Detail

Home - উন্নয়ন - প্রবন্ধ: ‘সড়ক দূর্ঘটনায় আমাদের নিজের অবস্থান কী?’ – সফিকুল ইসলাম

প্রবন্ধ: ‘সড়ক দূর্ঘটনায় আমাদের নিজের অবস্থান কী?’ – সফিকুল ইসলাম

১.

এক বছরে সারাবিশ্বে ক্ষুধায় মারা যায় ১৫ হাজার, আত্মহত্যায় দু লাখ, সড়ক দূর্ঘটনায় আড়াই লাখ, নেশা করে আট লাখ, রাজনৈতিক বা ধর্মযুদ্ধে দশ লাখের বেশি। কিন্তু করোনায় মাত্র তিন হাজার, তবু করোনায় আতঙ্ক বেশি। করোনার সমাধান জানিনা, অন্যগুলোর প্রতিকারপথ আমরা জানি। তাহলে কী দাঁড়ালো?

যেসব বিষয়ের সমাধান বা প্রতিকার আমরা জানি তা বাস্তবায়ন না করে আমরা তাতে নিজেকে সঁপে দিই। আর যেসব বিষয়ের প্রতিকার বা সমাধান আমরা জানিনা, সেসব বিষয়ে হুদাই আতঙ্কে থাকি আর দুনিয়ার টাকা ঢালি। সড়ক দূর্ঘটনার সমাধান বা প্রত্যেকের করণীয় সবাই জানি, তবু করোনার জন্য যতটা সিরিয়াস ইচ্ছা ও ফান্ডিং এর উদারতা ছিল, সড়ক দূর্ঘটনার জন্য তা নেই।

 

.২.

প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন যেমন সিন্ডিকেট রয়েছে, সড়ক দূর্ঘটনার কারণগুলো খুঁজলেও এরকম সিন্ডিকেট পাওয়া যাবে। সিন্ডিকেটকে দমানো খুবই কঠিন কাজ। গার্মেন্টসে আগুন, গার্ডার দূর্ঘটনা, সড়ক দূর্ঘটনা, ফর্মালিন আমদানী ও অপব্যবহার, সর্বত্র মাদক ইত্যাদির পেছনে কারা? এরা লোটেরা শ্রেণী, এরা এলিট, এরা কোটিপতি, এরা অতি মুনাফা লোভী, এরা আইনের ঊর্দ্ধে, এরা কথিত ও স্বীকৃত ভদ্রলোক। সুতরাং সহজ কোনো সমাধান নেই। একারণেই দেখা যায় যে, সচিব, মন্ত্রী, আমলা, এসপি, ওসি, বিআরটিএ ইন্সপেক্টর, নেতা, পেশাজীবী, কৃষক, শ্রমিক সকল শ্রেনীর লোকই সড়ক দূর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরপরও আমরা জাগিনি। মোটরযান আইনে মোবাইল কোর্ট করতে গেলেই প্রচুর ফোন আর তদবির পাওয়া যায়। পরে ফোন বন্ধ করেই কাজ করতে হয়। অদক্ষ ও অবৈধ ড্রাইভার আর অবৈধ গাড়ির পক্ষে যারা তদবির করেন বা ছেড়ে দিতে বলেন তাদের প্রতি ধিক্কার জানানো ছাড়া কিছু বলার নেই।

.৩.

সড়ক দূর্ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এমনকি লেখকরাও অন্য লেখা ছেড়ে দিয়ে এ নিয়ে আলোচনা করে। মানুষ লেখালেখি না পড়লেও গরম গরম আলোচনা শুনতে ভালোবাসে। তাহলে লেখক কেন লিখবেন। অন্য যেকোনো কাজই তো লেখার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, আপনি টাক নিয়ে একটা ছড়া লিখছেন। এই সময় একজন আপনাকে ফোন করলেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা। আপনি বললেন, আমি একটা ছড়া লিখছি। তিনি বলতেই পারেন, রোজ বাংলাদেশে ৬০ জন মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। আমরা যদি একটা দুর্ঘটনা রোধ করতে পারি, পাঁচটা লোকের জীবন বাঁচবে। আপনি ঠিক করুন এখন, আপনি টাক নিয়ে কবিতা লিখবেন, নাকি ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের আলোচনা করবেন। পৃথিবীর অন্য যেকোনো কাজ লেখালেখির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা যদি আপনি জেনে যান, তাহলে আপনি আর লেখক হতে পারবেন না। তাই বাংলাদেশে লেখালেখি বা সাহিত্য কম। বরং আলোচনা বেশি। এমনকি সড়ক দূর্ঘটনা নিয়েও আলোচনা বেশি। কিন্তু কাজের বেলায় কেউ নেই। লেখকও নেই, অলেখকও নেই। যার যেটা করা উচিত সে তা করছে না, লেখকের লেখা উচিত লিখেন না। আর সড়ক বিষয়ক স্টেকহোল্ডারদের কাজে নামা উচিত, তারা কাজে নামছে না। আপনাকে এই রকমের একটা বিশ্বাস ধারণ করতে হবে যে আপনি এই কবিতাটা, এই ছড়াটা না লিখলে বা আপনি এই ছবিটা না আঁকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনার লেখাটা এমনই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই লেখা ভালো হবে। আর সড়ক বিষয়ক স্টেকহোল্ডারদের ভাবতে হবে যে তাদের পরিকল্পনা করা ও কাজে নামা মানে মানুষের জীবন মরণ সমস্যার সমাধান। তবেই সড়ক দূর্ঘটনা রোধ হবে।

.

৪.

জাপানে ট্রেনে চলাকালে ড্রাইভারকে খেয়াল করতাম। এক স্টেশন থেকে ছাড়ার আগে-পরে-মাঝে সে দাঁড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করে, আবার এক হাতের নাকের কাছে নিয়ে মেলে ধরে, আবার কাঁধে ছোঁয়ায়, আবার দরজায় আসে, আবার চালকের আসনে যায়।

তথা তার গতিবিধি, নড়নচড়ন, চাহনি, আর হাতপা ছোঁড়া দেখলে যে কেউ বলবে- যে পাগল মনে হয়। হাফ-মেন্টাল নাকি? পরে অনেকদিন খেয়াল করে বুঝলাম যে এসবগুলোই সে বারবারই করে প্রতি স্টেশনের আগে পরে মাঝে।এবং খুবই সিস্টেমেটিক ওয়েতে। এর সাথে ট্রেন থামানো, সিগনাল ধরা বোঝা, দরজা খোলা ও বন্ধ করা সব কানেকটেড।

 

বিষয়টার কারিগরি দিক আমি জানিনা। তবে এটুকু বুঝলাম যে কোনভাবেই যেন চালক বেখেয়াল না হয়, কোনভাবেই যেন সে ভুলোমনা না হয়, কোনভাবেই যেন তার হাতের কাজে চোখের দেখায় কোন কিছু মিস না হয় সে কারণে সে নিয়ম করে এটি করতে থাকে। তাতে করে তার শরীর-মন-হাত-পা-চোখ-মাথা একনিষ্ঠ হয়ে জিরো ডিফেক্টে কাজ করতে পারে।

এজন্যই তারা জাপানিজ।

 

৫.

আমাদের দেশে চালকগণ এরকম সিরিয়াসনেস নিয়ে গাড়ি চালান না। আর সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেভাবে চালকদেরকে প্রস্তুত করছেন না। ট্রেনিং, বিশ্রাম, বেতন  ইত্যাদি দিচ্ছেন না। মোটিবেশন বা সচেতনতাও নেই। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলে রাস্তাঘাটে। তাই প্রতিবার দূর্ঘটনা ঘটে আর দূর্ঘটনায় নিহতদের কথা ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছি। চালক বা স্টেকহোল্ডারদের কারোা কোন অবহেলা আছে কিনা তা বিশদভাবে খতিয়ে দেখা দরকার- এ কথা বলেই আমরা ক্ষান্ত হই। কাজের কাজ কিছু করি না।

সবাইতো বলে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কে কাজ শুরু করবে, উদাহরণ তৈরি করবে। শুরু হোক আমার থেকে, আমার ঘর থেকে।

 

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart