নাগরিক সেবায় হয়রানি ও অভিযোগের প্রতিকার
সরকারি দপ্তরে নাগরিকরা গেলেই সরকারি কর্মচারিগণের একটি বড় অংশ কিছুটা বিরক্ত হন। সময়মতো যথা আচরণের সাথে যথাযথ সেবা দেন না। কেউ কেউ হয়রানি করেন। আমাদের অনেকেই ভুলে যান যে, নাগরিকরা সেবা নিতে আসে বলেই আমাদের এ অফিস। নাগরিকদের সেবা লাগবে বলেই এ দপ্তর খোলা হয়েছে। এ দপ্তর খোলা হয়েছে বলেই আমাদের পদটি সৃজন হয়েছে। আর আমরা চাকুরি করছি। যদি নাগরিকদের সেবা না লাগতো, যদি নাগরিকরা না আসতো, তবে এ অফিস, এ পদ বা আমার চাকুরি কিছুই সৃষ্টি হতো না। আমারও কপালে এ পদ জুটতো না। সেদিক থেকে ভাবলে নাগরিক আমাদের লক্ষী, নাগরিক আমাদের ভাগ্য, নাগরিক আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের চাকুরির ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধির বাণী স্মর্তব্য- ‘‘নাগরিকরা আমাদের সরকারি দপ্তরে আসা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আগন্তুক। তারা আমাদের উপর নির্ভরশীল নয়, আমরা তাদের উপর নির্ভরশীল। তারা আমাদের কাজের বাধা বা বিরক্তি নয়, তারাই আমাদের কাজের উদ্দেশ্য। সে আমাদের কাজের বাইরের কেউ না, তারাই আমাদের কাজের অংশ। তাদেরকে সেবা দিয়ে আমরা কোনো ফেবার করছি না তাদেরকে, বরং তারাই সেবা নিয়ে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করছে।‘‘ এরকম মনোভাব নিয়েই আসলে আমাদের সরকারি কর্মচারিদের সেবা প্রদান করা উচিত।
.
আমরা প্রত্যেকেই যখন অন্য অফিসে সেবা নিতে যাই, তখন আশা করি যে অফিসের নির্ধারিত সকলে আমাকে স্বাগত জানাবে, প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিবে, প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণে বা দরখাস্ত লিখতে সহযোগিতা করবে, এবং দ্রুততম সময়ে নির্ধারিত ফি নিয়ে গুণগত মানসহ সেবাটি প্রদান করবে। এটা আমরা প্রত্যেকেই অন্য অফিসে গেলে আশা করি। এরকমভাবেই সেবা পেতে চাই। অথচ সেই আমিই যখন সরকারি কর্মচারি, সেবা প্রদানের দায়িত্বে থাকি, তখনই আমাদের স্বরূপ বদলে যাই। আমরা তখন স্বাগত না জানিয়ে বিরক্ত হই, প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে গড়িমসী করি, প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ বা দরখাস্ত লিখতে দালালদের কাছে পাঠাই, আর নির্ধারিত ফি‘র চাইতে বেশি ফি নিই, আর সময়ক্ষেপণে বিশ্বরেকর্ড করি। ‘‘আমরা অন্যের কাছে যেরকম আচরণ আশা করি, সেরকম আচরণ আমাদের করা উচিত‘‘ বাণীটির মতোই বলতে চাই যে, অন্য অফিসে গেলে আমরা যেরকম মানের সেবা যেভাবে আশা করি, সেরকম মানের সেবা সেভাবেই আমাদের দেওয়া উচিত, যখন আমরা সেবা প্রদানের দায়িত্ব পাই। আমাকে কেউ হয়রাণি করলে, উপরির জন্য চাপ দিলে, সেবা মানসম্মতভাবে না দিলে যেমন আমরা কষ্ট পাবো, তেমনই আমরা যখন নাগরিকদেরকে সেবা যথাযথভাবে দেবো না তখন নাগরিকরাও সেরকম কষ্ট পাবে। আপনি আচারি অপরকে শেখাও ধর্ম পালন করা আমাদের জন্য জরুরি।
.
