Detail

Home - অভিজ্ঞতা - প্রশিক্ষণের স্মৃতি ও কিছু গল্প

প্রশিক্ষণের স্মৃতি ও কিছু গল্প

আমাদের পিটি বা মর্নিং ওয়াক শুরু হয় ইনডোর স্পোর্টস রুমে ওয়ার্মআপ দিয়ে। এ ওয়ার্মআপটি সবুজ মাঠে হলে ভালো হতো। সকালে গিয়ে সবুজ মাঠের দিকে আফসোস নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু মাঠে নামা যেতো না। কারণ মাঠ কর্দমাক্ত। মাঠটি কি এরকমভাবে তৈরি করা যায় না যা সারাবছর সবসময় খেলার উপযোগী থাকবে? একটি বড় প্রকল্প নিলে তা সম্ভব। সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর তা আছে। সিভিল সার্ভিসের সবচাইতে বড় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে এরকম একটি মাঠ থাকা বাঞ্চনীয়। দিগন্ত জুড়ে সবুজ মাঠে বুক ভরা শ্বাস নিয়ে ওয়ার্মআপ করার মধ্য দিয়ে সকালের হাঁটা শুরু হলে ভালো হতো। অবশ্যই  আমাদের হাঁটার সুন্দর একটি ট্র্যাক রয়েছে, যেখানে আমরা পুরো বিপিএটিসির চারপাশের সবুজায়ন দেখতে দেখতে হাঁটি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পাখি দেখি, দেখি বানর বা অন্যান্য প্রাণী। একজন আইএএস অফিসারের আত্মজীবনীতে লেখা আছে—মাশুরি’র লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল একাডেমিতে সকালে কুচকাওয়াজ চলছিল। হঠাৎ এক ঝাঁক ময়ূর এসে মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং তাদের পেখম মেলে নাচ শুরু করে। প্যারেড চলাকালে সবাই এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে মুহূর্তেই ডিসিপ্লিন ভুলে গিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে ময়ূরের নাচ দেখছিল! পরে ইনস্ট্রাক্টরও হেসে ফেলেন, কারণ এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না। আমাদের সাথেও যদি বানরের দল একদিন পিটি করতো তাহলে মন্দ হতো না!

আমাদের সবাইকে সাদা ক্যাডস, পলো ও ট্রাউজার আনতে বলা হয়েছে। আমরা সবাই আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুই একজন ব্যতিক্রম করেছে। অবশ্য এতে স্পোর্টস ইন্সট্রাক্টর আপত্তি করেননি। তাঁরাও মনে করেন যে, ভালো ব্রান্ডের শাদা ক্যাডস খুব একটা পাওয়া যায় না। অথচ হাঁটার জন্য ভালোর মানের ক্যাডস জরুরি। অন্যথায় মেরুদন্ড বা পায়ের টিস্যুতে ব্যথা হতে পারে। যা-ই হোক, আমাদের একেকজন একেকরকম ঘটনা ঘটায়। কেউ ভিন্ন কালার ক্যাডস পরে তো, কেউ ভিন্ন কালার পলো পরে। কেউ বা আবার ঘুমের ঘোরে উল্টা জামা পরে চলে আসে। এটা যে শুধু আমাদের এখানে হয় তা নয়। প্রাক্তন এক সিএসপি অফিসার লিখেছেন, একবার ট্রেনিং-এর সময় সকালে ভুল করে সিভিল ড্রেসের বদলে গেমস ড্রেস পরে ক্লাসে ঢুকে গিয়েছিলেন। সবাই হেসে লুটোপুটি খেয়েছিল। পরে সেই অফিসারকে লেকচার থিয়েটারে দাঁড়িয়ে দুঃখিত বলতে হয়েছিল—এটাও ছিল ট্রেনিং-এর অংশ।

২। লার্নিং পয়েন্টস লেখার ধারণাটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো ধারণা। এবং রিক্যাপ করে তা ক্লাসে প্রেজেন্টেশন দেওয়া আরও উত্তম ধারণা। এ নিয়ে শুরুতে একটু ঝামেলা হলেও আমরা ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠলাম। প্রথম দিনের প্রেজেন্টেশনে আমার নাম আসলো। প্রিপারেশন ছিল বিধায় ভালোভাবেই উতরে গেলাম। তবে যেটা হয় প্রেজেন্টেশন ডায়াসে গেলে আমাদের পা কাঁপা স্বাভাবিক। যে শব্দ এমনিতে স্পষ্ট উচ্চারণ করি, সেটাই ওখানে গেলে আমতা আমতা হয়ে যায়। তেমনই কয়েকজনের হচ্ছিল। এটা যে কেবল আমাদের হয় , তা নয়।  ভারতের এক আইএস অফিসার লিখেছেন, পাবলিক স্পিকিং সেশনে তিনি খুব জোরে বলে ফেলেছিলেন, “আমি আপনাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি… কারণ আপনাদের দেখে আমিও খুব আনন্দিত।” সবাই হাসতে হাসতে কাবু! ট্রেনার বলেছিলেন, “একটু ধীরে বলো, অন্তত মাথায় গুছিয়ে নাও!” ড. আকবর আলি খান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ট্রেনিং এর শুরুর দিকে একদিন রাতে সার্কেল মিটিং চলছিল। সেখানে সবাইকে বলতে বলা হলো– ‘নিজের নাম, জেলা আর এক লাইন মজার কিছু।’এক বন্ধু উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে বলল: “আমার নাম তো আপনারা জানেনই…” স্যার বললেন, “কিন্তু আমরা তো জানি না, বলো।”সে এতটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে কয়েক সেকেন্ড নিজের নামই ভুলে গিয়েছিল! পরে সবাই এত হেসেছিল যে পরের দুই দিন তার ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘আমার নাম কি?’

আসলে মঞ্চে গেলে একটু ঝামেলা হয়ই। মাহবুব তালুকদার (আমার সাতকাহন) লিখেছেন—ট্রেনিং একাডেমিতে প্রথম বড় প্রেজেন্টেশন এর ঠিক আগের রাত: “ঘুমোতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল মুখ খুললেই গলা কাঁপবে। সারা রাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি—আয়না আমার কণ্ঠস্বর শুনেছে, কিন্তু ঘরের দেয়াল আমার ভয় শুনেছে।” পরের দিন প্রেজেন্টেশনে গিয়ে প্রথম তিন মিনিট কথাই বের হচ্ছিল না—শেষে ধীরে ধীরে গলা খুলে গিয়েছিল।
তিনি লিখেছেন, সেই রাত শিখিয়েছিল ‘ভয় কাটাতে হলে ভেতরে ঢুকে দেখতে হয় সেই ভয়ের মুখ’

৩। ট্রেনিং শুরু হওয়ার দুদিন পরেই প্রায় সবাই ডায়রিয়াতে আক্রান্ত। শুরুতে কয়েকজন ডায়রিয়া হলেও লুকিয়ে রেখেই পিটিতে অংশ নেয়। এক মারাত্মক অবস্থা! পরে চেপে রাখতে না পেরে যখন কয়েকজন মুখ খুললো, পরে দেখা গেলো প্রায় সবাই ডায়রিয়াতে আক্রান্ত! তদন্তে জানা গেলো পানিতে সমস্যা। সব কোর্সেই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বিপিএটিসির ইতিহাসে একটি দুর্লভ দুর্ঘটনা। যা-হোক, বেশ কয়েকদিন সমস্যা থাকলো। সবাই পানি কিনে খেতে থাকলো। আর ডায়নিংয়ে সেদ্ধ করে পানি খাওয়াচ্ছে। আমাদের অবশ্য রান্না করতে হয় না, সিএসপিদের নাকি রান্না করা লাগতো। মাহবুব তালুকদার তার আমার সাতকাহন বইতে লিখেছেন, ট্রেনিং একাডেমিতে কমিউনিটি লিভিং প্রোগ্রামে নিজেদের রান্না করতে হত। একবার তিনি এবং তার বন্ধুরা রুটি বেলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তারা তিনজনে মিলে একেকটা রুটি বেলতেন, কিন্তু ফ্রাইং প্যানে দেবার পর সেই রুটি ফুলে না গিয়ে আরও কুঁচকে যেত! সবাই মজা করে বলেছিল, “এগুলো রুটি নয়, বাংলার মানচিত্র!”

৪। এসিএডি কোর্সের ক্লাসগুলো সব জ্ঞানগর্ব বক্তৃতায় ঠাসা। প্রচুর জানার সুযোগতো আছেই। অ্যাকাডেমিক কনসেপ্টের কচলাকচলির পাশাপাশি রিসোর্স পারসনদের জীবনের অভিজ্ঞতাও আমাদের জানার আগ্রহকে তাড়িত করেছে। সিরিয়াস আলোচনার সময় যেমন কারও কারও ঘুম পেয়েছে, তেমনই প্রশ্ন ও মতামত প্রদানের মাধ্যমে পুরো ক্লাস জমে উঠেছে মাঝে মাঝে। বিশেষ করে কোনো কোনো খ্যাতিমান রিসোর্স পারসনদের সেশনগুলো আমাদেরকে উজ্জীবিত ও শাণিত করেছে। হাস্যরস ও গল্পের মাধ্যমেও যে অ্যাকাডেমিক আলাপ করা যায় তা জানলাম দুদকের সম্মানিত চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্যারের কাছে। সিভিল সার্ভিস ও পেশাদারিত্ব শিরোণামের ক্লাসে স্যার অর্ধ শতাধিক গল্প বলে আমাদেরকে পেশাদারিত্বের সকল কনসেপ্ট বুঝিয়েছেন। সেখান থেকে দুটি গল্প দিচ্ছি।

দুদক একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি বন্ধে এর স্টাফদের প্রফেশনালিজম তথা দুর্নীতিমুক্ত থাকা দরকার। দুদকের দুর্নীতি কমেছে কিনা – এ প্রশ্ন দুদকের চেয়ারম্যান একবার নিজেই নিজেকে করে, নিজেই উত্তর দিলেন একটি গল্প বলার মধ্য দিয়ে। ‘’আমি কেইস এনোটেশন শিখেছিলাম বিচারপতি রুহুল আমিনের কাছে। জনাব রুহুল আমিন প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে আরেকবার দেখা করতে যাই। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে আদালতপাড়ায় ঘুষ দুর্নীতি কমেছে কতটা? প্রধান বিচারপতি হেসে উত্তর দিলেন, ‘’ আগে টেবিলের উপর দিয়ে নিতো, এখন টেবিলের নিচ দিয়ে নেয়’’! এ গল্প শোনার পরে আর দুদকের দুর্নীতি কমেছে কিনা এ প্রশ্ন করা মুশকিল।

আমেরিকার ৫০ বছর বয়স্ক এক লোক ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করলো, আমেরিকার মূদ্রাস্ফিতি কত বছর পরে বন্ধ হবে? ঈশ্বর বললেন, ১০০ বছর পর। লোকটি হতাশ হলো, মনে মনে ভাবলো তার জীবনে আর তা দেখা যেতে পারবে না। তারপরে রাশিয়ার ৭০ বছর বয়স্ক এক লোক ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করলো, রাশিয়ার দারিদ্র্যতা কত বছর পরে কমবে? ঈশ্বর বললেন, ৫০ বছর পর। লোকটি হতাশ হলো, মনে মনে ভাবলো তার জীবনে আর দারিদ্র্যমুক্ত রাশিয়া দেখা যেতে পারবে না। সবশেষে বাংলাদেশের ৩০ বছর বয়স্ক এক লোক ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করলো, বাংলাদেশের দুর্নীতি কত বছর পরে বন্ধ হবে? ঈশ্বর চিন্তিত হলেন, কিছুক্ষণ ভেবে বললেন যে, ’’ আমি ঈশ্বর, তবু আমার জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পারবো না’’!

.

-ড. সফিকুল ইসলাম, রোল ১০২, ১৫৩তম এসিএডি কোর্স

(সূত্র: ঘটক ছাড়া বিয়ে – ড. আকবর আলি খান; আমার সাতকাহন – মাহবুব তালুকদার;  কিছু অবসরপ্রাপ্ত বিসিএস অফিসারদের মুখে বলা স্মৃতি ;  ভারতের আইএস অফিসারের বই: The Service of the State – M.K. Kaw, No Regrets – B.G. Deshmukh)

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart