Detail

Home - গল্প - গল্প: ’ভার্সিটির চোরাগলি’ – সফিকুল ইসলাম

গল্প: ’ভার্সিটির চোরাগলি’ – সফিকুল ইসলাম

ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান কামাল স্যার নুপুরকে আজ আসতে বলেছিলেন। বিকেল ৩টায় একান্তে দেখা করতে বলেছেন। সেজন্য সে এসে অপেক্ষাগারে বসে আছে। নুপুর মেঘদূত ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগে পড়ে। মাষ্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষাও দিয়েছে। সামনে ভাইভা। এর মধ্যে একান্তে ডাকার মানে কি নূপুর বুঝতে পারছে না। গতকাল একটি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে বের হবার সময় স্যারের সাথে দেখা। ভীড়ের মধ্যে অনেকটা ফিসফিস করেই কামাল স্যার আসার কথা বলেছিলেন। সেই থেকে ওর মনে খচখচ করছে। কী কারণ থাকতে পারে ডাকার।
হয়তো ভাইভা বিষয়ে কোনো গাইড করবে, না হয় প্রশ্নের ধরণ বিষয়ে কোনো সাজেশন দিবে, না হয় ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো পথ দেখাবে। এরকম ইতিবাচক কথাই মনে আসতেছে। আবার সে কোনো ভুল করেছে কিনা, কেউ কোনো নালিশ করেছে কিনা এসব প্রশ্নও মাথায় আসছে। তাই সে মনে মনে ভয় পাচ্ছে। ভয়ের আরও কারণ রয়েছে। কারণ তার অতীতের অভিজ্ঞতা ততটা ভালো না।

প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পরে একবার হানিফ স্যার ডেকেছিলেন। পড়াতেন ভালো। আন্তরিক ব্যবহার। তাই স্বাচ্ছন্দেই গিয়েছিলো। একথা ওকথা বলার পরে হঠাৎ হানিফ স্যার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন- তা এখনও মনে হলে ওর রাগ উঠে যায়। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সে কিছু না বলে বের হয়ে এসছিল। স্যার হয়তো ভেবেছিলেন যে নূপুর বিষয়টা সারা ডিপার্টমেন্টের সবাইকে বলে বেড়াবে। কিন্তু নূপুর মুখ খুলে নি।

মুখ খুলে নি কারণ এসব কথা যতই প্রচার হবে শিক্ষকের মান যা-ই যাবে, ওর নিজেরও ক্ষতি কম হবে না। সামনে সবাই বাহবা দিবে। বাহ ভালো করেছিস বলে পিঠ চাপড়াবে। কিন্তু মনে মনে ভাববে নিশ্চয়ই স্যারের সাথে কিছু ছিল। না হলে এমন কথা বলে বেড়াবে কেন? তথা কোনো না কোনোভাবে ওর উপর একটা আবছা কলঙ্কের ছায়া আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। যার প্রভাব ওর নিজ জীবনে ও ক্যারিয়ার জীবনে পড়বে।

গরীব কৃষক বাবার সন্তান। গ্রাম থেকে পড়ে মফশ্বল শহরের এই ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে পড়তে এসছে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম কোথাও চান্স হয় নি। বড় ভাইটি গ্রামের দোকান চালায়, সে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠায়। ওটা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা চালায়। সুতরাং সংগ্রামের এ জীবনে নতুন কোনো সংগ্রামে পা দেওয়ার সাহস সে করে না। তাই হানিফ স্যারের এ কুমনোভাব কাউকে বলে না। আজকে কামাল স্যারের ডাকবার হেতু কী হতে পারে- এ নিয়ে শঙ্কা কাজ করছে মনে।

দ্বিতীয় বর্ষেও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একদিন এক ক্লাসের ইনকোর্স পরীক্ষায় সে প্রথম হয়েছিল। খাতা দেওয়ার সময় রব্বানি স্যার খুব প্রশংসা করেছিল। ওর লেখা, চিন্তা ও বিশ্লেষণের তারিফ করেছিল। পুরো ক্লাস হাততালি দিয়েছিল। ক্লাস শেষে স্যারের সাথে দেখা করতে বলেছিল। নূপুরও সহজ মনেই গিয়েছিল। যাওয়ার পরে শুরুতে পরীক্ষায় ভালো করার কিছু টিপস দিয়েছিলেন। বিভাগে প্রথম হওয়ার জন্য ও পরে শিক্ষক হওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন। শেষে বলছিলেন ‘‘তুমি কিন্তু দেখতে খুবই সুন্দর‘‘। স্বভাবসুলভভাবেই নূপুর স্যারকে ধন্যবাদ দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী বাক্যালাপ এমনভাবে আগাচ্ছিল যে তা আর সাধারণ কোনো প্রশংসার মধ্যে নেই। মনে হচ্ছিল তার সারা শরীর চিবিয়ে খাচ্ছিল সেই হায়েনার বাচ্চা। মুখে সুন্দর সুন্দর শব্দ বললেও তাকানোতে অস্বস্তি লাগছিল। মেয়েদের এ গুণটা আছে। রাস্তায় হাঁটার সময় মেয়েরা কারও দিকে না তাকিয়েও বলতে পারে পাশে অতিক্রম করা কোন পুরুষ কোন নজরে তাকিয়েছে। এ ক্ষমতা মেয়েদেরকে ঈশ্বর দিয়েছেন। ভালো করেই দিয়েছেন। সুতরাং রব্বানি স্যারের বাক্যালাপ যখন রসের নানান দিক ইংগিত করছে, তখন সে ক্লাস আছে বলে ত্রস্ত হয়ে বের হয়ে এসছিল। স্যার আসি বলে আর অনুমতির তোয়াক্কা করে নি। তবে এরপরে আর কোনোদিন রব্বানি স্যারের রুমে যাওয়া হয় নি। আর এ কথা কাউকে সে জানায়ও নি। নূপুর নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে এতটা ম্যাচিউরড হয়ে গিয়েছে। বাবা ও ভাইয়ের আদরের মেয়ে হিসেবে গ্রামে থাকতে একটু বদরাগীই ছিল। যখন তখন বায়না ধরা বা জেদ ধরা ছিল কমন বিষয়। ছোট বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘরে তুলকালাম করতো। সে আজ বড় অপরাধ দেখেও চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। বাবা- মা ও ভাইয়ের কষ্ট দেখে ও তাদের উৎসাহে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে এসে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হচ্ছে। হলে থেকে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটালেও বাবা-মাকে জানায় না, কাউকে বলে না। পরিবারের যে অবস্থা তাতে বাড়তি টাকা চাওয়ার সুযোগ নেই। ইউনিভার্সিটি আসলে এমন জায়গা যে এখানে আসলে ম্যাচিওরিটি তৈরি হয়ে যায়, বোধগম্যতার প্রগাঢ়তা বাড়ে। নূপুরও ম্যাচিওরিটির পথে আগাচ্ছে। তাই হুট করে মাথা গরম করে এসব কথা বলে বেড়ানো ঠিক বলে মনে হলো না। নি¤œমধ্যবিত্তের মেয়ে জানে যে, রূপ আছে, কিন্তু মুখ থাকতে নেই। তাই দৃপ্ত পায়ে বেড়িয়ে গিয়ে পরের ক্লাসে মন দিয়েছে। রাস্তায় কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে যেমন আমরা দ্রæত চলে আসি আবার দ্রæত তা ভুলেও যাই। তেমনি এসব উটকো ঝামেলা দ্রæত ভুলে যেতে পারাই ভালো- বলে নূপুর মনকে প্রবোধ দেয়।
এর আগের চেয়ারম্যান ছিলেন জাহেদা ম্যাডাম। দ্বিতীয় বর্ষে প্রথম হওয়ার পরে তিনি একদিন ডাকলেন। বললেন ওনার মেয়েকে পড়াতে হবে। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের মেয়ে বলে কথা । না পড়িয়ে উপায় নেই। প্রতিদিন বিকেলে গিয়ে পড়াতে হয়। কিন্তু মাস শেষে এক হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। যেখানে অন্য যে কোনো টিউশনিতে সপ্তাহে তিনদিন পড়ালেই ৫ হাজার পাওয়া যায়। মফশ্বল শহর হলেও ন্যুনতম ৩ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি এক হাজার টাকা দেন। আবার কোনো কোনো মাসে দেন না। কিছু বলা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ডিপার্টমেন্টের এক লেকচারার যার বাড়ি নুপুরের নিজ জেলায় । তাঁর সাথে নুপুর বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করেন, তিনিও ¯েœহ করে সহযোগিতা করেন। কিন্তু এতে বাঁধ সাধে জাহেদা ম্যাডাম। ওনার সাথে ওই লেকচারের কি না কি দ্ব›দ্ব , তাই নূপুরকে কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেন। নূপুর যেন ওই লেকচারারের সাথে না মেশে। ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষকের সাথে আরেকজন শিক্ষকের মনোমালিন্য থাকতে পারে, তাই বলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদেও উপরও ফেলতে হবে কেন- তা নূপুর ভেবে পায় না। নারী শিক্ষার্থীরা নারী শিক্ষকের কাছে বাড়তি সুবিধা পাবে দূরের কথা, উল্টো বাড়তি ঝামেলা তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মনে হিংসার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেন। নূপুর এসব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খায়। চেয়ারম্যান জাহেদা বেগমের হাত অনেক লম্বা। তাই সব অন্যায় আব্দার মেনে নেয় সে। চেয়ারম্যানের মেয়েকেও মাসের পর মাস পড়িয়ে যায়। কিচ্ছু করার নেই।

এসবের মধ্যেই নূপুর মাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠায়। মায়ের মোবাইল নেই। ভাইয়ের মোবাইলেই মেসেজ পাঠালে ভাইয়া মাকে দেখায়।
মা,
‘‘নতুন শহরের পথ আর ইউনিভার্সিটির অলিগলি কিছু বুঝলেও মানুষগুলোর মনোজগতের অলিগলি কিছুই বুঝতে পারি না। যেখানেই দেখি কেবলই গহবর, অন্ধকার চোরাপথ। তবু দূর থেকে তোমার মুখখানি ভেসে উঠে। এসব অন্ধকারে তোমার মুখই আলোর রশ্মি দেয়। কীভাবে এ শহর আর এ ইউনিভার্সিটির চোরাগোপ্তা হামলা থেকে বাঁচবো বলো। কীভাবে ধুমকেতুর ন্যায় পাশ কাটিয়ে দেদীপ্যমান থাকবো? তোমার পায়ের আওয়াজ পাই, তোমার গায়ের সুবাস পাই- যখন শুনি আজানের ধ্বনি।‘‘

মেসেজটি লিখলেও নূপুর মেসেজটি আর সেন্ড করে নি। সেন্ড বাটনে ক্লিক করতে গিয়ে ভাবলো এসব কঠিন কথা মায়ের কাছে পাঠানো ঠিক হবে না। স্ক্রিণশট রেখে দিয়ে মেসেজটি ডিলিট করে দেয়। কেবল লিখে, ‘‘মা তোমাকে খুব মনে পড়ছে‘‘। নি¤œবিত্তের মেয়েদেও সব কথা ঢোক গিলতে হয়। ঢোক গিলতে হয় সকল অনুভূতিও।
ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা এমন কেন করবে? যারা আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা তাঁরাই হয়ে গেলো হন্তারক। বাইরের গুন্ডা মাস্তানতো আছেই, আছে হলের বড় আপুদের গ্যাং। অত্যাচার আর মানসিক টর্চার সইতে সইতে নূপুরেরা শক্ত হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে পরিপক্ক। নিজেকে বাঁচাবার পথ সে বের করে নেয়। সেই সাথে সমাজ ও দেশকে বাঁচাবার জন্যও তৈরি হয়। নূপুরের যেন ইতিবাচকভাবে বেড়ে উঠতে মন চায়, তেমনি বড় আপুদের গ্যাং সদস্যরা নেতিবাচকভাবে বেড়ে উঠার জন্য মনস্তাত্তি¡কভাবে তৈরি হয়। হলে উঠার তৃতীয় দিনে যখন বড় আপুরা ওড়না ফেলে দিয়ে কাপড় খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিল, সেদিনই বুঝেছিল কতটা পিশাচ মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে বড় আপুরা। অবস্থা যখন চরম খারাপের দিকে তখন চিৎকার করে সে বলেছিল

‘‘পরিবার পরিজন ছেড়ে এসেছি, অজানা এই শহরে পা দিয়েছি, অচেনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি অনেক স্বপ্ন নিয়ে। মনে আশা ছিল আপনাদের কাছে পাবো পরিবারের আশ্রয়, পাবো বড় বোনের আদর, পাবো বড় হওয়ার দিশা। আর আপনারাই আমাদেরকে ভেঙে মুচরে নেই করে দিচ্ছেন। প্রত্যেকটা জিনিসের একটা মাধ্যম থাকে।এতটুকু আশ্রয় ও নিরাপত্তা যদি আপনারা আমাদের না দেন তবে আপনারা কীসের সিনিয়র? এতটুকু বিশ্বাস যদি না রাখতে পারে জুনিয়ররা, তবে পরিবার ও রাষ্ট্র কী পাবে আপনাদের থেকে? আপনারা কেন ভুলে যাচ্ছেন যে আমরাও আপনাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ। রাগ, কষ্ট, বেদনার অনুভূতিগুলো আমাদেরও আছে?‘‘

এসব কথা শুনে সিনিয়ররা হাহাহা করে পুরো কক্ষ কাঁপিয়ে হেসে ওঠেছিল। এই নিয়ে ওকে আরও বেশি মানসিক ও শারীরিক টর্চার করেছিল। সেসবও সে ভুলে যেতে পেরেছে। ভুলে যেতে পেরেছে ক্লাসের মাদকাসক্ত রবিনের উগ্র বেফাঁস প্রেমালাপ। কারণ তরুণ প্রজন্ম বিপথে যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষকদের আচরণ সে ভুলতে পারে নি।
চেয়ারম্যান স্যারের ওয়েটিং রুমে বসে আছে নূপুর। কখন ডাক পড়ে কে জানে। কেন যে স্যার ডাকলো নূপুর চিন্তা করে খুঁজে পাচ্ছে না। আগের কয়েকবার যেরকম ঘটনা ঘটেছিল সেরকম কিছু হবে কি না। একবার ভেবেছিল সে কাউকে নিয়ে যাবে। কিন্তু স্যারতো একাই যেতে বললো। তাই অন্য কাউকে আসতে বলে নি। আর অন্য কেউ না আসাই ভালো। কিছু ঘটলেও সাক্ষ্য থাকে না। কারণ অন্য কারও সামনে কোনো অপ্রীতিকর কথা হলে, সেটা পুরো ইউনিভার্সিটি ছড়াতে কয়েকঘন্টার বেশি লাগবে না। কাউকে না নিয়ে একা দেখা করাই ভালো। বিষয়টা গোপন থাকে। তবে আজ নূপুর খুব শক্ত মনোবল নিয়ে এসছে। আগের মতো নেই। ম্যাচিওরড হয়েছে। মনে মনে ছক কষে নেয়, যদি কিছু অপ্রীতিকর বলে বা অসৌজন্যমূলক কিছু করার চেষ্টা করে তবে থাপ্পড় দিয়ে সে বেড়িয়ে আসবে।
এভাবেই প্রায় আধা ঘন্টা পার হয়ে যায়। কামাল স্যারের সভা শেষ হলে ওর ডাক পড়ে। রুমে গিয়ে সালাম দেয়। কামাল স্যার তাকে বসতে বলে। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের রুম অনেক বড়। বিশাল বড় টেবিল। টেবিলের সামনে তিনটি চেয়ার সুন্দর করে সাজানো। কামাল স্যার বসতে বলার পরে কোনটি বসবে ইতস্তত করতে করতে একটিতে বসলো। জড়োসড়ো অবস্থায় নূপুরের বসা। বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ সে শুনতে পাচ্ছে। ভেতরে ঢোকার আগে চেয়ারম্যানের পিএকে জিজ্ঞেস করেছিল ডাকবার হেতু কী। কিন্তু কোনো ক্লু দিতে পারে নি ব্যাটা।
চেয়ারম্যান কামাল স্যার খুব ব্যস্ত। টেবিলের নথিপত্র স্বাক্ষর শেষ করে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলছিলেন। হ্যাঁ নূপুর বলো, তোমাকে কেন যেন ডেকেছিলাম। নূপুরের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। তবু আস্তে করে বলে, স্যার, আমি জানি না।

কামাল স্যার হা হা করে হাসতে হাসতে থাকে। আরে আসলেইতো তুমি জানো না। তোমাকেতো জানানোই হয় নি। হাসির আওয়াজ পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। নূপুর ভয় পেয়ে যায়।
এরই মাঝে কামাল স্যার মুখ খুলেন। শুনো নূপুর। তোমাকে ডাকার কোনো বিশেষ কারণ নেই। তুমি হয়তো জেনে থাকবে যে, আমার দুটি মেয়ে। যমজ বোন ওরা। এখন অস্ট্রেলিয়াতে পড়ালেখা করে। দেশে আসেই না। ওখানেই নাকি স্যাটল হবে। তোমাকে দেখলেই আমার মেয়ে দুটির কথা মনে পড়ে। তুমি যখন হেঁটে যাও, মনে হয় আমার মেয়ে দুটি হেঁটে যাচ্ছে। তোমার মুখাবয়বে আমি আমার মেয়েদের দেখতে পাই। বলতে বলতে অশ্রæসজল হয়ে ওঠে কামাল স্যার। কান্না সংক্রমিত হয়। নূপুরের চোখও আবেগে ভিজে ওঠে। কামাল স্যার বলতে থাকে। কেবল দেখতে নয়, তোমার মেধা ও আচরণও আমার মেয়েদের মতো। তোমার বিষয়ে অনেক দিন যাবতই আমি খোঁজ রাখছি। প্রায় সকলেই তোমার উচ্চকিত প্রশংসা করে। কেবল দুএকজন শিক্ষক ছাড়া। ওদেরকে আমি রগে রগে চিনি। সুতরাং ওদের কথার কোনো মূল্য আমার কাছে নেই। তোমার ভাইভা আগামী পরশু দিন। কোনো দুশ্চিন্তা করো না। স্বতস্ফুর্তভাবে ভাইভা দাও। সব মিলিয়ে তুমিই আবার প্রথম হতে যাচ্ছো। এবং অনেক নম্বরের ব্যবধানে তুমি প্রথম হবে। যা এর আগে কোনো ব্যাচ পায় নি। আমি উপদেশ দিব তুমি অন্য কোথাও কোনো চাকুরির চেষ্টা করো না। সাময়িক কোথাও কাজ করতে পারো। বিভাগে যখন সার্কুলার হবে তখন আবেদন করিও। আমার সময়েই নিয়োগ হবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তোমাকে এখানে রাখার। ডিপার্টমেন্ট উপকৃত হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় আমার মনে হবে যে আমার মেয়েই আমার সামনে থাকছে। বলে ওঠে দাঁড়িয়ে নূপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
নূপুর বুঝতে পারে যে এই হাত আসলেই কোনো বাবার হাত। নূপুরের বাবাকে মনে পড়ে। যেন বাবার গন্ধটা নাকে এসে লাগে। পিতৃ¯েœহের হাতের স্পর্শ নূপুরকে বিহবল করে। সে স্যারকে পা ছুঁয়ে সালাম করে। দোয়া চেয়ে বের হয়ে আসে।

মনে মনে একটু লজ্জাও পায়। সে স্যারকে নিয়ে কী সব নেতিবাচক ভাবনা ভেবেছিল। অথচ আজ যেন স্বর্গীয় দূতের সাথে ওর দেখা হলো। আনন্দ ও উচ্ছাসের সাথে প্রচন্ড ভালোলাগা নিয়ে নূপুর ওর আবাসিক হলে ফিরে। সূর্যের প্রচন্ড তাপ যা তার অসম্ভব অসহনীয় সেটাও তার আজ ভালো লাগছে। ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকতে ইচ্ছে করছে না। রাস্তার ধুলিকণা বা ঝড়োহাওয়া সবই ওর কাছে ছন্দময় মনে হচ্ছে। কৃষ্ণচূঁড়ার রঙও আজ বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। পৃথিবীটা কত সুন্দর! পৃথিবীতে কত কত ভালো মানুষ আছে। আর আছে বলেই পৃথিবী এখনও বহমান।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart