প্রবন্ধ: ‘দেশপ্রেম বলতে কিছু আছে কি?’ – সফিকুল ইসলাম
অস্ট্রেলিয়া বা জাপানে যখন ছিলাম তখন দেশের জন্য মন কাঁদতো, দেশের যে কোনো ঘটনায় উত্তেজিত হতাম। আনন্দের হলে উদ্বেলিত হতাম, আর হৃদয়বিদারক হলে গোপনে চোখ মুছতাম। দেশের ইতিহাস, বাস্তবতা, বর্তমান, সংস্কৃতি, ধর্ম যে কোনো বিষয়ে মন কাতর হতো। এটা প্রবাসী মাত্রই জানে ও টের পায়। প্রবাসজীবনে মানুষ যতটা দেশকে নিয়ে ভাবে ও অনুরণিত হয়, ততটা অন্য সময় হয় কিনা আমি জানি না।
আবার স্কুলের এসেম্বিলির সময় যখন জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম, তখনও আমাদের মনে দেশপ্রেম জেগে উঠতো। সবুজ বাংলাদেশকে ভেবে প্রাণের বাংলাদেশকে চিন্তা করে মন উতলা হতো। দেশের স্বাধীনতা আনতে যারা জীবন দিয়েছেন, দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় যেসব মানুষ জীবনবাজি রেখে লড়েছেন তাদের কথা ভেবে গর্বিত হতাম। আমাদের ভিতরেও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। আসলে এরকমভাবে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে গণমানুষ কীভাবে দেশপ্রেমে আক্রান্ত হয়, আবেশিত হয়, গ্রহণ করে ও দেশপ্রেম লালন করে। এবং সেই দেশপ্রেম থেকে যে কোনো ত্যাগ করতে তারা রাজী থাকে।
তেমনি ভাষা আন্দোলনে ভাষার গান শুনে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তির গান শুনে, গণঅভ্যূথান বা বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী গান শুনে আমরা উতলা হই, উজ্জীবিত হই। দেশের গান শুনে, বিদ্রোহের কবিতা শুনে আমরা জেগে উঠি, জ্বলে উঠি, সোচ্চার হই, জীবন বাজি রাখি। এগুলো নি:স্বন্দেহে দেশপ্রেমের লক্ষণ বা চিহ্ন। এরকম ঘটনা বিষয় পৃথিবী জুড়ে নানান দেশে নানানভাবে আছে।
গণমানুষের এ বোধ, এ অংশগ্রহণ এ অনুভূতি নিশ্চয়ই দেশপ্রেম। দেশের প্রতি তাদের অগাধ প্রেম, প্রগ্রাঢ় ভালোবাসা। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাহলে দেশপ্রেম হচ্ছে একজন ব্যক্তি বা একটি জনগোষ্ঠী কর্তৃক মাতৃভূমির প্রতি একধরনের আবেগপূর্ণ অনুরাগ বা ভালোবাসা। মানুষের জাতিগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অথবা ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশভেদে দেশপ্রেমের ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হলেও ব্যাপারটা আসলে এক ও অভিন্ন এবং দেশপ্রেমিক বলতে বোঝায় এমন সব ব্যক্তি, যাঁরা দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগে সর্বদা প্রস্তুত। আরবি ভাষায় একটি কথা আছে, ‘আল্ হব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান,’ অর্থাৎ ‘দেশপ্রেম হচ্ছে ইমানের অঙ্গ’। যাঁর অন্তরে দেশপ্রেম আছে, ধরে নিতে হবে যে তাঁর ইমানও আছে; পক্ষান্তরে যাঁর অন্তরে দেশপ্রেমের দীপশিখা প্রজ্বলিত নেই, তাকে মোমিন বলে অভিহিত করলেও ধরে নিতে হবে যে তাঁর ইমান পরিপূর্ণ নয়। ছোটবেলায় একটি নাতে রাসুল শুনেছিলাম, ‘‘জন্মভূমির মায়ায় নবী ফিরা ফিরা চায়…..‘‘। মানে মক্কা ছেড়ে যাওয়ার সময় নবীজির কষ্ট লেগেছিল।
বর্তমানেও গণমানুষের মধ্যে এরকম দেশপ্রেমিক ও জন্মভূমি প্রেমিক পাওয়া যাবে। দেশীয় পন্য কিনবে, দেশের জিনিস খাবে। দেশের টাকা দেশে রাখবে। এরকম দেশপ্রেমিক অনেক আছে।
.
কিন্তু আরেক গ্রুপ আছে যারা এসব দেশপ্রেমের ইস্যু তৈরি করে, জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে, ও মানুষকে মাতিয়ে তোলে পরে সটকে পড়ে কিংবা নিজেদের ক্ষমতায় বসিয়ে সবকিছু ভুলে যায় তারা কারা? তারাই আসলে মূল হোতা। তাদের কাছে এটা কি দেশপ্রেম? জাতিপ্রেম? বা দাবি আদায়ের লড়াইয়ের চেতনা থাকে? আমার মনে হয় না। তারা খুব সুচিন্তিতভাবে এসব দেশপ্রেমের জাতিপ্রেমের কথা বলে বেড়ায়। এগুলো বলে বলে তারা মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। জীবন বাজি রাখতে উদ্ধুদ্ধ করে। পরে ঘটনা ঘটে যাবার পরে তারা কয়েকজন ক্ষমতার বলয়ে ঢোকে যায়। তারা শাসক হয়ে যায় এবং শাসকদের চিরাচরিত চরিত্র গ্রহণ করে ফেলে। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, গণদাবি কিছুই কাজ করে না। তারা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মোহে লিপ্ত হয়ে যায়। আর যারা তাদের কথায় উজ্জীবিত হয়ে জীবন দিয়েছে, আহত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা বা তাদের আত্মীয়স্বজনরা আর কিছুই পায় না। তারা কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে সামান্য অনুকম্পা বা স্মরণসভায় স্মরণ হয়ে থাকে। তারা বাস্তবে কিছুই পায় না। সেটা না পাক। এমনকি যেটার জন্য তারা জীবন দিলো বা আহত হলো, সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য, সত্যিকারের মানবাধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, সকলের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য সেগুলোও অর্জিত হয় না। বরং শাসনক্ষমতায় যারা আসে তারা আগেকার শাসকদের চেহারায় শোসক রূপ ধারণ করে। লর্ড ক্লাইভ বা মীরজাফরের সাথে যেমন জিন্নাহ ইয়াহিয়ার কোনো পার্থক্য নেই। তেমনি ৭১ এর পরবর্তীতে সকল্ আমলে যারা যারা ক্ষমতায় গিয়েছে ও গণদাবি উপেক্ষা করেছে, ক্ষমতার লোভে সকল অন্যায়, গুমখুন, টর্চার করেছে, ভোট কারচুপি করেছে, তারাও মুলত ওই ক্লাইভ-মীরজাফর-জিন্নাহ-ইয়াহিয়ার মতোই। বরং আরও নিকৃষ্ট। ওয়াদা ভঙ্গকারী নাফরমান ও বাটপার। এদের কাছে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম বা আদর্শচেতনা কিছুরই মূল্য নেই। এরা এগুলো ব্যবহার করে গণমানুষকে জমায়েত করার জন্য, মিসগাইড করার জন্য, প্রতারণা করবার জন্য নিজেদের আখের গুছাবার জন্য তারা দেশপ্রেমের নাটক করে, মানবাধিকারের কথা বলে।
বিখ্যাত লেখক আন্ডারসনের ‘‘ইমাজিনড কমিউনিটিজ‘‘ বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে বিশ্বব্যাপী সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় এলিটরা গণমানুষের মাথার ভিতরে চেতনা তৈরি করে ও মিসগাইড করে। মানুষকে খেপিয়ে তোলার জন্য এটা মোক্ষম অস্ত্র। যেমন একজন বাংলাদেশী বাংলাদেশে বাস করে। যদি দেখে যে কোনো এক বাংলাদেশী ব্রিটেনে আক্রান্ত হয়েছে বা সমস্যায় আছে তখন তার মনে চোট লাগবে। অন্য দেশের লোক হলেও লাগবে, তবে নিজের দেশের হলে বেশি লাগবে। আরেকজন মুসলিম, যদি দেখে যে অন্যদেশের কোনো মুসলিম আক্রান্ত হয়েছে, তবে সে কষ্ট পাবে অন্য ধর্মের হলেও কষ্ট পাবে। তবে নিজের ধর্মের হলে একটু বেশি কষ্ট পাবে। যদিও এ দুজনলোক তার পরিচিত না, তবু তার মনের ভিতরে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। একই জাতির, একই দেশের, একই গ্রামের, একই ধর্মের, একই জেন্ডারের হলে তার জন্য মন বেশি কাঁদে। এ সফট ফিলিংটাকেই কাজে লাগান সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় এলিটরা। এর মাধ্যমেই গণমানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে।
আমার গ্রামের পাশের গ্রামে দু গ্রুপের মারামারিতে একজন নিহত।ছোট গ্রামটির নাম নিমবাড়ি। যে মরেছে আর যারা মেরেছে তারা সবাই একই গ্রামের ভাই। একসাথেই দশকের পর দশক মিলেমিশে চলে। বিয়ে খতনা একসাথে খায়। বাজারে যায়; বিলে কাজ করে; ঈদের মাঠে কুলাকুলি করে; শুক্রবারের জুম্মায় খুতবা শোনে; শীতকালের মাহফিলে হুজুরের ওয়াজ শুনে; পাশাপাশি বসে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ফেলে। কিভাবে সম্ভব মেরে ফেলা ! আমি ভেবেই পাই না।
ছোটবেলায় এরকম মারামারি দেখেছিলাম। দুপাশে দু গ্রাম। মাঝখানে সবুজ প্রান্তর। সবার হাতে বল্লম, মুলি (বাঁশের ধারালো কঞ্চি), রান দা, ইট ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। একপক্ষ আরেকপক্ষকে এলোপাথারি নিক্ষেপ করছে।আমি দূর থেকে দেখছিলাম। পাশে বয়স্ক মুরব্বী। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ”গ্রামের মান বাঁচাও”, ”গ্রামের মান বাঁচাও” । আর এ চিৎকারে গ্রামের জওয়ানদের গ্রামপ্রেম উথলে উঠে আর ঝাঁপিয়ে পড়ে!
রাষ্ট্র পর্যায়ে ”জাতীয়তাবাদ” যেমন ট্রাম্প বুশরা ব্যবহার করেন; গ্রাম পর্যায়ে “গ্রামের মান বাঁচাও”, গোষ্ঠীর মান বাঁচাও” নামক গ্রামপ্রেম/গোষ্ঠীপ্রেমের/ধর্মপ্রেমের চরম অপব্যবহার হয়।সেই ছোটবেলায় বুঝেছিলাম যে মুরব্বী ভুল বলছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো, সংগঠন বা এনজিওগুলো এমন নানান ধারণা ও চেতনার স্লোগান নিয়ে এসে হাজির হয়। আর গণমানুষ লাখে লাখে হাজারে হাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হয়তো সাময়িকভাবে যুদ্ধ, জীবন ও ত্যাগ দ্বারা চাহিত লক্ষ্য অর্জিত হয়, তবে আসল যে রূপকল্প তথা মানুষের মুক্তি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তা আর অর্জিত হয় না। মানুষ বাঘের মুখ থেকে কুমিরের মুখে পড়ে। এটুকুই পার্থক্য।
স্বাধীনতা ও মুক্তি পেতে, অধিকার ও স্বচ্ছলতা পেতে, মর্যাদা ও আভিজাত্য পেতে, আর শান্তি ও সুখ পেতে মানুষ কতবার কতভাবে জীবন দিয়ে লড়েছে। পুরো বিশ্ব ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভাগ হয়েছে, ভিন্ন ধর্মে ভাগ হয়েছে, ভিন্ন গোত্র ও সমাজে ভাগ হয়েছে। টুকরা টুকরো হয়েও সেসব অর্জিত হয় নি। দেশের ভিতরে আবার নানান বিভাজন। নানান দল উপদল। ধর্মের মধ্যে আবার নানান ফ্যাকরা ও বিভক্তি। গ্রামে গ্রামে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, এমনকি ঘরের ভেতরেও বিভাজন। এ খেলা শেষ হবার নয়। যারা দেশ ভাগ করে, সমাজ ভাগ করে, ধর্ম ভাগ করে, গোত্র ভাগ করে, তারা আসলে নিজের শাসক হওয়ার জন্যই করে। তারা শাসক হওয়ার পরে নিজেরাই শোষক বনে যান। তখন গণমানুষকে আবারও মুক্তি পেতে নতুন কোনো বিষয়ে নতুন কোনো লড়াই করতে হয়। যে কারণে পৃথিবীতে শান্তির লক্ষ্যে নানান দেশ, ধর্ম, সংগঠন গঠিত হওয়ার পরেও মানুষের মুক্তি মেলে নি। মানুষ এখনও দৌড়ের উপরই আছে।
দেশপ্রেম দেখি দেশে দেশে যুদ্ধ হয়, ধর্মপ্রেম দেখিয়ে ধর্মে ধর্মে ভাগ হয়ে লোকেরা যুদ্ধ করে, তেমনি আইডিয়া, ধারণা, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতবাদে দল উপদলে ভাগ হয়ে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ শেষ হলে আবার নিজেদের মধ্যে আবার কোনো স্বার্থ নিয়ে লাগে, তখন আবার নতুন বিভাজনের সুর তৈরি করা হয়। তথা বিভাজন ও শোষণ যেন নিয়তি। জনতা এলিটদের বাজানো বয়ান শুনে শুনে উইপোকার মতো আগুনে ঝাঁপ দেবে, আর ঘটনার জয়ের পরে এলিটরা ক্ষমতার মসনদে বসে আবার আগেকার শাসকদের মতোই শোষণ করবে। জনতা শোষিত হবে। নতুন শোষণ ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে আবার আরেকদল জেগে উঠবে। সেই দল আবার নতুন কোনো ধারণা বা তত্ত্ বা বৈশিষ্ট্য দিয়ে জনতাকে ভাগ করবে, উজ্জীবিত করবে। জনতা্ আবার আন্দোলনে যোগ দিবে। আবারও জয় হবে। জয়ের পরে এলিটরা নতুন করে আবার শাসক হয়ে বসবে ও আগেকার শাসকদের মতোই শোষণ শুরু করবে। এর মধ্য দিয়ে তথাকথিত জনতার লড়াই বা বঞ্চনার কোনোটাই ইতি হয় না। হয়তো নতুন কিছু লোক রাজনৈতিক ও সামাজিক মসনদে বসার সুযোগ পায়। বাকিদের অবস্থা তথৈবচ।
এরকম সমস্যা সারা বিশ্বজুড়েই আছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব দেশপ্রেম, চেতনা, ধর্মপ্রেম, জাতিপ্রেম, ভাষাপ্রেম ইত্যাদির অপব্যবহার দেখা যায় বেশি। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। আমরা দেশকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু যতটা না ভালোবাসি তারচেয়ে বেশী ভালোবাসা দেখানোর চেষ্টা করি। গলায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে হলেও প্রচার করতে চাই আমি দেশপ্রেমিক। এরকম লোকের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। কথিত এলিটদের এরকম আচরণে গণমানুষও সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। যদিও কেউ কেউ আবার সত্যি সত্যি মনের গভীর থেকে দেশকে ভালোবাসে, নীরবে লোক চক্ষুর অন্তরালে। দেশের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য না দেশকে কিছু দেওয়ারর জন্য। অনেকে আবার দেশকে ভালোবাসতে চেয়েও ভালোবাসতে পারেনা তাদের পদ্ধতিগত ভুলের কারনে বা পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে। এখন স্বার্থপর লোভী শট এলিটদের কারণে মাঝে মাঝে মনে হয় দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ইত্যাদি স্লোগানগুলো খুবই স্বস্তা বিষয়। যা অপব্যবাহর করে পথভ্রষ্ট এলিটরা সমাজ ও দেশের ক্ষতি করছে।
এরকম দেশপ্রেমের অপব্যবহার যেমন ভালো নয়, তেমিন অতি দেশপ্রেমও আবার ক্ষতিকর। যেমন জার্মানিতে জাতিহত্যার যে চেষ্টা, কিংবা সুদান বা মায়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার যে হিংস্র আক্রমণ তাতে এটা পরিস্কার দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ ক্ষতিকরও হতে পারে। আসলে ছুরি দিয়ে আমরা আপেল কাটবো নাকি মানুষ কাটবো তা আমাদের সমস্যা। ছুরির কোনো দোষ নেই। দেশপ্রেম, অধিকারের লড়াই, মানবাধিকার কর্মযজ্ঞ। এগুলো উত্তম কাজ। যতক্ষণ না এগুলোর ব্যবহার করে কেউ স্বার্থ উদ্ধার করে। যতক্ষণ না নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করে, যতক্ষণ না শাসক হয়ে শোষণ করার পায়তারা করে। ততক্ষণ পর্যন্ত দেশপ্রেম উত্তম জিনিস।
অতিরিক্ত কোনো কিছুই যেমন ভালো নয়, তদ্রূপ অতিমাত্রায় ‘দেশপ্রেমও’ বাঞ্ছনীয় নয়। ইংরেজি ভাষায় এ প্রসঙ্গে দুটি আলাদা শব্দই আছে—‘শভিনিজম’, অর্থাৎ উৎকট স্বদেশপ্রেম ও ‘জিংগোইজম’, অর্থাৎ সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জার্মানদের উৎকট ও সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেমই ছিল পৃথিবীতে দু–দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বোধ করি এ কারণেই প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক মোপাসা পরিহাসভরে বলে গেছেন, ‘দেশপ্রেম হচ্ছে একটি ডিম, যা ফুটে যুদ্ধের জন্ম হয়।’ অতএব আমরা সবাই অবশ্যই দেশপ্রেমিক হব, তবে অতি-দেশপ্রেমিক হব না এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও জাতির প্রতি ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করব না।
আর যারা দেশপ্রেম, ধারণা, চেতনা বিক্রি করে ব্যবসা করে, স্বার্থ উদ্ধার করে, ক্ষমতায় যায়, শোষণ করে, দেশের সম্পদ তছরুপ করে, তাদের কথায় বিশ্বাস করবো না, ভোট দিবো না- এ হোক অঙ্গীকার।