সরকারি সেবা সহজীকরণের জন্য সিটিজেন চার্টার করা হলো। সিটিজেন চার্টার প্রতিটি দপ্তরের ওয়েবসাইটে, অফিসের সম্মুখের বড় সাইনবোর্ডে ও প্রত্যেক দপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার সামনে সাটানো থাকে। সিটিজেন চার্টারে স্পষ্ট লেখা থাকে কী কী সেবা দেওয়া হবে, সেবার জন্য কী কী ডকুমেন্ট লাগবে, কতদিন লাগবে, কত ফি লাগবে ও কার কাছ থেকে সেবা পাওয়া যাবে। সবকিছু লেখা থাকার পরেও সব অফিসে সিটিজেন চার্টার থাকার পরেও, সিটিজেন চার্টারের গল্প গল্প ও ফলপ্রসুতার কথা বারংবার প্রচারিত হওয়ার পরেও এর সত্যিকারের ব্যবহার ও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রথমত যারা সরকারি কর্মচারি তারা এটি কাগজে কলমে লিখলেও অন্তরে আত্মস্থ করছেন না। করলেও বাস্তবে ব্যবহার করছেন না। অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানান আইনী বা বিধিগত বা প্রথাগত সীমাবদ্ধতার জন্য পারছেন না। আবার অফিসের কতিপয় কর্মচারি সেবা দেওয়ার জন্য ইতিবাচক হলেও কতিপয় ব্যক্তি ইতিবাচক নন। গোটা কয়েক লোকের জন্য সেবার গতি ধীর হচ্ছে বা আটকে যাচ্ছে। সরকারি সেবা প্রদানের জন্য একটি চেইন বা সোপান কাজ করে। কয়েকজন সহযোগিতা না করলে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না, অনুমোদন পর্যায়ে পৌঁছায় না। সঙ্গতকারণে সত্যিকার সেবা প্রদান অনেক অফিসার চাইলেও নিশ্চিত করতে পারে না। আবার অন্যদিকে নাগরিকরাও পড়ে শুনে বুঝে সিটিজেন চার্টার অনুসারে সেবা প্রাপ্তির আবেদন করছেন না। নাগরিকরা ধরে নিয়েছেন ওসব নিয়ম টিয়ম পড়ে কিছু হবে না। লোক না ধরলে, বড় স্যার না ধরলে, দালাল না ধরলে কাজের কাজ হবে না। বরং নথি বা আবেদন মাসের পর মাস ফেলে রাখা হবে। সুতরাং ধরো তক্তা মারো পেরেক এর মতোই তারা লোক ধরে নগদে কাজ চান। তাদের মনে দীর্ঘ বছরে বিশ্বাসের প্রলেপ জন্মেছে যে, তারা নিয়মের লাইনে সেবা মিলবে না, পোকা বাছাই চলবে, খুত ধরা হবে, হয়রানি বাড়বে ও ঘুরান্তি হবে। বরং শটকাট লাইনে লোক ধরলে কেল্লা ফতে।
.
সেবা না পেলে জনগণ যেন অভিযোগ করতে পারে, প্রতিকার চাইতে পারে সেজন্য সরকার জিআরএস.গভ.বিডি ওয়েবসাইটে প্রতিকার ব্যবস্থা বাতলে দিয়েছে। কিন্তু এতে নাগরিকরা অভিযোগ করে কিনা কিংবা এসব অভিযোগ করার পরে প্রতিটি দপ্তরের প্রত্যেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এটির নিয়মিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও এটির এপিএতে নম্বর প্রদান করা হয়, এবং প্রতিমাসে অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রতিবেদন প্রদান করতে হয়, সেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা তা নিষ্পন্ন করেন। নাগরিক সন্তুষ্ট না হলে আপীল করতে পারেন। যদিও সিস্টেমে সেবাটি প্রদান করতেই হয়, অভিযোগটি নিশ্চিত করতেই হয়, তবু অভিযোগ যার নামে করা হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- এমন উদাহরণ খুব কম। হয়তো সেবাটি দেওয়ার মতো হলে সেবাটি দ্রুত প্রদান করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়, কিন্তু শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার রেওয়াজ সচরাচর নেই। যদিও বিদ্যমান চাকুরির বিধানে অভিযোগ নিষ্পত্তি না করলে বিভাগীয় মামলা রুজু করার নিয়ম আছে, বাস্তবে এর কঠোর ব্যবহার করা হচ্ছে না। নাগরিকরাও আগের দীর্ঘ হতাশার স্মৃতি থাকার কারণে সহজে অভিযোগ করতে চায় না। অভিযোগ করে কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে চায় না, বরং এড়িয়ে যা। ‘‘কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না‘‘ বিশ্বাস নিয়ে এড়িয়ে যায়। সুন্দর একটি সিস্টেম দাঁড় করানো হয়েছে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু এটার সত্যিকার ব্যবহার ও প্রভাব নাগরিক সেবায় তেমনটা পড়ে নি। সামান্য প্রভাব পড়লেও যে মাপের ও মানের প্রভাব পড়ার কথা , সেরকম ইমপ্যাক্ট দেখা যায় নি। আমি মনে করি উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিটি খুবই ভালো। এটি বিশ্বমানের, এবং প্রকৃত ব্যবহার হলে সত্যিকার অর্থেই নাগরিক সেবায় হয়রাণি ও দুর্নীতি বন্ধ হবে।
