Detail

Home - আর্টিকেল/কলাম - নদী, প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতির খেলা -ড. সফিকুল ইসলাম

নদী, প্রাণ ও প্রকৃতি নিয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতির খেলা -ড. সফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা কতটি? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর ঠাহর করা কঠিন। নদী গবেষণা ইন্সটিটিউট, পানি ‍উন্নয়ন বোর্ড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় দৈনিক কিংবা সরকারের নানা প্রতিবেদন একেক জায়গায় একেকরকম তথ্য। কেউ বলে ২৩০টি, কেউ বলে ৭০০/৮০০টি। কারও মতে হাজারের বেশি, কেউ বলে দুই সহস্রাধিক। নদীর সংখ্যা যাই হোক, নদীর অবস্থা যে আর ভালো নেই- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ”গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন দরকার’’ স্লোগানের আড়ালে উন্নয়নের নামে অনাচার বেশি হয়েছে। যার প্রমাণ আমাদের নদীগুলো ও এদের ঘিরে প্রাণ প্রকৃতির যে বিপর্যয় হয়েছে তা অবর্ণনীয়। গণঅভ্যূথ্থানের চব্বিশ বছরপূর্তির এ দিনে আমরা যদি ভাবি কেমন বাংলাদেশ চাই না, তবে বলবো নদীকে ঘিরে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক খেলা চলে তা চাই না। নদী, প্রাণ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সুরক্ষা বিঘ্নিত করে এমন কোনো পরিকল্পনা ও কর্ম চাই না।

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। নদী, বৃক্ষ, আকাশ, পাহাড়, পশুপাখি—সবই আমাদের অস্তিত্বের গভীর অংশ। শুধু শারীরিক টিকে থাকার জন্য নয়, মানসিক, বৌদ্ধিক এবং দার্শনিক উন্নয়নের জন্যও প্রকৃতির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের নানা রচনায় প্রকৃতি এক গভীর জীবনচেতনার উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।প্রকৃতি মানুষের প্রথম পাঠশালা। আমরা পৃথিবীতে এসেই যাকে প্রথম দেখি, তার গন্ধ নিই, তার ছোঁয়ায় বড় হই—সে হলো প্রকৃতি। দার্শনিক হাইডেগার বলেছিলেন, “To dwell is to be in nature.” অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া মানেই বসবাসের অর্থ খুঁজে পাওয়া। প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলে মানুষ কেবল বসবাস করে, বেঁচে থাকে না।

নদী শুধু জলের প্রবাহ নয়; এটি জীবনের ধারক ও বাহক। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় “সৃষ্টির উচ্ছ্বাস”, আর জীবনানন্দ দাশের চোখে “নীরব নান্দনিকতা” হয়ে নদী আসে। “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে”—এই এক পংক্তিতে তিনি নদীকে জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্মৃতি হিসেবে আঁকেন। নদীকে সাহিত্যে কেবল প্রকৃতির এক উপাদান হিসেবে নয়, সময় ও চেতনাশক্তির এক জীবন্ত প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তিনি স্মৃতির, সময়ের এবং চেতনাহীনতার এক গভীর আবেশ তৈরি করেন। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন ’’জীবন আটকে থাকার জিনিস না, জীবন হচ্ছে নদীর মতো প্রবাহমান। সে তো ছুটতেই থাকবে।❞ প্রাণ মানে কেবল শ্বাসপ্রশ্বাস নয়। প্রাণ মানে সম্পর্ক, সহানুভূতি, ও সমবেদনা। মুনীর চৌধুরী তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন, “প্রাণহীন সভ্যতা আসলে মৃত সভ্যতা।” আমাদের শহুরে যান্ত্রিক জীবনে প্রাণের অভাব প্রকৃতির অভাবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রকৃতি কেবল বস্তুজগত নয়, এটি নৈতিকতা ও জীবনের দিকনির্দেশনা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতিকে দেখেছেন ঈশ্বরের আয়নায়। তাঁর চিন্তার জগৎ গঠনে প্রকৃতি ছিল আত্মদর্শনের মাধ্যম। “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে তিনি সতর্ক করেছিলেন—প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়, সভ্যতা তখন হিংসা ও ধ্বংসের পথে চলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিঠিপত্র’-এ উল্লেখ করেছেন, প্রকৃতি তাঁর ‘দ্বিতীয় আত্মা’। শান্তিনিকেতনে বসে তিনি দেখেছেন, কীভাবে গাছের ডালে, পাতার ছায়ায়, পাখির ডাকে ঈশ্বর কথা বলেন। “Where the mind is without fear” কবিতায় তিনি যে ‘heaven of freedom’ কল্পনা করেন, তা প্রকৃতি ও নৈতিকতার নিখুঁত সংমিশ্রণ। বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় কবি আলমাহমুদের কবিতায় ও লেখক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে প্রকৃতি এসেছে জীবনের প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে।

আর বিশ্ব সাহিত্যে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিজম প্রকৃতিকে দিয়েছে গভীর প্রতীকী রূপ—যেখানে বৃক্ষ, নদী, বৃষ্টি সব কিছুই জীবন্ত চরিত্রের মতো কথা বলে। বিশ্বসাহিত্যে আরও দেখা যায় যে, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের রচনায় প্রকৃতি মানসিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যম। তাঁর ’Lines Composed a Few Miles Above Tintern Abbey’-এ প্রকৃতিকে দেখা হয় আত্মার আশ্রয় হিসেবে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতিকে বলেছেন “the anchor of my purest thoughts” । তাঁর মতে, প্রকৃতি মানুষকে অহং থেকে মুক্ত করে, আত্মাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। প্রকৃতি সেই নিরব শিক্ষক, যে কোনো শব্দ না বলে মানুষকে চেতনার উচ্চতর স্তরে পৌঁছে দেয়। হারমান হেসে’র উপন্যাস Siddhartha-তে নদী মানুষের আত্মোদ্ধার ও আত্মোপলব্ধির প্রধান অনুষঙ্গ। সেখানে নদী কথা বলে, শিক্ষা দেয়, চুপ করে থেকেও জীবন ও মৃত্যুর ব্যাখ্যা দেয়। দার্শনিকভাবে, নদী ও প্রকৃতি সময়ের চক্রের প্রতীক। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, “You cannot step into the same river twice.” অর্থাৎ নদী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, ঠিক আমাদের জীবনচক্রের মতো। এই রূপান্তরের মাঝে রয়েছে এক শাশ্বত সত্য—প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কিছুই নয়।

আজকের বিশ্বে মানুষের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে একধরনের অস্তিত্বগত শূন্যতা। এলিয়ট-এর “The Waste Land”-এ আমরা দেখি, কীভাবে শিল্পায়ন আর যান্ত্রিক সভ্যতা এক রুক্ষ, নিষ্প্রাণ পৃথিবীর ছবি আঁকে। এই ‘নির্জীব ভূমিতেই প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে। মানুষের পরিচয় তার ভাষায়, পোশাকে বা প্রযুক্তিতে নয়—তার প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কেই নিহিত। নদীর প্রবাহে, গাছের ছায়ায়, পাখির কূজনে মানুষ তার আত্মাকে খুঁজে পায়। দার্শনিক থিচ নাত হান বলেছেন, “We are here to awaken from the illusion of separateness.” এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে, প্রকৃতির সঙ্গে পুনরায় একাত্ম হওয়াই আজকের মানবজাতির প্রধান দায়িত্ব। আধুনিক বিশ্বে যখন জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা, প্রাণীদের বিলুপ্তি, বন উজাড়ের মতো সংকট ক্রমবর্ধমান, তখন নদী ও প্রকৃতির গুরুত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করা জরুরি। ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, “Nature is the soul of civilization.” এই আত্মা যদি ক্ষয় হয়, মানবসভ্যতার অস্তিত্বও বিপন্ন হয়।

অতএব, নদী, প্রকৃতি ও প্রাণ শুধু টিকে থাকার উপাদান নয়; এরা অস্তিত্বের দর্শন। এদের ছাড়া জীবন ম্লান, সাহিত্য নিষ্প্রভ, আর সভ্যতা নির্বাক। মানুষ প্রকৃতিকে রক্ষা করে না, বরং প্রকৃতি মানুষকে রক্ষা করে- এই উপলব্ধিই আমাদের বাঁচার পথ।

এরকম দার্শনিক ও সাহিত্যিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে কী অবস্থা? বাংলার প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, ও মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপুরি নদী নির্ভর। নদীকে ঘিরেই উজ্জীবিত আমাদের কৃষি সেক্টর যার উপর দেশের সব মানুষের জীবন ধারণ নির্ভরশীল। নদীর গতিপথ বন্ধ করে কারা? নদীর নাব্যতা নষ্ট করে কারা? বালু তুলে কারা, অপরিকল্পিত বাঁধা নির্মান করে কারা? বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নামে ঠিকাদারি ব্যবসা করে কারা? যত্রতত্র শিল্পায়ন করে কারা? নদী দখল করে কারা? নদীতে বর্জ্য ফেলে কারা? কৃষি জমিতে সার কিটনাশক ব্যবহারের পেছনে থাকে কারা? যার কারণে নদীর পানি দুষিত হয় ও নদীর প্রাণ ও প্রকৃতি বিনষ্ট হয়। এরকম আরও হাজারটা প্রশ্ন করা যাবে। উত্তর কিন্তু একটিই। ক্ষমতাবান এলিট। রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক, পেশাভিত্তিক এলিটরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আর তারাই এসব নদী দুষণ, ও নিয়ন্ত্রণের মূল ভূমিকায় থাকে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে ও কখনো পরোক্ষভাবে। এদের কর্মই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, পরিবেশের ভারসাম্য ও ইকোসিস্টেম ভাঙে আর নদী সঙ্কটে পড়লে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়ে।  গণঅভ্যূথ্থানের মূল আকাঙ্খা ছিল একটি সুন্দর অনাচারমুক্ত দেশ গড়া যেখানে নদী, প্রাণ ও প্রকৃতি টেকসই হবে। পরিবেশবান্ধব নীতিমালা হবে, জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা আধুনিক হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হবে ও এ সেক্টরে সুশাসন ও জনসচেতনতা বিরাজ করবে।

অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখি? শিল্প ও কলকারখানা মালিকরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিবেশ আইন অমান্য করে কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলেন। প্রশাসন খুব কমই নজরদারি করতে পারে বা করলে কাগজে-কলমে ‘সব ঠিক আছে’ বলে দেখায় বা দেখাতে বাধ্য হয়। যেমন, বাংলাদেশের টঙ্গী ও সাভার এলাকায় ট্যানারী শিল্পের বর্জ্য তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা বছরের পর বছর এসব দূষণ চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা নদীর পাড়ে অবৈধ দখল করে মার্কেট, কারখানা বা বাড়ি নির্মাণ করেন। প্রশাসন এসব দেখে না, কারণ দখলকারীরা ক্ষমতাসীন (যে দলই ক্ষমতাই থাকুক) দলের সমর্থিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,  বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাড়ে বহু অবৈধ স্থাপনা ছিল ও আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে গড়ে উঠেছিল। অনেক কোম্পানি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ETP) বসানোর কথা থাকলেও খরচ বাঁচাতে তা করে না। বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার বহু গার্মেন্টস কারখানা শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীতে রং ও রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে। নদীর ধারে জমি দখল করে আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠে। কর্পোরেট সংস্থা ও প্রভাবশালীরা এই জমি নিজেদের দখলে নিতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে। ঢাকার পূর্বাংশে নদী ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠায় বৃষ্টির পানি নদীতে পৌঁছাতে পারে না—ফলে জলাবদ্ধতা বাড়ছে, নদীও মরে যাচ্ছে। নদী রক্ষার আইন ও আদালতের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেগুলোর প্রভাব পড়ে না। কারণ, সরকার নিজেই কখনো কখনো নদী দখলকারীদের পক্ষ নেয়। বাংলাদেশে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৯ সালে ‘নদীকে জীবিত সত্তা’ ঘোষণা করা হলেও, এরপরও দখল-দূষণ বন্ধ হয়নি। সাধারণ জনগণও নদী দূষণে অংশ নেয়—প্লাস্টিক, ময়লা ফেলে, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না রেখে নদীতে স্যুয়ারেজ দেয়। এছাড়া, নাগরিক সমাজ অনেক সময় নদী রক্ষায় সচেতন আন্দোলন করে না বা করে রাজনৈতিক চাপের মুখে মুখ বন্ধ করে। নদী দূষণ মূলত ক্ষমতা, পুঁজির দখল ও প্রশাসনিক দুর্বলতার ফল। রাষ্ট্র, কর্পোরেট, রাজনীতি ও নাগরিক সমাজ—সবার সমন্বিত দায়িত্ব না থাকলে নদী বাঁচানো সম্ভব নয়। নদীকে বাঁচাতে হলে চাই শক্তিশালী পরিবেশ আইনের বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সচেতন নাগরিক সমাজের সোচ্চার ভূমিকা।

প্রকৃতি ও প্রাণ সুরক্ষা না করা বা বিনষ্ট করার পেছনে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণি বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও পেশাজীবী এলিটরা বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকৃতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়, যেখানে সাধারণ মানুষের মত, অধিকার বা পরিবেশগত ভারসাম্যের কথা তুচ্ছজ্ঞান করা হয়। রাজনৈতিক এলিটদের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকট আকার ধারণ করেছে। নদী ও বন দখলে এলিটরা মদদ দিয়ে থাকে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের দলীয় কর্মী বা ব্যবসায়ীদের অবৈধভাবে নদীর পাড়, জলাভূমি, বনভূমি দখলে সহায়তা করে। পুলিশ-প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে আইন প্রয়োগ থেকে বিরত রাখে। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে প্রভাবশালীদের দখলকৃত মার্কেট ও গুদাম দেখা যায়। আবার সুন্দরবনের আশেপাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাজনৈতিক সমর্থন সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই দেখা গেছে।  উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ধ্বংস রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের রাজনীতির কারণে অবৈজ্ঞানিক বা অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, যা প্রকৃতি ও মানুষের ক্ষতি করে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প—UNESCO’র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সুন্দরবনের কাছেই বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন করা হয়েছে। ব্যবসায়িক এলিটদের লোভ ও পরিবেশ ধ্বংস হওয়া একসূত্রে গাঁথা। পরিবেশ আইন উপেক্ষা করে শিল্প স্থাপন বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী ইচ্ছেমতো কারখানা গড়ে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম নিয়ম না মেনে বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ করে। সাভারের ট্যানারি শিল্প—বর্জ্য শোধনাগার (ETP) চালু না রেখে হাজার টন বিষাক্ত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলার ঘটনা চোখের সামনেই ঘটছে। রিয়েল এস্টেট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জলাভূমি ধ্বংস ও আবাসন ব্যবসায়ীরা নদী বা বিল-জলাশয় ভরাট করে হাউজিং প্রকল্প গড়ে তোলে। এর ফলে প্রাকৃতিক জলাধার হারায় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।  ঢাকার পূর্বাচল ও উত্তরা সংলগ্ন এলাকায় প্রকৃতির দাম দিয়ে গড়ে ওঠা প্রকল্পের কথা সবাই জানে।  সামাজিক এলিটদের নিঃশব্দ সহযোগিতা ও সুবিধাভোগ করে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছেলেমেয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলে জড়িত রয়েছে। বিচারক, আমলা, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিবারের সদস্যরাও প্রভাব খাটিয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। বনানী ও গুলশানের প্রভাবশালীদের ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাশয় দখল করে কংক্রিট স্থাপনা নির্মাণ করে।  সমাজের নিরবতা ও মুখোশধারী দায়িত্ববোধ প্রথার কারণে এসব বেশি ঘটে। এলিট শ্রেণি অনেক সময় নিজেদের সুবিধার জন্য প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। বরং উন্নয়নের বুলি কপচিয়ে প্রকৃতি বিনাশে মৌন সম্মতি দেন। পেশাজীবী এলিটদের (আমলা, প্রকৌশলী, আইনজীবী) দায়িত্বহীনতা কারও নজর এড়ানোর কথা নয়। প্রকল্প অনুমোদনে দুর্নীতি ও অজ্ঞতা বিরাজমান। প্রকৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অর্থের বিনিময়ে বা রাজনৈতিক চাপে পরিবেশ ছাড়পত্রসহ  প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে দেন। নদী ভরাট করে সড়ক নির্মাণ, পাহাড় কেটে আবাসন প্রকল্প হয় যেগুলোতে প্রকৌশলীরা “ভুল রিপোর্ট” দেন। বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব বা অংশগ্রহণ আমাদের জাতীয় জীবনের কলঙ্ক। পরিবেশ মামলাগুলো বিচার বিভাগে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, অনেকে প্রভাবিত হয়ে ভুল রায় দেন বা প্রভাবশালী পক্ষকে রক্ষা করেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সকল শ্রেণির এলিটরাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকৃতি ও প্রাণকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাদের নৈতিক অবক্ষয়, লোভ ও দায়িত্বহীনতাই জলবায়ু পরিবর্তন, নদী দূষণ, বন নিধন এবং প্রাণী প্রজাতি ধ্বংসের মূল কারণ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দরকার শক্তিশালী পরিবেশ আইন ও এর কঠোর প্রয়োগ, নাগরিক সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, এলিট শ্রেণির জবাবদিহিতা।

এ দেশ যদি নদীশূন্য হয়ে যায়, তখন কী অবস্থা হবে? নদী না থাকলে মানুষও থাকবে না- এ বোধ আমাদের দরকার। নদী আমাদের শরীর, নদী আমাদের প্রাণ, এর হাত ধরেই বাংলার মানুষ বাঁচতে শেখে। এই নদী শুধু জল বহে না, বহে মানুষের আশা, বহে মানুষের স্বপ্ন। আমরা যখন প্রকৃতিকে হত্যা করি, তখন আমরা নিজেদেরই হত্যা করি।

নদী, প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ থাকবে, নদী দূষণ রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ হবে, নদী ভাঙনরোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হবে, জলবায়ু পরিব্তন মোকাবেলায় গবেষণা বৃদ্ধি পাবে, টেকসই কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন হবে- এমনটাই জনতা চায়।  একটি সত্যিকারের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে যেখানে নদীর জল স্বচ্ছ, প্রাণীর জীবন নিরাপদ, প্রকৃতি থাকবে সুস্থ। যেখানে উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ একসাথে চলবে। যেখানে নদী বাঁচবে, প্রাণ বাঁচবে, আর মানুষ বাঁচবে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এর ব্যত্যয় হয়- এমন বাংলাদেশ আমরা চাই না। তাছাড়া সীমান্ত নদীর পানি বিভাজন নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে হুজুর হুজুর করা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা চাই না। নদী ভাঙ্গন ও নদী দখলে জড়িত এলিটদের সাথে নতজানু আচরণ করার যে সমাজ, সে সমাজ আমরা চাই না। অবৈধ শিকার ও বন্যপ্রাণী পাচার, বনাঞ্চল দখল ও জীববৈচিত্র্য নীতিকে অবহেলা করে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তা আমরা চাই না।

.

(লেখাটি ‘এবং বই এর নদী সংখ্যায় প্রকাশিত, জুলাই অভ্যূথান সংখ্যায় প্রকাশিত ও অদ্বৈত মল্লবর্মন কবি সম্মেলন সংখ্যা ২০২৫ এ প্রকাশিত)

.

লেখক ও গবেষক, সরকারের উপসচিব, Shafiq.bcs@gmail.com

(দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন: রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন)

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart