সিভিল সার্ভিস ও পেশাদারিত্ব -সফিকুল ইসলাম
পেশাদারিত্ব বা professionalism কেবল একটি আচরণগত শৃঙ্খলা নয়; এটি হলো নৈতিকতা, জ্ঞান, দক্ষতা ও দায়িত্ববোধের এক সমন্বিত রূপ। সিভিল সার্ভিসে পেশাদারিত্ব রাষ্ট্র পরিচালনার অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সুশাসন ও জনকল্যাণের জন্য অপরিহার্য। পেশাদারিত্ব বলতে বোঝায় নিরপেক্ষতা, সততা ও স্বচ্ছতা, জনসেবার প্রতি অঙ্গীকার। ম্যাক্স ওয়েবারের আমলাতন্ত্র তত্ত্বে বলা হয়েছে, আমলাদের হতে হবে নিয়ম-কানুন ও প্রক্রিয়াভিত্তিক, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং পেশাগত যোগ্যতায় নিযুক্ত। আবার, টেলকট পারসন্সের গঠনমূলক তত্ত্ব (structural functionalism) অনুযায়ী, সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তার নিজস্ব ভূমিকা পেশাদারভাবে পালন করতে হবে যাতে সমগ্র সমাজের ভারসাম্য রক্ষা হয়।
প্রফেশনালিজম কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দুদকের সম্মানিত চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন কয়েকটি গল্প ও অভিজ্ঞতা বলেছেন,
’’তেজগাঁও এলাকার এক বড় ভাই ছিলেন, তিনি চিড়িয়াখানায় চাকুরি করতেন ও বাঘের যত্ন নিতেন। তিনি বাঘ বিষয়ে অনেক পড়াশোনা করতেন, বাঘের যত্ন নেওয়া বিষয়ে তাঁর আন্তরিকতা, প্যাশন, ভালোলাগা ও কর্মতৎপরতা প্রশংসনীয় ছিল। তাঁর কাজ দেখে ও তার কথাবার্তা শুনে বোঝা যেতো যে, তিনি তার কাজটাকে অনেক ভালোবাসেন। যে কারণে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘বাঘা ভাই’’। নিজের নামকে ছাপিয়ে তিনি বাঘা ভাই নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এটা তার পেশাদারিত্বেরই নমুনা।’’
’’অন্য গল্পটি এরকম, ‘’পৃথিবীর প্রথম পেশা কী এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পতিতাবৃত্তি পৃথিবীর আদিমতম পেশা বলা হয়ে থাকে। তবে চিকিৎসকরা দাবি করলেন যে, তাদেরটাই পৃথিবীর প্রথম পেশা। কারণ আদমের পাজর কেটে তারাই প্রথম হাওয়াকে তৈরি করেছিলেন। তখন স্থপতিরা বললেন যে, আদমের ডিজাইন কে করেছে? আমরাই করেছি। ওদিকে প্রকৌশলীরা বললেন যে, ফেরেশতাদের মধ্যে chaos বা ঝামেলা তৈরি হওয়ার পরে এই বিশৃংখলা ঠিক করলো কে? আমরা প্রকৌশলীরা এ বিশৃংখলা ঠিক করেছি বলেইতো মানুষ তৈরির প্রসঙ্গ এসেছে। তাই না? তখন রাজনীতিবিদ কাম উকিলের চটপট উত্তর ‘এবার বলেন, সেই chaos বা বিশৃংখলাটা কে তৈরি করলো?’’ নিশ্চয়ই আমরা! এগুলোও পেশাদারিত্ব বটে! নিজের পেশার প্রতি প্যাশন।
আরেকটি গল্প, একবার প্লাম্বারকে ডেকে আনা হলো বাড়ির পানির লাইন ঠিক করতে। ১ ঘণ্টা কাজ করে ঠিক করার পরে ১০ হাজার টাকা বিল চাইলো। বাড়ির মালিক ডাক্তার তাকে ধমক দিয়ে বললেন, জানো, আমি একজন ডাক্তার ও প্রফেসর। আমিও এক ঘন্টা ক্লাস নিলে বা কাজ করলে এত টাকা পাই না। তখন প্লাম্বারের ঝটপট উত্তর, এজন্যইতো আমি ডাক্তারি পেশা ছেড়ে প্লাম্বার পেশায় চলে এসেছি! ভালোভাবে কাজ শিখে এখন বেশি বেতন কামাচ্ছি! নিজের পেশার বিস্তারিত জানা ও সেভাবে পারিশ্রমিক আদায় করতে পারার আত্মবিশ্বাসও পেশাদারিত্ব।
সিভিল সার্ভিসকে গালি দেওয়া সহজ, তাই সবাই গালি দেয়। রাজনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের সবাই সারাক্ষণ সিভিল সার্ভিসের সমালোচনা করে। সিভিল সার্ভিসের সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে ওনারা কাদেরকে গালি দেবে? কার উপর দোষ চাপাবে? তাই তারা চান না যে, আমলারা এগিয়ে যাক। কারণ এগিয়ে গেলে রাষ্ট্রের সকল দোষ চাপানোর মতো এমন ভদ্র নম্র মানুষজন কোথায় পাবে? সুতরাং আমলারা দক্ষতা, গুণে ও কর্মে পিছিয়ে থাকুক- তা সুশীল সমাজ চায়। তাতে করে তাদের সমালোচনা পেশা বিজয় কেতনসহ টিকে থাকবে। এই যে নিজ নিজ পেশাকে এগিয়ে রাখার চেষ্টা, এটাও পেশাদারিত্ব! সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের উচিত তাদের প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড বাড়ানো। জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের উচ্চাসন ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আগের দিনে জেনারেলিস্টদের গুরুত্ব ছিল। এখনও আছে। তবে বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের এ যুগে জেনারেলিস্ট ও মাল্টিডিসিপ্লিনারি হওয়ার পাশাপাশি কিছু বিষয়ে স্পেশালাইজড জ্ঞান থাকাও জরুরি। তাই আমরা যারা জেনারেলিস্ট, তাদের উচিত সুযোগ পেলেই কোনো সেক্টর বা বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। নিদেনপক্ষে যেখানে কাজ করবো সেখানকার বিস্তারিত আইন, কানুন, ইতিহাস ও পূর্বাপর বিস্তারিত ওয়াকিবহাল হয়ে কাজ করা। পড়াশোনা না করে, মনোযোগ না দিয়ে এটা সম্ভব না।
যেমনটা বলছিলেন বিমানের সাবেক সম্মানিত এমডি ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন । তিনি যখন বিমানের এমডি ছিলেন, তখন বিমানের লস হচ্ছিল। বিমানের মোট ওজন ও ওজন বহনের সক্ষমতা জেনে, নিজেই হিসেব করে বের করলেন যে, একটি বিমান একটি যাত্রায় কতজন যাত্রী ও ব্যাগেজ নিতে সক্ষম হবে। একটি বিমানের মোট বহন ক্ষমতা থেকে বিমানটির ওজন বাদ দেওয়ার পরে যা থাকে তাতে প্রায় ১২০ জন যাত্রী বহন সম্ভব। যেখানে মাত্র ৮০ জন বহন করা হয়। এর মধ্যে আবার কিছু সিট বিজনেস ক্লাস ট্যাগ দিয়ে বাড়তি জায়গা নেওয়া হয়েছে। এ সিটগুলো তদবিরের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ ব্যবহার করেন। তাতে দেখা যায় বিমান বাড়তি ভাড়া পান না। দুটি বিষয়কে চিন্তা করে একটি বিমানে ১২০টি সিট বসানো যায় কিনা- তা জানতে ট্যাকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়। তারা জানান যে, ১২০ জন সম্ভব নয়, তবে ১১৫ জন সম্ভব। পরে সেটা বাস্তবায়ন করা হলো। মানে ৩৫ জন প্যাসেঞ্জার বাড়ানো হলো প্রতি ট্রিপে। কোনো বিজনেস ক্লাস সিট রাখা হয় নি। তাতে দেখা যায় যে, বিমানের আয় বাড়লো। তথা জেনারেলিস্ট হিসেবে তাঁর চিন্তায় যে বুদ্ধি খাটলো- তা দিয়েই ট্যাকনিক্যাল একটি সমাধান হলো। উক্ত এমডি যখন গফরগাঁওয়ের ইউএনও ছিলেন, তখন ওখানকার ইপিআই পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য তৎকালীন মন্ত্রীপরিষদ সচিব ভিডিও কলে কথা বলেছিলেন। ইপিআই বিষয়ে পড়াশোনা করে তথ্য সংগ্রহ করে এমন করে ইউএনও সাহেব বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, তৎকালীন মন্ত্রীপরিষদ সচিব মুজিবুল হক গফরগাঁওয়ের ইউএনওকে ’ডাক্তার সাব’ হিসেবেই সম্বোধন শুরু করলেন। তিনি যখন ঢাকার ডিসি হলেন, তখন উক্ত মুজিবুল হক স্যার পারিবারিক কাজে ডিসি অফিসে দেখা করতে গিয়ে অবাক হলেন। ”আরে, ডাক্তার সাহেব?” আসলে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ডাক্তার নন। কেবল তাঁর একটু আগ্রহ, একটু আন্তরিকতা, জানার ইচ্ছা তাকে এগিয়ে দিয়েছিল। তথা নিজের পেশা, সেক্টর ও দাপ্তরিক বিষয়ে সবিস্তারে জানাটা পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে।
সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদেরকে তিনটি বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। জনসেবা সহজীকরণ ও প্রদান, সরকারি সম্পদের যথার্থ ব্যবহার, ও পলিসি প্রণয়নে দক্ষ হওয়া। পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। Transparency and Accountability শব্দ দুটি অধুনা জনপ্রিয় হলেও এদের উৎপত্তি যথাক্রমে ১৫৯১ সালে ও ১৭৫০ সালে। অনেক আগে উৎপত্তি হলেও এখনও বাংলার মানুষের মনে তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। কর্মকর্তাদেরকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। প্রয়োজনে বদলি হবে বা চাকুরি চলে যাবে, তবুও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। বর্তমানের সরকারি কর্মকর্তাদেরকে পড়াশোনা, লেখালেখি বা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ নানা সৃষ্টিশীল কাজে দক্ষতা অর্জন করে রাখতে হবে। যাতে করে চাকুরি চলে গেলেও ভিন্ন কর্ম করার, বেঁচে থাকার ও ইনকামের বিভিন্ন সুযোগ খোলা থাকে। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সরকারি চাকুরিজীবির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে তা করা হয় না। নতুন প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃজনে যুক্তরাষ্ট্র রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করে। যে কাজ আউটসোর্সিং করা যায়, যে কাজ প্রাইভেট পাবলিক পার্টনাশিপে করা যায়, যে কাজ প্রাভেইটাজাইশনে করা যায়, সে কাজের জন্য দপ্তর খোলা বা পদ সৃজন জরুরি নয়। সুতরাং কম জনবলে বেশি কাজ করার বিদ্যা অর্জন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম বা পেশাদারিত্বই আমাদেরকে সহযোগিতা করতে পারে।
আগে বলা হতো আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। কারণ রাজনীতিবিদরা আমলাতন্ত্রকে চাপ দিয়ে কাজ করাতেন। আর এখন প্যারাডাইম শিফট হয়েছে। আমলাদের অনেকেই নিজেরাই রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়, পলিটিসাইজড হয়ে যায়। তথা নিজেরাই নিজেদের শুইয়ে দেয়। প্রফেশনালিজম, স্পিরিট ও ওনারশিপ থাকলে অনেক কাজ করা যায়। নিজের সুনামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম কুড়ানো যায়। আগে ভূমি মন্ত্রণালয় একটু কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছিল। সচিব মোকাম্মেল স্যার পদায়ন পাওয়ার পরে দেখা গেলো যে, তাঁর কাজের মাধ্যমে উক্ত মন্ত্রণালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং পদ বা কর্মস্থল নয়, কর্মকর্তাই পারে পদকে গুরুত্বপূর্ণ করতে যদি তার প্রফেশনালিজম, প্যাশন, স্পিরিট ও ওনারশিপ থাকে।
আমলাতন্ত্র মানে আগে বোঝানো হতো ‘’How not to take decision’’ । আর এখন আমলাতন্ত্র মানে ‘’How to take decision wisely and efficiently’’.। আগের অবস্থান থেকে আমাদেরকে নতুন প্যারাডাইমে যেতে হবে। যথাসময়ে কাজ করলে ও যথানিয়মে কাজ করতে গেলে রাজনীতিবিদদের বিরাগভাজন হতে হয়। কিছু করার নেই। আগেও ছিল, এখনও আছে। ভারতে একবার এক সচিবকে (আইএস অফিসার) এক মন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় গালি দিলেন। বললেন যে, চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেবো। জনসভা শেষে সেই মন্ত্রী আবার সচিবের কাছে গিয়ে সচিবের হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন। মন্ত্রী বললেন, ’’সচিব সাহেব, আমার কিছু করার ছিল না, এটা না বললে জনতাকে থামানো যেতো না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি জানি আপনি সঠিক কাজটিই করেছেন।’’ তেমনি এরশাদ আমলের মন্ত্রী জনাব কাজী জাফর একবার তার ইউএনওকে প্রকাশ্য জনসভায় ’’ইউএনওর চামড়া তুলে নেবেন’’ বলে বক্তব্য রাখেন। পরে বিকেলে ট্রেনে ফেরার সময় আবার মন্ত্রী ইউএনওকে সহাস্যবদনে ট্রেনে পাশের সিটে বসতে বললেন। ইউএনও সাহেব মুখ ভার করে গম্ভীরতাসহ গালাগালির কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন যে, ‘’ওটা না করে উপায় ছিল না, জনতাকে খুশি করতে বলতে হয়। তখন ইউএনও সাহেব বলেছিলেন যে, ’’আমি চলে গেলেও অন্য কোনো ইউএনও আসবে। আপনি কয়জনের চামড়া তুলবেন?’’ মন্ত্রী হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি ওটা এমনিই বলেছি। আমি জানি আপনি সঠিক কাজ করেন। তাহলে বোঝা গেলো আমলারা সঠিক কাজ করলে গালাগালি খেলেও রাজনীতিবিদরা সমীহ করেন। এখন অবশ্য সেই যুগ নেই। একজন ইউএনও বা সচিব অন্যায় না করলে, আরেকজন এসে পোস্টিং নেবে ও সেধে সেধে অন্যায় কাজ করবে। তথা আমি সততার সুরক্ষায় অনিয়ম না করলে, আমাকে সরিয়ে দিয়ে আমারই ব্যাচমেট এসে এসব করে রাজনীতিবিদদের প্রিয় হতে চাইবে। যে কারণে সময়টা কঠিন হয়ে গিয়েছে।
২০০৮ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মা ইং জিউ । হার্ভার্ড ফেরত এ প্রেসিডেন্টের ছিল প্রচন্ড জনপ্রিয়তা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে। পরে জনসভাতে গেলে দর্শকরা জুতা ছুড়তে শুরু করলো। এ থেকে বাঁচার উপায় কী? আমলারা বুদ্ধি দিলেন যে, মঞ্চের সামনে স্বচ্ছ কাঁচের বেড়া থাকবে। তাহলে জুতা গায়ে লাগবে না! এবং এভাবেই চালিয়ে গেলেন। জুতা গায়ে লাগেনি বটে, কিন্তু জুতা ছোড়া বন্ধ হয় নি। আসলে এরকম বুদ্ধি দাতা আমলাদের দ্বারা রাষ্ট্রের সমস্যার প্রকৃত সমাধান হয় না। সত্যিকার বুদ্ধি দিতে হলে আমলাদের পড়াশোনা যেমন লাগে, তেমনি মেরুদন্ডও থাকা লাগে। পড়াশোনা ও মেরুদন্ড থাকাই হলো প্রফেশনালিজম।
আরেকবার আরেক দেশের এক প্রেসিডেন্ট নিজের নাম ও ছবি স্মরণীয় করার জন্য নিজের ছবি দিয়ে পোস্টাল স্ট্যাম্প ছাপালেন। সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। কয়েক মাস যাওয়ার পরে কয়েকজন গবেষককে পাঠানো হলো দেখার জন্য কেমন চলে এ স্ট্যাম্প। পরে দেখা গেলো যে, স্ট্যাম্প বিক্রি হয় নি। পরে আরেকদল গবেষক পাঠানো হলো এর কারণ জানতে। বাস্তবে গিয়ে জানা গেলো যে, লোকজন থুথু কোনদিকে দিবে তা ঠাহর করতে পারছে না। যেদিকে তারা থুথু দিতে পছন্দ করছে, সেদিকে থুথু দেওয়ার পরে আর স্ট্যাম্প লাগানো যাচ্ছে না! কাজ না করলে কেবল ভিত্তি প্রস্থর, ছবি ও মূর্তি স্থাপন করে মানুষের মানে স্থান পাওয়া যায় না। তাই বলা যায়, কাজই প্রফেশনালিজম!
সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাজ ব্যাক্তিগত কারিশমা দেখানো নয়, বরং সিস্টেম বদলানো। যাতে করে পদ্ধতি পরিবর্তনের কারণে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। মেট্রো রেলে লাখ লাখ যাত্রী যাচ্ছে। কেউ ভাড়া না দিয়ে যেতে পারছে না। সবাই খুশিমনে ভাড়া দিচ্ছে। অথচ আমাদের রেল সেক্টরে প্রতি বছর লস হয়, অনেকেই ভাড়া না দিয়ে রেলে চড়ে। কারও মনে টিকেট কাটার জন্য মেট্রো রেলের মতো সিস্টেম দাঁড় করানোর কথা মাথায় আসলো না। কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হয়, রেলের বড় বড় প্রকল্প হয়, অথচ মেট্রো রেলের মতো টিকেট সিস্টেম করলে সহজেই রেল লাভজনক হতে পারে। যথাযথ সিস্টেম বা পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণমানুষের সমস্যা সমাধানের নামই প্রফেশনালিজম।
সিভিল সার্ভিসকে রাজনীতিবিদদের নজরে কাজ করতে হয়। যে কোনো সিদ্ধান্ত ও কাজ বাস্তবায়নের আগে রাজনৈতিক ফিজিবিলিটি চেক করে নেওয়া ভালো। অন্যথায় সফল হওয়া যায় না। একবার ঢাকার এক জেলা প্রশাসক পিলখানার জিগাতলা গেইট থেকে পিলখানার ভিতর দিয়ে একটি রাস্তা আজিমপুর কবরস্থানের পাশ দিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। আজিমপুর কবরস্থানের কিছু কবর ভাঙ্গা পড়বে, তবে তার জন্য বিকল্প সমপরিমাণ জায়গাও অন্য পাশ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিজিবি রাজি হয়েছিল জনস্বার্থে। কিন্তু কিছু কবর ভাঙ্গা হবে – এ অজুহাতে স্থানীয় কাউন্সিলর এলাকায় আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে তা সফল হয় নি। তথা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে আগে থেকে সমন্বয় না করার কারণে একটি ভালো উদ্যোগ সফল হয় নি।
আমি যখন মতলব উপজেলায় কাজ করি তখন মতলব বাজারের ভেতরে মেইন মোড়ে খুব সঙ্কীর্ণ ছিল। গাড়ির জ্যাম লেগে থাকতো। রিকশা ঘুরানোই কঠিন, সেখানে গাড়ি যাওয়া আরও কঠিন ছিল। ওখানে মতলবগঞ্জ জেবি পাইলট স্কুলের পুরাতন পরিত্যাক্ত মসজিদ ছিল। এলাকায় উত্তেজনা হবে ভেবে মসজিদ ভাঙ্গার সাহস কেউ করে নি। তবে আমি সকল রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক ও স্থানীয় লোকদের সাথে দফায় দফায় সভা করে বোঝাতে সক্ষম হই যে, এটি ভাঙলে কোনো সমস্যা হবে না। বরং মতলববাসীসহ লাখ লাখ লোকের জন্য উপকার হবে। রাস্তাটি প্রশ্বস্ত হয়, এতে জ্যামের সমস্যা অনেকাংশে কমে আসে। তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও স্টেকহোল্ডারদের সাথে ডিল করতে পারা, জনমতের পালস বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাও প্রফেশনালিজম। শর্ট টার্ম ভিশন নয়, কেবল বর্তমান সরকারকে খুশি করা নয়, ইন্সটিটিউশনাল ক্যাপাসিটি ও লিমিটেশন বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে সিভিল সার্ভিসের।
সরকারি কর্মকর্তা অবশ্যই মার্জিত পোষাক পরবে। স্থান কাল পাত্র বুঝে পোষাক ও বচন ঠিক করবে। সেন্স অব প্রপোরশন বা মাত্রাজ্ঞান সরকারি কর্মকর্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। বাড়তি কথা বা বাড়তি প্রমিজ করা সমীচীন নয়, মেপে কথা বলা ও সবসময় গোছানো জীবনযাত্রা পরিচালনা করা উচিত। আচরণে, কথায় ও কাজে এথিকস বা নৈতিকতার মানদন্ড ধরে রাখা উচিত। একজন ভালো সরকারি কর্মকর্তা কাজ সম্পন্ন করার কৃতিত্ব যেমন নেবেন, তেমনি ব্যর্থতার দায়ও নেবেন। এগুলোই প্রফেশনালিজম। সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা কতিপয় সচিবের বেফাঁস কথাবার্তা দেখেছি, যা সিভিল সার্ভিস সম্পর্কে গণমানুষকে নেতিবাচক ধারণা দেয়।
জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যখন মন্ত্রী তখন তার সচিব ছিলেন জনাব নাসিম। নাসিম সাহেব মঞ্জু সাহেবের পূর্ব পরিচিত, ইউনিভার্সিটির বড় ভাই। তো নাসিম সাহেব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবকে স্যার ডাকতেন না। অফিসের লোকেরা বলাবলি করতো, সচিবতো আপনাকে স্যার ডাকেন না! মন্ত্রী একটু বিরক্ত ছিলেন। এর মধ্যে এলাকার কিছু রাস্তার জন্য কিছু অর্থের ব্যবস্থা করতে বললেন সচিবকে। সচিব ’মে মাসে বরাদ্দ আনা যাবে না’ বলে এ অনুরোধ নাকচ করলেন। এরপর মন্ত্রী আরও বিরক্ত হলেন ও রাগ করলেন মনে মনে। এর মধ্যে সচিব ঠিকই রাস্তার জন্য অর্থ যোগাড় করলেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তখন মনে মনে বললেন যে, যে অর্থ আনতে পারে, সে স্যার না ডাকলেও হবে। অন্যরা কী বলে সেসব শোনার দরকার নেই। এসব ঘটনায় বোঝা যায় যে, আগে সচিবদের ক্ষমতা ছিল, মেরুদন্ড ছিল, নেটওয়ার্ক ও প্রফেশনালিজম ছিল এবং কাজ জানতো। এখনকার সচিবদের কী আছে প্রশ্ন করলে কী উত্তর হবে আমরা জানি। গত সরকারের এক যোগাযোগ মন্ত্রীর বাসার বাজার করার জন্য সচিব গিয়ে সকালে হাজিরা দেয়- এই হলো সচিবের সাম্প্রতিক মান!
এডওয়ার্ড হেল্থ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিল তখন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন রবিন বাটলার। তখনকার ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ক্যাবিনেট সেক্রেটারির এক উপসচিবকে চিঠি দিলেন অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। উপসচিব পত্রটি নিয়ে গেলেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারির কাছে। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার অফিসকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন যে ‘’ নির্বাচনের কয়েকমাস আগে এখন এ বরাদ্দ দেওয়া যাবে না’’ তাতে বিধি ভঙ্গ হবে। পরের দিন নিউজ হলো ‘’Butler Slapped on Prime Minister’’! তবু উপসচিব বা মন্ত্রীপরিষদ সচিবের কোনো ক্ষতি হয় নি। এটাই আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক সভ্যতা। আমাদের দেশে আমলাদেরকে এরকম প্রফেশনালিজম দাঁড় করাতে হবে। আবার রাজনীতিবিদদেরকেও এরকম প্রশ্রয় দিতে হবে। অন্যথায় আমলাতন্ত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনস্বার্থে কাজ করবে না।
সিভিল সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের ভাষা হবে খুবই ফরমাল। শুদ্ধ ভাষায় সঠিক টোনে কথা বলতে পারা ও যোগাযোগ করতে পারাও প্রফেশনালিজম। কোথায় কোন কাজ করতে হবে, কী করতে হবে তা বুঝে শুনে করতে হবে। সাবেক এক সচিব যখন সেন্সর বোর্ডের সভাপতি। তখন মাঝে মাঝে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন মুভি দেখতে। স্ত্রী নাকি আবদার করে তাই বাসায় ফেলে আসতে পারে না। পরে নিউজ হয়েছে সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত দেন বোর্ড সভাপতির স্ত্রী! এখানেই মাত্রাজ্ঞানের প্রশ্ন। স্পাউজ বা পরিবার কোথায় যাবে বা যাবে না, সেটাও জানা জরুরি। একবার এক অ্যাম্বাসেডারের স্ত্রী গিয়ে এক ফরমাল অনুষ্ঠানে গিয়ে অ্যাম্বাসেডরের চেয়ারে বসে পড়লেন। তাঁর দাবি, ’’আমি কি অ্যাম্বাসেডরের চেয়ে কম?’’ স্পাউজ সামলাতে পারাও প্রফেশনালিজম। কেবল স্পাউজই নয়, পরিবারের সদস্যগণকেও সামলাতে হবে। এক মুখ্য সচিবের ছেলেকে নাকি দেওয়া হয়েছিল একটি প্রফেশনাল সমিতির মাটি ভরাট ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মানের কাজ। এই যদি হয় অবস্থা, তবে প্রফেশনালিজম কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
ইমোশনাল নিয়ন্ত্রণও প্রফেশনালিজম। ইমোশনাল নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আপনার প্রফেশনালিজম প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সাবেক সচিব জনাব কামাল সিদ্ধিকী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন , একবার তাঁর দপ্তরে এক উকিল উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করায় কামাল সিদ্দিকী ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তার ঘাড় ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়েছিলেন। পরে উকিলদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদসভা ও আন্দোলন হয়েছিল। যত খারাপ আচরণই করুক, তাতে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু গায়ে হাত তোলা, ঘাড় ধরে সিড়ি দিয়ে নিচে নামানো- এগুলো অতিরিক্ত ইমোশন। ইমোশন নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কোনো একজন কবি বলে গেছেন, আবেগের সংযমই কবিতার ধর্ম। আমি বলবো আবেগের সংযমই আমলাতন্ত্রে প্রফেশনালিজম।
একজন প্রফেশনাল আমলার অবশ্যই সময়জ্ঞান থাকবে। কোথাও তিনি দেরি করা যাবে না। যথাসময়ে বা সময়ের আগে পৌঁছাতে হবে। তাতে করে অন্যরা সতর্ক থাকবে ও শ্রদ্ধা করবে। দেরি করা মানেই ওজন কমানো। ময়মনসিংহে সবসময় আদালত শুরু হতে দেরি করে। তাতে উকিলরাও অভ্যস্ত হয়েছিল। একবার একজন বিচারক নতুন পদায়িত হয়ে ময়মনসিংহে সকাল দশটায় গিয়ে আদালতে হাজির হন। কিন্তু উকিলরা নেই। পরে কয়েকদিন দশটায় আদালত শুরু করার কারণে পরে সকল উকিল অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়। অযথা দেরি করে আদালত শুরু করার যে অনিয়ম বা কুঅভ্যাস সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। বিচারপ্রার্থীদের উপকার হলো। সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার স্যারকে দেখেছি প্রতিটি শিডিউলে তিনি সময়ের আগে উপস্থিত থাকেন। বিপিএটিসির এক প্রোগ্রামে তিনি পেশাগত কারিশমা দিয়ে এক মন্ত্রীকেও (যিনি সচরাচর সকালে ঘুম থেকে ওঠতেন না) যথাসময়ের আগে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করেছিলেন।
সিভিল সার্ভিসকে অবশ্যই সফট স্কিল অর্জন করতে হবে। কমিউনিকেশন, নেগোসিয়েশন, লিডারশিপ, টিমওয়ার্ক, আইসিটি, ডাটা এনালিটিকসসহ আরও নানামুখী বিদ্যা অর্জন জরুরি। প্রফেশনালিজম পারফরমেন্সের চেয়ে বেশি জরুরি। আবার পারফরমেন্স প্রফেশনালিজমের চেয়েও বেশি জরুরি। সুতরাং একটি ব্যালেন্সড অবস্থায় পৌঁছাতে হবে একজন দক্ষ ও চৌকষ কর্মকর্তাকে।
(সূত্র: লেখায় উল্লিখিত কিছু গল্প সম্মানিত সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্যারের বিভিন্ন বক্তব্যে শুনেছিলাম। সেগুলোকে অনুলিখন করা হয়েছে)
