Detail

Home - উন্নয়ন - নগর উন্নয়ন যাত্রায় মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা – ড. সফিকুল ইসলাম

নগর উন্নয়ন যাত্রায় মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা – ড. সফিকুল ইসলাম

একজন যাত্রী অফিসে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছে। হাতে সময় নিয়েই রওয়ানা হয়েছে। তবে রাস্তায় জ্যাম একটু বেশি, তাই খুব টেনশনে আছে সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারবে কিনা। স্কুলগামী বাচ্চা ও অভিভাবকদেরও অনুরূপ সমস্যা হয়। কিংবা বাচ্চাকে নিয়ে রিকশাতে বসে আছে একজন যাত্রী। পাশের গাড়িগুলো বা পেছনের বাস ট্রাক এত জোরে হর্ণ বাজাচ্ছে যে তা সহ্য করা খুবই কঠিন, বুক ধড়ফর করা অবস্থা। কিংবা অন্য এক নাগরিক নিকটাত্মীয় রোগীকে নিয়ে রওয়ানা হয়েছে হাসপাতালে। পথে পথে সিগনালে এমনভাবে আটকানো যে কোনোভাবেই রোগী নিয়ে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছানো যাবে কিনা এ উদ্বিগ্নতায় কাটে প্রতিটি ক্ষণ। কিংবা ফুটপাত ও রাস্তার এমন এবরোথেবরো অবস্থা যে সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ থাকতে হয় পথচারীদের। কখন যে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গে! তাছাড়া মোড়ে মোড়ে  বা চিপা গলিতে ছিনতাই বা নাজেহাল হওয়ার আতঙ্কও মনে রেখে পথ চলতে হয় নগরজীবনে। ওয়াসার পানি খেয়ে অসুস্থ হওয়া বা ব্যাক্টেরিয়া আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কাজ করে নাগরিকদের মনে। মশার উতপাতে জীবন জেরবার অবস্থা। ভেজাল খাদ্য, মেয়াদহীন ওষুধ নিয়ে সন্দেহে যাপন করতে হয় দৈনন্দিন কেনাকাটায়। টেনশন, উদ্বেগ, সমস্যা, বুক ধড়ফর, ভয়, আতঙ্ক সন্দেহ ইত্যাকার অনুভূতি নিয়েই নগরীর বাসিন্দারা দিন পার করে। যে কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরণের প্রভাব পড়ে। তথা সুস্থ মানুষগুলো অসুস্থ হয়ে যায় নগরীর অপরিকল্পিত পরিকল্পনা আর নগরবাসীর লাগামহীন ও মাত্রাজ্ঞানহীন আচরণের কারণে।

সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরীপে দেখা যায় যে দেশের প্রায় ৮ শতাংশ নাগরিক বিষন্নতার সমস্যায় ভূগছে। বিআিইডিএস এর গবেষণামতে নগরীর ৭০ শতাংশ মানুষ উদ্বিগ্নতায় আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল হেল্থ পার্সপেক্টিভ এর ভাষ্যমতে বায়ুদূষণের সঙ্গে বিষন্নতা, রাগ, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ ও আত্মহত্যার সম্পর্ক আছে। নগরীতে বায়ুদূষণ খুবই সাধারণ বিষয়। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকটি শহরের বাতাসে দূষণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক। এ লিস্টে ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েকটা নগরীও অন্তর্ভূক্ত। ডেনমার্কের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে,  দূষিত বাতাসে শ্বাস–প্রশ্বাস গ্রহণকারীদের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, আবেগজনিত মানসিক সমস্যা- বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারের আধিক্য বেড়ে যায়। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। এবং দূষিত বাতাসের কারণে বেড়ে যায় খিঁচুনির মাত্রা। অপরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা ও এ প্রেক্ষিতে নাগরিকদের জীবনাচরণ যেভাবে চলছে, তাতে নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য নানানরকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়। যেমন প্রচলিত মানসিক অসুস্থতার মধ্যে এডিএইচডি (শৈশবের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ব্যাধিগুলোর মধ্যে একটি), দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, অটিজম, মাদক ব্যবহার, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার, হতাশা, বিষণ্নতা, খাওয়ার ব্যাধি বা ইটিং ডিজঅর্ডার, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, আচরণ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া। এরকম মানসিক ব্যাধিগুলো নগরীর মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান একটি প্রবন্ধে বলেন যে ‘নগর পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছিলো অষ্টাদশ শতাব্দীতে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের ফলে। তাই জনস্বাস্থ্যের সাথে নগর পরিকল্পনা ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। এছাড়াও জনস্বাস্থ্য কেবল স্বাস্থ্যগত ধারণা কিংবা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। নাগরিকদের জীবনমানের সার্বিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার সাথেও সরাসরি যুক্ত।’

যে কোনো মহামারী আসলেও নগরীর শিশু ও নারীদের ওপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। ইউনিসেফ, সেভ দ্যা চিলড্রেন এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের ভাষ্যমতে দেশের নগরীগুলোর শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলছে মহামারী। কোভিড বা যে কোনো ক্রাইসিসে শিশুরা স্কুলে বা খোলা প্রান্তরে যেতে পারে না। যে কারণে ক্রীড়া  বা ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি কম হয় বাচ্চাদের। সারাক্ষণ মোবাইল বা টিভিতে আসক্ত থাকে। যেকারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে  এবং শিশুদের স্বাভাবিক মনোদৈহিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের নগরীগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে শিশুদের খেলার জন্য মাঠ নেই, বড়দের ঘুরার জন্য পর্যাপ্ত পার্ক নেই। কর্মস্থল ও বাসায় আসা-যাওয়ার একঘেঁয়েমির জীবন অবসাদগ্রস্ততা বাড়িয়ে দেয়।

হালে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। শীতকালে শীত নেই, কিংবা গরমকালে গরম নেই। শীতকালে শীত আসে দেরিতে, বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই, শীতের শুরুতে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। মানবশরীর এ ধরণের পরিবর্তনকে নিতে পারে না। জলবায়ুর এসব পরিবর্তন প্রকৃতিতে, ফসলাদিতে, নাগরিকদের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের লোভ যেমন আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সংকটে ফেলে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলোও মানসিক স্বাস্ব্যের সংকটকে আরও ঘণিভূত করে।

করণীয় কী

নগরবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতগুলো বিশ্লেষণ করলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে টেকসই নগর পরিকল্পনা প্রণয়নসহ স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন, বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সুষ্ঠু প্রয়োগ, জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহণ কাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সমতা বিধানের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থসেবা প্রদান, কঠিন ও পয়ঃবর্জ্য পরিকল্পনা তথা টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা অনুশীলন প্রয়োজন।

উন্নত বিশ্বের সকল প্রেসক্রিপশন হুবহু অনুসরণ না করে দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দরকার। যেমন নেদারল্যান্ড ও ভেনিসে যেমন জলপথের যোগাযোগ ও পরবহণ ব্যবস্থা টেকসই করতে সফল হয়েছে। জলপথ থাকা মানে কেবল সড়কের যানজটই কমায় না, পরিবেশের উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের নগরীগুলোর খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করা ও খালের দুপাশে সবুজায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। তাছাড়া কারখানা বা বৃহদায়তনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক উপায়ে সম্পন্ন করতে সচেতন করার পাশাপাশি কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাধ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি মূলত একটি নগরীর বায়ূদূষণের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। যেসব বিষয় বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, সেগুলোর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো আর তা থেকে নিজে দূরে থাকা এবং অপরকে দূরে রাখার চেষ্টা করা। নগরীর কাছাকাছি ধোঁয়া সৃষ্টি হয় এমন অবকাঠামো না থাকা, যেসব যানবাহন বাতাসকে দূষিত করে, সেগুলোর চলাচল বন্ধ রাখা, নগরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রিন জোন রাখা, উদ্যান আর গাছপালার ব্যবস্থা থাকা দরকার। নাগরিকগণ ব্যক্তিজীবনে কিছু ম্যানারিজম পরিবর্তন করে নগরজীবনে অভ্যস্ত হওয়া জরুরি। যেমন রাস্তাঘাটে ট্রাফিক নিয়ম মানা, অন্যদের বিরক্তি ও কষ্টের কারণ হয় এমন কোনো কাজ না করা, রাস্তাঘাট বা উম্মুক্ত স্থান দখল না করা, গৃহস্থালি বা ব্যক্তিগত বর্জ্যকে বিভাজন করে যথাযথভাবে নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলা। ব্যবসায় কমিউনিটি জনস্বাস্থ্যের হানি হয় এমন কোনো পন্য বা সেবা উতপাদন ও বিক্রির সাথে জড়িত না হওয়াও দরকার।

আর ব্যক্তিপর্যায়ে যে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, তা হলো ঘরের ভেতরটা যাতে বাতাস চলাচলের উপযোগী থাকে, সেই ব্যবস্থা করা, বেশি করে গাছ লাগানো, বাতাসকে দূষিত করে এমন যেকোনো কাজ থেকে দূরে থাকা (কয়লা পোড়ানো, যানবাহনের নিয়মিত যত্ন নেওয়া, যাতে কালো ধোঁয়া তৈরি না হয়), সাধারণ মাস্কের বদলে বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা, প্রয়োজন না থাকলে দূষিত বাতাসে বেশি না বেড়ানো। আর দূষিত বাতাস বা যেকোনো কারণে যদি কারও মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ (কমপক্ষে ২ সপ্তাহ ধরে মন খারাপ, কোনো কাজে উৎসাহ না পাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ভুলে যাওয়া, কান্না পাওয়া, আত্মহত্যার প্রবণতা, শরীরে ব্যথাসহ নানা উপসর্গ) দেখা দেয়, তবে সেটিকে হেলা না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াটা জরুরি।

নগর পরিকল্পনায় ও উন্নয়ন যাত্রায় নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সকল প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তবায়ন করলেই কেবল সুস্বাস্থ্য বান্ধব নগরী আমরা পেতে পারি।

ড. সফিকুল ইসলাম

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন)প্র্যাক্টিশনার

(জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ  ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন।)

published in jugantor ড. সফিকুল ইসলাম

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/jugantor-24-anniv/641937/%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart