Detail

ভালো বই চেনার উপায় কী?
পবিত্র কুরআনের প্রথম যে আয়াত নাযিল হয়েছিল তা ছিল “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে‘‘। সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন ‘পড়ো, পড়ো, পড়ো। পড়ার গুরুত্ব¡ বোঝাতে এসব বাণী আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি। কিন্তু কী পড়বো? সবকিছু পড়বো নাকি ভালো মন্দ বাছাই করে পড়বো? ভালো মন্দ বাছাই করতে হলে তার মানদন্ড কী হবে? কী কী তালিকায় রাখবো আর কী কী বাদ দিব-তা ঠিক করা বড় মুশকিলের কাজ। কারণ ধার্মিকরা বলবে তাঁদের বইগুলো পড়তে, পুঁজিবাদীরা বলবে তাঁদের বই সেরা, সমাতান্ত্রিকরা তাঁদের বইয়ের বাহবা করবে। তাছাড়া বামপন্থী বনাম ডানপন্থী, উদার বনাম কট্টর, সাদা বনাম নীল, ইত্যাকার বিভাজিত লোকেরা তাদের ঘরাণার বই পড়তে বলবে। সুতরাং একেক গ্রæপের মানদন্ড নির্ধারন একেকরকম। পৃথিবীতে কোটি কোটি বই আছে। সব বই পড়ে শেষ করা এক জীবনে সম্ভব নয়। আবার সেরা বইগুলো না পড়ে ভালো পাঠকরা মরতে চায় না। তাহলে উপায় কী? উপায একটাই। সেটা হলো বই বেছে বেছে পড়া। ভালো বই পড়া।

তবে ভালো বই নির্বাচনের কোনো শটকাট রাস্তা নেই। বই পড়ে পড়েই ভালো বই বের করার পথ খুঁজে নিতে হবে। ফকনার বলেছেন ভালো বই কোনটি তা বুঝতে হলে পড়তে পড়তেই বুঝতে হবে। কাঠমিস্ত্রি যেমন তার গুরুর কাজ দেখে দেখে, নিজে কাজ করতে করতে, একসময় বুঝে যায় কাঠের ফিনিশিং কেমন হবে, কোন কাঠের কোন ধরণের কাজ ফুটবে, কোথায় কোনটা খাপ খাবে। পাঠকও পড়তে পড়তে বুঝে যায় কোন বইটি ভালো। মোটা দাগে কিছু টিপস দেওয়া যেতে পারে।
এক. পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিগণ মাঝে মাঝে কথা বলেন বা লিখেন । তাঁদের বলা ও লেখাতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স আসে। যেগুলো তাঁদের ভালো লেগেছিল। সেসব থেকেও নিজের পছন্দের বই বের করা যায়।

দুই. সবার সব ধরণের বই ভালো লাগে না। যে জেনারের বই একজনের পছন্দ সেই জেনারের বিখ্যাত লেখকদের বই বা নামকরা লেখকদের বই পড়লেও ভালো বই পড়া হবে।

তিন. কিছু বই আছে ক্লাসিক। তা সবকালেই সমাদৃত। ক্লাসিক বই বাছাই করা সোজা। যেসব বই যুগের পর যুগ টিকে আছে সেসবের লিস্ট করে তা থেকে পছন্দমতো পড়া যেতে পারে।

চার. প্রয়োজনে কেউ অনলাইনের হেল্প নিতে পারে যেখানে আপনার পছন্দ ও সিলেকশন অনুসারে বিভিন্ন বই সাজেস্ট করে, বা রিভিউ ও স্টার মার্কস দেওয়া থাকে। যেমন the book seer, goodreads, Whichbook, Penguin Classics এরকম নানান সাইট রয়েছে যেখান থেকে ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়।
পাঁচ. সাহিত্য বিচিত্রা, সাহিত্য ম্যাগাজিন, দৈনিক ও মাসিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় অনেক সাক্ষাতকার, প্রবন্ধ ও লেখা আসে। সেখানে বিভিন্ন লেখক ও বই নিয়ে আলোচনা থাকে। এসব পড়তে গিয়ে যদি কোনো বইয়ের রেফারেন্স মনে ধরে, সেটা পড়লেও ভালো বই পড়া হবে।

ছয়. অনলাইন, সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন বা সাহিত্যমেলাগুলোতে নানানরকম সাহিত্য আড্ডা হয়, সেসব শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে, অংশ নিতে নিতেও ভালো ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়।

সাত. সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রিকাতে যে লেখকের লেখা একজন পাঠকের কাছে ভালো লাগে, মনে ধরে, ও চিন্তায় দোলা দেয় এবং সুখপাঠের আনন্দ দেয়, ওই লেখক সেই পাঠকের কাছে ভালো লেখক। ও তার কাছে তার লেখা বই ভালো বই। এ পাঠকের উচিত তার বই পড়া।

আট. লাইব্রেরিতে গেলে বা বই কিনতে গেলে বইয়ের কাভার, ফ্ল্যাপ, কাগজ ও ছাপর মান, টেক্সট, ফন্ট ও স্পেসের ধরণ দেখে এবং বইয়ের কিয়দংশ পড়েও একটি বই সম্পর্কে ধারণা করা যায়, বইটি কেমন হতে পারে তা বোঝা যায়। এ থেকে অনুমান করে বই বোদ্ধারা ভালো বই চিনে ফেলতে পারে।

নয়. বইয়ের যেমন নানান ট্যাক্সোনোমি আছে, লেখকদের মধ্যেও আছে নানান ধরণ। যেমন প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সাহিত্যিক, কবি, কথাশিল্পী, ছড়াকার, গীতিকার, গবেষক ইত্যাকার বিভাজনে বিভক্ত। এসব প্রকারের মধ্যে একজন পাঠকের কাছে সে লেখকের বইই ভালো বই লাগবে, যে ধরণের লেখককে সে পছন্দ করে। জনপ্রিয় ধারার হালকা লেখা যে পাঠকের ভালো লাগে তার কাছে ভারি গাম্ভীর্যর্পূণ ক্লাসিক ভালো নাও লাগতে পারে। আবার কোনো কোনো পাঠক আছে যার কাছে সব ধরণের বইই ভালো লাগে। এরকম সব্যসাচী পাঠক খুব কম।

অন্যরা নানান বই সাজেশন দিবেই, রেফার করবেই। সেসবের মধ্যে সকল বই একজন পাঠকের ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ প্রত্যেক পাঠকের রয়েছে আলাদা রুচি, চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও মনোভাবের ভিন্নতা। সুতরাং যে জেনারের বই, যে ধরণের বই, যে ঘরাণার বই একজন পাঠককে টানবে সে সেটা পড়েই আনন্দ পাবে। একজন বিখ্যাত ব্যক্তির রেফার করা বইও একজন পাঠকের কাছে ভালো না লাগতে পারে। কোন বই কেন কাকে কবজা করবে তা সাধারণীকরণ করে বলা মুশকিল।
পদ্মা ব্রিজের মতো বড় ব্রিজ করতে চাইলে বিশ বছরে করা যাবে, চাইলে ১০ বছরে করা যাবে আবার অর্থ, জনবল ও পরিকল্পনা থাকলে ৩ বছরেও হয়তো করা যাবে। কিন্তু ভালো বই নির্বাচন করার জন্য কোনো শটকাট রাস্তা নেই। বই পড়তে পড়তে একসময় বই চেনার চোখ ও মনন তৈরি হয়, রুচি ও মান তৈরি হয়, বোধ ও প্রজ্ঞা তৈরি হয়। তখন একজন পাঠক বুঝে ফেলেন কোন বই পড়তে হবে। গাইতে গাইতে গাইন, বাইতে বাইতে বাইনের মতোই পড়তে পড়তে পাঠক, তথা ভালো বইয়ের পাঠক হওয়া যায়। অধ্যাপক ভøাদিমির নভোকভ ভালো পাঠক হওয়ার জন্য কিছু গুণের কথা বলেছেন। যেমন ভালো পাঠক মাত্রই বুক ক্লাবের সদস্য হবে, গল্পটির চলচ্চিত্রায়িত রূপ দেখতে পাবে, স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন হবে, হবু লেখক হবে, রসবোধ থাকবে, গল্পের চরিত্রের সাথে একাত্ম হবে ইত্যাদি।

তাহলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ভালো বই চিনতে হলে ভালো পাঠক হতে হবে। লেখক হুমায়ুন আহমেদ এক নির্জন দুপুরে হেঁটে হেঁটে প্রতিবেশী শুক্লাদির বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। শুক্লাদি তাঁকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম ক্ষীরের পুতুল। সেই বই হুমায়ুনের জীবন পাল্টে দিল। দুপুরে বা অবসওে ঘুরতে ভালো লাগে না। শুধু গল্পের বই তাঁর পড়তে ভালো লাগতো। মুরাকামির ভাষায় ‘‘ যে বয়সে মানুষ আরাম করে, হেসে খেলে কাটায়, সেসময় আমি কাজ করতে করতে অবসর পেতাম না। যেটুকু পেতাম বই পড়তাম। এতেই সমস্ত সুখ খুঁজে পেতাম, সেই আনন্দ আর কেউ কেড়ে নিতে পারে নি‘‘। জর্ডানের ভাষ্যমতে ‘‘কেউ যদি জাগতিক কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়, তাহলে তার উচিত গল্পসমৃদ্ধ বই খুলে বসা। এই একা হওয়ার বাসনাই তাকে পাঠক হিসেবে গড়ে তুলবে।‘‘ লেখক গবেষক অ্যাপলের্য়াড বলেছেন, একজন মানুষের যদি ধৈর্য, জ্ঞানের প্রতি স্পৃহা, অনুপ্রেরণা, অনুসন্ধান করার গুণ থাকে তবে তিনি দ্রত পাঠক হয়ে উঠবেন।
ভালো পাঠকের উপরোক্ত গুণে গুণান্বিত যারা তারা স্বভাবতই নিয়মিত বই পড়ে। যারা নিয়মিত বই পড়তে পড়তে ভালো পাঠক বনে যান, তাদের জন্য ভালো বই চিনতে কোনো সমস্যা হয় না।

.

এ লেখাটি ডেইলি স্টার বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল। https://bangla.thedailystar.net/literature/news-450096

 

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart