ধি খাটাতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে। কেবল আল্লাহর কাছে চাইলেন তাহলে হবে না। নিজেও কাজ করতে হবে।  শুনে রহমান বলে ‘‘যদি আমারই সব করা লাগে তবে আল্লাহ পাকের কাজ কী?‘‘। হুজুর হেসে পুনরায় বলে ‘‘ আল্লাহ পাকের কাজ রহমত নাজিল করা, বরকত দেওয়া। যা কিছু কল্যাণকর তা তোমার জন্য বরাদ্দ করা। যা কিছু অকল্যাণকর তা না দেওয়া। বিশেষ করে মানুষ জানে না যে কোনটা তার জন্য মঙ্গলজনক। ধরো একজন মানুষ চাইলো যে, সে ইউরোপে যাবে চাকুরি করতে। কিন্তু অনেক পরিশ্রম ও চেষ্টা করার পরেও তার এ দোয়া বা চেষ্টা কবুল হলো না। ইতালি যাওয়া হলো না। লোকটি চেষ্টাও করেছে, খোদার নিকট দোয়াও করেছে। দোয়া কবুল হয়েছে বটে। কিন্তু ইতালি যাওয়া হলো না। তখন লোকটি মন খারাপ করে বটে। ভাবে মনে হয় আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নি। বস্তুত লোকটি যদি জানতো যে ইতালি যাওয়ার পরে যে কারখানায় কাজ করতো সে কারখানার অগ্নিকান্ডে লোকটির পা হারাতো। তাহলে কি লোকটি ইতালি যেতে চাইতো? চাইতো না। যদি কোনো  ইচ্ছা পূরণ না হয় তবে বুঝতে হবে যে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে মঙ্গল রয়েছে। ইতালি না যাওয়ার মধ্যেও মঙ্গল নিহিত থাকতে পারে। লোকটি মূলত কী চেয়েছিল? আরাম ও শান্তির জীবন, অর্থ ও স্বচ্ছলতার জীবন। সেটা দেশে থেকেও হতে পারে যা আল্লাহপাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ভারতবর্ষে প্রচলিত একটি গলপ বললেন ইমাম সাহেব। ইসরায়েলের সম্রাট সুলাইমান তথা বাদশা সুলাইমান একবার নিজ দপ্তরে বসে এক মন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় সুন্দর চেহারা ও দামি পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি সুলাইমানের কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং কিছুক্ষণ বসার পর চলে গেলেন। লোকটি চলে যাওয়ার পর মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে বাদশা, এই মাত্র আপনার কাছে যে লোকটি এসেছিলেন তিনি কে?’ সুলাইমান বললেন, ‘তিনি মৃত্যুর ফেরেশতা মালেকুল মউত।’

এই কথা শুনে মন্ত্রী কাঁপতে লাগলেন এবং তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বাতাস ছিল সম্রাট সুলাইমানের আজ্ঞাবহ। মন্ত্রী বললেন, ‘হে বাদশা, অনুগ্রহ করে আপনার আজ্ঞাবহ বাতাসকে হুকুম দিন, সে যেন আমাকে হিন্দুস্তান পৌঁছে দেয়। কারণ যেখানে মৃত্যুর ফেরেশতা বসেছে, সেখানে বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।’ সম্রাট সুলাইমান মন্ত্রীর আবেদন গ্রহণ করলেন এবং তাঁকে হিন্দুস্তান পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাতাসকে নির্দেশ দিলেন। বাতাস মন্ত্রীকে হিন্দুস্তান পৌঁছে দিল।

কিছুক্ষণ পর আবার মালেকুল মউত উপস্থিত হলেন সুলাইমানের দপ্তরে। জানতে চাইলেন, ‘মাননীয় সম্রাট, আপনার মন্ত্রী কোথায়?’ সম্রাট বললেন, ‘আপনার ভয়ের কারণে বাতাস তাঁকে হিন্দুস্তান পৌছে দিয়েছে।’ মালেকুল মউত বললেন, ‘কিছুক্ষণ আগে যখন আমি আপনার দপ্তরে এসেছিলাম, তখন ওই মন্ত্রীকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। কেননা আমার প্রতি নির্দেশ ছিল হিন্দুস্তান থেকে তার জান কবজ করার। কিন্তু সেই ব্যক্তি হাজার মাইল দূরে আপনার কাছে বসে আছে দেখে অবাক হিয়েছিলাম। আমি নির্দিষ্ট সময়ে হিন্দুস্তান পৌঁছে দেখি আপনার মন্ত্রী হিন্দুস্তানে উপস্থিত এবং তার জান কবজ করে আবার আপনার কাছে এলাম।’

গল্পটির মরাল হলো মন্ত্রীর কর্মগুণে বা কপালগুণে যেখানে মরবার সেখানেই মরবে। সোলায়মানকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। অতি সম্প্রতি চিশতি বয়াতির গানটিও স্মর্তব্য। যদি থাকে নসীবে আপনি আপনি আসিবে জোর করে মন হরণ করো না……….।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart