Detail

Home - সুশাসন ও ইনোভেশন - প্রবন্ধ: ‘করোনা পরিস্থিতি: মাঠ প্রশাসন কী করেছে?’ – সফিকুল ইসলাম

প্রবন্ধ: ‘করোনা পরিস্থিতি: মাঠ প্রশাসন কী করেছে?’ – সফিকুল ইসলাম

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি মানুষ নানান প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে অধিকার রক্ষার যুদ্ধে, কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে যারপরনাই জানে মালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। এসব ‍যুদ্ধে সব মানুষ সামনের কাতারে এগিয়ে যায়না, প্রাণ বাজি রেখে কাজ করেনা। যারা করেছে তাঁদেরকেই ইতিহাস মনে রেখেছে ও ‘বীর‘ উপাধী দিয়েছে। বর্তমান করোনা সংকটেও নানান পেশার মানুষ ফ্রন্টলাইনে থেকে লাখো মানুষের প্রাণ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ডাক্তার নার্সরা হাসপাতালে, মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তারা দেশের জেলা উপজেলার আনাচে কানাচে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে মাঠে-ঘাটে, আর খাদ্য ও জরুরি সরবাহকারী কৃষক ও শ্রমিকরা সর্বত্র । আর পলিসি প্রণয়ন ও দেশব্যাপী দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বয়ের কাজ করছে সরকারের নির্দেশনায় জাতীয় পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক আমলারা । সম্মুখভাগে যুদ্ধরত ডাক্তার নার্সদেরকে আমরা হাসপাতালে গেলে দেখি,  আইনশৃংখলা বাহিনী সদস্যদেরও পোষাকের কারণে রাস্তাঘাটে কর্মতৎপরতায় দেখতে পাই। বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরাসহ সিভিল আমলারাও কাজ করে যাচ্ছেন। নিরবে নিভৃতে সকল দুর্যোগের মতো এ করোনা সঙ্কটেও।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল দেশের আবাল বৃদ্ধ বণিতা।  সিভিল সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। রাঙ্গামাটি ও যশোরের তদকালীন প্রশাসকগণ, হবিগঞ্জের তৎকালীন মহুকুমা প্রশাসক ড. আকবর আলী খান, সদ্য প্রয়াত সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড. সাদত হুসাইন প্রমূখসহ আরও অনেকে। তেমনি পরবর্তীতে প্রতিটি দুর্যোগে এ আমলারা জীবনবাজি রেখেই কাজ করে গিয়েছেন। অনেক খবর ঘাটলে পাওয়া যাবে, তবে আমলারা এসব বলার পেছনে সময় না দিয়ে কেবলি নিরবে কাজ করে গেছেন সবকালে। ‘‘বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়‘‘ কিংবা ‘‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু‘‘ হৃদয়ে রেখে,  ‘‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মতো সুখ কোথাও কি আছে, আপনার কথা ভুলিয়া যাও‘‘ কবিতার লাইন মননে গেথে, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে উজ্বীবিত হয়ে, পেশাদারিত্বের সাথে নিরবে কাজ করে যাচ্ছে বিসিএস প্রশাসনসহ সিভিল সার্ভিসের অনেক সদস্য।

এরকম হাজার হাজার কাজ থেকে করোনা সঙ্কটে নেওয়া কিছু কাজের কথা উল্লেখ না করলেই নয়।  গ্রামবাসী যেখানে করোনা রোগীকে গ্রাম থেকে বের করে দিচ্ছেন সেখানে সখীপুরের ইউএনও দিলেন ‘মমতার দাওয়াই‘ (প্রথম আলো, ২৫ এপ্রিল), কোটালীপাড়ায় তরমুজ বিক্রি করতে না পারায় তরমুজ যখন পঁচার উপক্রম তখন ইউএনও অনলাইনে tarmuzbazar.com খুলে তা বাজারদরে সারাদেশে বিক্রির ব্যবস্থা করলেন (সমকাল, ২৭ এপ্রিল), কৃষকের কৃষিপন্য ফল-সব্জি বাজারদরে কিনে তা ত্রাণ হিসেবে পৌঁছে দিচ্ছেন খুলনা জেলা প্রশাসন (বিডি-প্রতিদিন, ২৩ এপ্রিল), ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনতে ও পুনরাবৃত্তি কমাতে মোবাইল অ্যাপসের ব্যবহার করছে খুলনা জেলা প্রশাসন (সমকাল), বিলাইছড়ি উপজেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সব্জি বীজ বিতরণ করেছে উপজেলা প্রশাসন (ডেইলি স্টার ২২ এপ্রিল), সন্তানরা যখন করোনা আক্রান্ত মাকে বনে ফেলে দিয়ে  এসেছে, উপজেলা প্রশাসন, সখীপুর সেই মাকে দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে (প্রথম আলো ১৪ এপ্রিল), হবিগঞ্জে ১৫০০০ করোনা বেকারকে ধান কাটানোর কাজে লাগিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে (প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল), কাউখালী উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমান বাজার চালু করেছে, করোনা আক্রান্ত রোগীকে সরকারের পক্ষ থেকে ফুল ও ফল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন মনপুরার উপজেলা প্রশাসন, ওএমএসের চাল যেন ডিলাররা বাইরে বিক্রি করতে না পারেন সেজন্য কালিহাতি উপজেলার ইউএনও করেছেন ডিজিটাল কার্ডের ব্যবস্থা, উপজেলায় কর্মরত কৃষি শ্রমিকদের দুপুরের খাবার দিচ্ছেন জুড়ি উপজেলার ইউএনও। এছাড়াও ইউএনওদের আহবান ও সমন্বয়ে হাজার হাজার শ্রমিক কৃষকদেরকে ধান কাটায় সহযোগিতা করছে হাওরের বিভিন্ন উপজেলায়। পাশাপাশি করোনায় মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়ানোর জন্য যখন স্বজনদের পাওয়া যাচ্ছেনা তখন ঝিনাইদহ সদরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই জানাজা পড়িয়েছেন- সেই উদাহরণও রয়েছে আমাদের চোখের সামনে। এসব খবর বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরের কয়েকটি, অপ্রকাশিত রয়ে গেছে আরও হাজার উদাহরণ।

উল্লিখিত প্রতিটি কাজই প্রমান করে যে, মাঠ প্রশাসন এখন জনগণের সমস্যা বুঝে সমাধান দিচ্ছেন, প্রমান করে যে মাঠপ্রশাসন এখন গণমুখী ও পেশাদারি। এসব কাজ প্রমান করে ম্যাক্স ওয়েবারের টপ-ডাউন এপ্রোচের আমলাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে প্রশাসন এখন আধুনিক বটম-আপ এপ্রোচে কাজ করছেন এবং সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন জনগণের দোঁরগোড়ায়। উপরের সবগুলো কাজই প্রমান করে যে, মাঠ প্রশাসন রবীন্দ্রনাথের বাণী (‘‘যেখানে প্রজার হাতে কোনো ক্ষমতাই নাই, সেখানে ব্যুরোক্রেসি উঁচুদরের জিনিস হইতে পারে না‘‘) থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আর দীক্ষা নিয়ে জনগণকে সামনে রাখছেন, জনগণকে দেখছেন, জনগনকে শুনছেন এবং তাদের প্রয়োজনের আলোকে জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। থাকছেন সেবক হয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায়।

এরই মধ্যে শিকার হতে হচ্ছে নানান প্রতিকূল অবস্থার। ত্রাণের চাল বিতরণে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সরকার ও স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশনায় শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে সামলাতে হচ্ছে সরকার বিরোধী ভূয়া ভাইরাল নিউজকারীদের মিথ্যা সংবাদের ঝামেলা। সাভারের ২ মাস আগের সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতার চুল বিক্রির ঘটনাকে করোনাকালীন অভাবে চুল বিক্রি বলে নিউজ ভাইরাল করেছেন একটি গোষ্ঠী। এসব অশুভ চক্র সবসময় লেগে থাকে মাঠপ্রশাসনের বিরুদ্ধে, পান থেকে চুন খসলেই তিলকে তাল বানায় এরা। এসব অশুভ চক্রকে সামলে পথ চলা কঠিন। অনেকটা মহাভারতে উল্লিখিত অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুর কুরুক্ষেত্রের চক্রবুহ্য ভেদ করার মতোই। চারদিকের এসব ঝামেলা সত্ত্বেও মাঠ প্রশাসন অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে দিনমান ধরে।

এসব কাজের অংশ হিসেবেই লকডাউনকে বাস্তবায়ন করার জন্য শুরু থেকেই  দৌঁড়ঝাপ করছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গ্রামের হাটবাজারে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানে মানুষকে সচেতন করছেন, মাইকিং করছেন,ও প্রয়োজনমতো আইনী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মানুষকে ঘরে রাখতে দিনরাত খেটে যাচ্ছেন। নাওয়া খাওয়া ভুলে, বিনিদ্র রজনী পার করে, শিশু সন্তান ও পরিবারকে বিচ্ছিন্ন রুমে রেখে।। আর এসব কর্মযজ্ঞ চালাতে গিয়ে বিসিএস প্রশাসনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, আর একজন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়াও শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারি আক্রান্ত হয়েছে  এ পর্যন্ত।

এরপরেও মূল মিডিয়াতে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে আমলাদের নিয়ে নানান কুৎস্যা চলতেই থাকে। সমাজে যেমন সকল মানুষ ফেরেশতানা, তেমনি আমলাসমাজেও দু-একজন ভুলের উর্দ্ধে নয়। তবু নেতিবাচক সমালোচনা, অরুচিকর সমালোচনা চলতে থাকে জেনারালাইজড করে। এসব সমালোচনা সহ্য করে পেশাদারিত্ব ও দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করার মনোবল ও দক্ষতা প্রশাসনের রয়েছে। প্রশিক্ষণ ও দেশপ্রেমেই তাঁদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে সব সহ্য করে নীরবে কাজ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এরপরেও কোন কোন অনুজ কর্মকর্তার মনে কষ্ট থাকতে পারে বা মনোবলে আঘাত পড়তে পারে তাঁদের জন্য একটি গল্প স্মর্তব্য। গল্পটি ছোটবেলায় আমার নানার মুখ থেকে শোনা।

এক গৃহস্থ তিনজন দিনমজুর ভাড়া করেছে| জমির আগাছা পরিস্কার করতে। তিন দিনমজুরের নাম মামলা, ঝামেলা, আর কামলা। এদের একজনের নাম কামলা। তিন জন সারাদিন কাজ করেছে। কাজ শেষ। এবার জামির মালিক বিকেলে জমি দেখতে এসছে কেমন পরিস্কার হলো। দেখে জমির এখানে ওখানে কিছু আগাছা দেখা যায়। জমির মালিক প্রশ্ন করে এ জায়গাটা কে পরিস্কার করেছে? প্রথম দুজনে উত্তর দেয় কামলা করেছে। আরেকটু দুরে গিয়ে আবার প্রশ্ন এ জায়গাটা কে পরিস্কার করেছে? দুই জনে উত্তর দেয় কামলা করেছে। এভাবে সারা জমি হেঁটে হেঁটে যেখানেই আগাছার চিহ্ন পেয়েছে প্রশ্ন করেছে এ জায়গাটা কে পরিস্কার করেছে? প্রথম দুজন উত্তর দিয়েছে কামলা করেছে।।

তো সন্ধ্যায় টাকা পরিশোধের বেলায় গৃহস্থ কামলার হাতে তিন জনের দিনের মজুরি তুলে দিল। অন্য দুজন কোন টাকা না পেয়ে গৃহস্থকে ধরলো। গৃহস্থের নির্বিকার উত্তর। তোমরাতো বললে সারা জমি কামলা পরিস্কার করেছে। সারা জমিতেই একটু আধটু  আগাছা ছিল। মানুষ কাজ করলে কিছু ভুল হতেই পারে। যেহেতু কামলা সারাজমিতে কাজ করেছে তাই কামলাকে সব বেতন দিয়ে দিলাম। গল্পের শিক্ষা হলো- এরকম তিনজনে মিলে অনেক জায়গায় আমরা কাজ করি। ঘরে, পরিবারে, গ্রামে, সমাজে, রাষ্ট্রে,বিশ্বে।যে বেশি কাজ করে তার কিছু খুঁত থাকবেই, না থাকলেও লোকে বলবেই। যারা কাজ করেনা, তাদেরতো কাজই নেই, খুঁত কোথায় পাবে? তাই তারা অন্যের কাজের খুঁত ধরে বেড়ায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমলাদের সমালোচনা করলেও আমলারা মুখ খুলেনা কেন? কারণ আমলাদের প্রশিক্ষণ আছে কথা না বলার ও মুখ না খোলার। এবং তাদের মনে হয় সেই জোকসটা জানা আছে। এক জরিপে দেখা গেছে যে বিশ্বের ১০ ভাগ পুরুষ মতামত দিয়েছে যে, তারা তাদের বউয়ের সমালোচনায় বিরক্ত, আর বাকিরা? বাকি ৯০ ভাগ পুরুষ বউয়ের ভয়ে মুখ খুলেনাই! এ জোকস মনে রেখেই হয়তো তারা মুখ খুলেনা। ‘কথা কম কাজ বেশি, দেশের জন্য কাজ করি‘ স্লোগানই তাদের চলার শক্তি।

তাহলে কি প্রশাসনের কোনো ঘাটতি নেই? নিশ্চয়ই আছে। গঠনমূলক সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে, আবার আত্মউপলব্ধি ও আত্মমূল্যায়ন থেকেও শিক্ষা নিতে পারে। বহির্বিশ্বের উন্নত ব্যবস্থা দেখে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। দেশকে, সিভিল সার্ভিসকে, সেবা প্রদানের পদ্ধতিগুলো বিশ্বমানের করতে কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। বিদ্যমান উত্তম উদ্যোগ ও কর্মপ্রচেষ্টাগুলোকে অব্যাহত রাখতে হবে এবং ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোকে সংশোধন করে এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বৃদ্ধি করে করে আমলাতন্ত্রের গণমুখী ও সেবামুখী চরিত্রের বিকাশ করতে হবে। দেশের উন্নয়নে ও নাগরিকদের সেবায় ঐকান্তিক এসব প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে  প্রশাসন বদ্ধপরিকর।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart