Detail

Home - উন্নয়ন - প্রবন্ধ: ’অগ্নিকান্ড: কায়দা করে দায় এড়িয়ে ফায়দা কী’ – সফিকুল ইসলাম

প্রবন্ধ: ’অগ্নিকান্ড: কায়দা করে দায় এড়িয়ে ফায়দা কী’ – সফিকুল ইসলাম

অস্ট্রেলিয়াতে ইউনিভার্সিটির বিশাল বিশাল ভবনে আমরা গবেষণাকাজে ব্যস্ত থাকতাম। কেউবা ক্লাসে বা সেমিনারে। হঠাৎ করে রুমের ভিতর অগ্নিকান্ডের সাইরেন বেজে উঠলে সবাই দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতো। রাস্তায় ও আঙ্গিনায় অনেক মানুষের ভিড়। পরে জানা যেতো এটা এমনিতেই নিয়মিত চেকাপ। দেখা হয় সকল রুমে সাইরেন বাজে কিনা ও সবাই বের হয় কি না। তবে মাঝে মধ্যে সামান্য স্মোক বা ধোঁয়া দেখা গেলেও এরকম সাইরেন অটো বেজে উঠতো। সবাই তখন বের হয়ে যেতো। ওই নির্ধারিত রুমের আগুন বা ধোঁয়া দ্রুতই নেভানো হতো। অন্য কারও ক্ষতি হতো না। জাপানেও এমনটা দেখেছি যে প্রতিটি স্কুল , কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে অগ্নিকান্ড ও ভূমিকম্প থেকে বাঁচার জন্য বাচ্চাদেরকে নানানরকম ড্রিলিং করানো হয়। এসব করার অর্থ কী? কারণ হলো সবাইকে সচেতন করা, নিয়ম মানতে উতসাহিত  ও বিপদ থেকে রক্ষা পেতে রপ্ত করে তোলা। এসব করা হলে বেইলি রোডের এ অগ্নিকান্ডে এরকম বড় সংখ্যার জানমাল হারাতে হতো না।

.

সংবেদনশীল মনের মানুষ হওয়ার যন্ত্রণা হলো প্রতিটি বিষয় নিয়ে ভাবা আর কষ্ট পাওয়া। শোকে মূহ্যমান হয়ে কেবল বেইলি রোডে অগ্নিশিখায় জ্বলন্ত ভবন ও বের হওয়া লাশদের কথা ভাবছি। ভাবছি স্বজনদের কথা। প্রথমেই প্রশ্ন আসে কারা দায়ী? যারা ভাবি ইলেক্ট্রিসিটি বা গ্যাসের লাইন নিয়ম না মেনেও নেওয়া যাবে; যারা ভাবি এসব ইউটিলিটির ক্যাবল বা পাইপ কমদামি মানহীন হলেও হবে; যারা ভাবি কিচেনের নিরাপত্তার জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ করে বাড়তি খরচ করার দরকার নেই; যারা ভাবি ভবন নির্মানে গুণগত মান বজায় রাখার দরকার নেই; যারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভবনে রাখি না।যারা ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক রাখি না; যারা আলাদা সিঁড়ি ও বিকল্প একজিট রাখি না। (অনেক ভবনেই কেবল সিংগেল লিফট। বিকল্প একজিট নেই, এমনকি সিঁড়িও নেই।) যারা এসব নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়মিত তদন্ত করা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থেকেও দায়িত্ব পালন করেন না তারা দায়ী। যারা ইন্সপেকশনকারী কর্মকর্তাদেরকে ফোন করে তদবির করে ছাড় দিতে বলেন- সেসকল বড় সাহেবেরা দায়ী। তাহলে কারা দায়ী নয়? কেবল বেইলি রোডের ওই ভবনের মালিক বা রেঁস্তুরার মালিক দায়ী? না, সকল ভবনমালিক যারা এসব মানি না এবং সকল অফিস যারা মানানোর দায়িত্বে থেকেও মানাই না, আর সেসকল তদবিরকারী যারা এসব অন্যায়ের পক্ষে তদবির করেন, তারাই এসব অগ্নিকান্ড ও হত্যার জন্য দায়ী। পরিহাসের বিষয় হলো যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবার, স্বজন ও আত্মীয়দের চেক করা হলেও দেখা যাবে তাদের অনেকেই বাড়ি, দোকান ও ইউটিলিটি সংক্রান্ত বিধি বিধান মানেন না। তথা না মেনে যারা আমরা ভাবছি জিতে গেলাম, তারাই আবার ভিকটিম হই। মোদ্দা কথা হলো কায়দা করে দায় এড়িয়ে ফায়দা লাভের চেষ্টা করি বটে, তবে আখেরে লাভবান হতে পারি না। কারণ আমরা যারা নিয়ম মানি না বা মানাই না তারা কোনো না কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই, নদী দূষণে, রোগেশোকে, অগ্নিকান্ডে, সড়ক দূর্ঘটনায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। তার মানে কায়দা করে দায় এড়িয়ে কোনো ফায়দা হয় না।

.

এখন করণীয় কী? ক. ফায়ার রেজিস্টেন্ট বা ফায়ার ফাইটিং বিষয়ে প্রতিটি নাগরিক সচেতন হওয়া ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল বিধিবিধান সঠিকভাবে মেনে চলা। অন্যদেরকে সচেতন করা ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। খ.  বহুতলভবন করার জন্য বিল্ডিং কোডসহ রাজউকের নির্ধারিত নিয়ম কানুন রয়েছে। সেগুলো সানুপঙ্খ মানার জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।। গ) রাজউক ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশনসহ  প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তর যথাযথ তদন্ত করে ছাড়পত্র দিতে হবে। এসব ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক/ব্যবসায়ীক/ আমলাতান্ত্রিক/মিডিয়া/পেশাজীবী ঘরাণার  উচ্চমহলের কোনো তদবির করা বা তদবির গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। গ. যেসব ভবনের অনুমোদন বা ছাড়পত্র নিয়ম না মেনে দেওয়া হয়েছে, রাজউক ও অন্যান্য সকল সংস্থার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঘ. নিয়ম না মেনে যদি কেউ ভবন করে , সে ভবনে কোনো ইউটিলিটিজ তথা  পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ পাওয়ার কথা নয়, নিয়ম বহির্ভূত ভবনে যেন কোনো সার্ভিস না দেওয়া হয় সে বিষয়েও সকলকে সতর্ক হতে হবে।  ঙ. আধুনিক যন্ত্রপাতি ও লজিস্টিকসহ আধুনিক ফায়ার সার্ভিস প্রস্তুত করা। একই সাথে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌছাতে পারবে না। যানজটের কারণে সময়মত হাসপাতালে পৌছাতে না পারায় বার্ষিক কতজনের মৃত্যু হয়- এই তথ্যও বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক, ব্যবাসায়িক ও পেশাজীবী সংগঠন ও নেতৃবর্গকে সত্যিকার অর্থেই বিষয়টি অনুধাবন করে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

 

অনেকেই উৎসুক জনতা নিয়ে সমালোচনা করে। নিশ্চয়ই অযথা ভিড় বা ভিডিও করা কাজের পরিবেশকে ধীরগতির করে, তবে উৎসুক জনতার অনেকে আবার জীবন বাজি রেখে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও এ মানবিকতার দিকটি আছে। এরকম মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। পাশাপাশি নিজেরাসহ সকল স্টেকহোল্ডারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা দরজা বন্ধ করবে, পানির পাত্রের মুখ বাঁধবে, পাত্রগুলো উল্টে রাখবে কিংবা পাত্রগুলো ঢেকে রাখবে, বাতি নিভিয়ে দেবে। কেননা, শয়তান বন্ধ দুয়ার খুলতে পারে না, মশকের গিঁট খুলতে পারে না, পাত্রের মুখও অনাবৃত করতে পারে না। (বাতি নিভিয়ে দেবে) কেননা, দুষ্ট ইঁদুরগুলো লোকদের ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়’ (তিরমিজি-১৮১৯)। সুনাগরিকের কর্তব্য ভুলে, ফাঁকি দিয়ে জিতে যাওয়ার লোভে, এখন আমাদের অনেকেই আত্মঘাতি ইঁদুরের ভূমিকা নিয়েছে। নিজেদের তৈরি করা ফাঁদে আমরাই পড়ি, ও জানমাল হারাই। অনেকেই অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে দায় সারাতে চাইবো, শক্তিশালী স্টেকহোল্ডারগণের একটি অংশ এসব প্রকৃতির খেলা বা সৃষ্টিকর্তার খেলা বলে চালিয়ে দিবে কিংবা ‘‘তাদের মৃত্যু এভাবেই লেখা ছিল‘‘ বাণী আওড়ে গা ভাসাবে।  কিন্তু সমজদার মাত্রই বোঝার কথা নিজেদের তৈরি করা গর্তে আমরা পা দিচ্ছি। আমরা নিজেরা মৃত্যু ডেকে আনছি। আমাদের অবহেলা, অনিয়ম, জবাবদিহীতার অভাব, দায়িত্বশীলতার অভাব, আমাদের পরিশীলিত চিন্তার অভাব, আমাদের লোভ এসকল ঘটনার জন্য দায়ী। ‘আমার দ্বারা অন্য মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না, বা অন্যরা কোনো ঝুঁকিতে পড়বে না‘- এ বোধে উজ্জীবিত হওয়ার মতো সংবেদনশীল মনন আমাদের সকলের দরকার।

(দৈনিক ডেইলি স্টার বাংলায় ২০২৪ সালের পহেলা মার্চে প্রকাশিত)

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart