Detail

Home - দর্শন ও বুদ্ধিজীবিতা - প্রবন্ধ: ’পাহাড়ি-বাঙালি বিবাদে বিবেচ্য বিষয়াদি কী ‘ – সফিকুল ইসলাম

প্রবন্ধ: ’পাহাড়ি-বাঙালি বিবাদে বিবেচ্য বিষয়াদি কী ‘ – সফিকুল ইসলাম

সম্প্রতি পাহাড়ের ঘটনায় অনেক নতুন পাঠক ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদেরকে বিভ্রান্ত মনে হয়েছে। বিশেষ করে অনেক প্রাজ্ঞ লোককে পক্ষে বিপক্ষে নানান কথা বলতে শুনেছি। আমি মনে করি পার্বত্য অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাস জেনে, প্রতিটি ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর ইভলিউশন ও বিস্তার জেনে, মোঘল-ব্রিটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশ আমলের পার্বত্য অঞ্চলের বিস্তারিত ইতিহাস জেনে, সেখানে শান্তি চুক্তির আগে ও পরে গঠিত নানান স্থানীয় সংগঠনগুলো কার্যক্রম বুঝে, বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর শুরু থেকে অদ্যাবধি সকল কাজ দেখে ও বিশ্লেষণ করে আর সেখানে যাওয়া বাঙালিদের বাস্তবতা বুঝে তারপর উপসংহার টানা উচিত। অন্যথায় বিচ্ছিন্ন গল্প বা উপসংহারমূলক বক্তব্য ভুল মেসেজ দিবে।

যারা  একেবারে নতুন বা জানতে আগ্রহী তাদের জন্য আমার এ বিস্তারিত পোস্ট। আমি কোনো উপসংহার টানিনি। যেসব বক্তব্য পক্ষে বিপক্ষে প্রচলিত আছে তা তুলে ধরেছি। পাঠকরা এটা পড়ার পরে আরও অন্যান্য হাজার সকল সোর্স পড়ে নিজের বোঝাপড়া নিজে করবেন। তবে আমার লেখা থেকে পাঠক প্রাথমিক একটা ধারণা পাবেন। -এটা নিশ্চিত।

পাহাড়ি নাকি উপজাতি নাকি আদিবাসী?

পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা আগে থেকে বাস করেন, তাদেরকে কেউ ডাকে পাহাড়ি, কেউ ডাকে উপজাতি, কেউ ডাকে আদিবাসী আর কেউ ডাকে ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী। অনেকে মনে করেন তারা যেহেতু পাহাড়ে বাস করে, তাই তারা পাহাড়ি। বিভিন্ন উপজাতির লোকজন বাস করেন, তাই উপজাতি ডাকাও যৌক্তিক। তবে আদিবাসী ডাক নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যারা ওখানে বাস করেন তারা মনে করেন তারা আদিবাসী। বাঙালি বা  নৃবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ তাদেরকে আদিবাসী মানতে নারাজ। কারণ তারা সেখানে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতো হাজার বছর ধরে বাস করছেন না। তারাও পাঁচ সাতশো বছর আগে মোঘল আমলে বা আগে পরে মায়ানমার, ভারত বা অন্য কোথাও থেকে এখানে এসেছে,। আএলও‘র উপজাতির সংজ্ঞা ও আদিবাসীর সংজ্ঞা দেখলেও এমনটাই হওয়ার কথা।  তাই তাদেরকে উপজাতি বা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী বলা যেতে পারে। আদিবাসী নয়। সরকারও তাদেরকে ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী বলেই লিখিতভাবে পরিচয় দেয় । তবে আমি মনে করি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে পাহাড়িরা যেভাবে চায় সেভাবে তারা নিজেদের ডাকুক। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা তাদের ডাকতে পারি।

 

বাঙালি নাকি বাংলাদেশী নাকি সেটেলার?

বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করছে জেনারেশনের পর জেনারেশন। তবু ওখানকার পাহাড়িরা বাঙালিদেরকে সেটেলার ডাকে। এই সেটেলার ডাক নিয়ে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু বাঙালিদের বেশিরভাগ কুমিল্লা নোয়াখালি চট্টগ্রাম থেকে এসেছে, সেনাবাহিনী বা সরকারের সহায়তায় আশির দশকে অনেকে এসে সেটল হয়েছে। তাই তাদেরকে সেটেলার বলাই সমীচীন। যাদের ঘরবাড়ি নেই বা বিভিন্ন মামলার আসামী বা গরীব এমন লোকেরাই সেখানে গিয়ে সেটল করেছে। তাই তাদেরকে সেটেলার ডাকাই যৌক্তিক। আর বাঙালিদের বক্তব্য হলো- বাঙালিরা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যায় নি। নিজ দেশেরই আরেকটি জেলায় গিয়েছে। দেশের অন্য জেলায় গিয়ে যখন জমি কিনে বা জমি বরাদ্দ নিয়ে পাহাড়িরা বাস করেন, তখন কি তাদেরকে সেটেলার বলা হয়? সেটেলার মানে হলো যার কোনো জমি ছিল না, পিতৃভূমি নেই, নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে সেটল হলে তাদেরকে সেটেলার বলা যেতে পারে। বাঙালিরা বাংলাদেশেরই আরেকটি জেলায় গিয়ে জমি কিনে বা বরাদ্দ পেয়ে আইন মেনে বসবাস করছে। তাদেরকে আলাদা নামে ডাকার কোনো সুযোগ নেই। কেবল বাঙালি বা বাংলাদেশীই তার পরিচয় হতে পারে। দুই গ্রুপের পক্ষেই হাজার হাজর যুক্তি, যত শুনবেন ততই মজা। সব শোনার পরে আপনি কার পক্ষ নিবেন-সেটা ভাবতে গেলে মাথা আওলাবে।

 

জমি কেনার অধিকার বাঙালিদের আছে কিনা?

জমি কিনতে পারে কিনা? এ প্রশ্নে নানান মত রয়েছে। পাহাড়িরা মনে করে এটা তাদের ভূমি। সেখানে অন্যরা না যাওয়াই সমীচীন। গেলেও আইনানুগভাবে যাবে, ও স্থানীয় ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী ও পরিবেশ প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না এরকমভাবে যেতে পারে। জোর করে জবরদখল করা জমি নেওয়া যাবে না। আর বাঙালিরা মনে করে, সারাদেশের ন্যায় পাহাড়েও তাদের জমি কেনার অধিকার আছে। এ বিষয়ে ইতিহাস ঘাঁটলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। তবে সংক্ষেপে বললে,  সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় মুঘলরা পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে। তাদের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের কর্তৃত্ব পায় বাংলার নবাবরা। ১৭৬০ সালে নবাব মীর কাশেম আলী পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেন। তখন চাকমারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল, তবে পরে হার মানে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯০০ সালে তারা জারি করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অ্যাক্ট’। তাতে সেখানে বসবাসরত পাহাড়িদের অধিকার ও স্বার্থ বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়।ওই আইনে ‘অ-উপজাতিদের’ সেখানে জমি কেনা নিষিদ্ধ করা হয়। তবে জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে জমি হস্তান্তরের পদ্ধতি বহাল ছিল। কোনও ‘অ-উপজাতি’র ওই অঞ্চলে যেতেও জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হতো। সেটা এখনও মানা হয়। কাগজে কলমে তা আছেও। তবে বাস্তবে অনেক অনিয়ম বা জবরদস্তি হয়তো ঘটে যেকারণে উত্তেজনা বাড়ে।

মূলত ভূমি নিয়েই দ্বন্দ্ব চরম সঙ্কটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে ব্রিটিশ আমলের মতোই যুক্ত করা হয়েছে, পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি কেনা-বেচা, হস্তান্তর স্থানীয় পরিষদের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। এর বিরোধিতা করছে বাঙালিদের সম অধিকার আন্দোলন। মেজবাহ কামাল বলেন, “পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো, সেটা আমি মনে করি না। বাঙালিদের তো এক সময় পাহাড়িরাই আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন, জমি চাষাবাদের প্রয়োজনে। সম্পর্কটা সুসম্পর্কই ছিল। এখনও যে জমিটা পাহাড়ের মানুষের হাতে আছে, সেটা যেন তাদের হাতে থাকে এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিসরটুকু দরকার, সেটা যেন তাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রণ বলতে আমি যেটা বোঝাতে চাইছি, সেখানে যেন অন্যদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়। পৃথিবীর বহু দেশেই তো আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত সীমানা আছে।”

বাঙালিদের সরিয়ে নেওয়ার যে দাবি পাহাড়িরা করে আসছে তা হয়তো সমীচীন নয়। বাঙালিদের সেখানে যাওয়ার ও জমি ক্রয়ের অধিকার থাকা উচিত। তবে কোনোভাবেই পাহাড়িদের নিজস্ব জমি, চাষ বা সংস্কৃতির ক্ষতি করা যাবে না। সে বিষয়ে মেজবাহ কামাল বলেন, “এই দাবি পাহাড়িরা কেন করেন, সেটা তো বুঝতে হবে। কারণ, তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সেখানে কিন্তু মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমি সমতলের চেয়ে কম। ফলে তাদের তো বাঁচতে হবে। তাদের পেটে লাথি মেরে তো আমরা সেখানে কর্তৃত্ব করতে পারব না। আমরা সেখানে সকল জাতিসত্তার সমানাধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না। আমরা এখনও এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারছি না। মনোকালচারের জায়গায় যদি মাল্টিকালচারাল রাষ্ট্র করা যায়, একটা বহুজাতির রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় এবং স্থানীয় মানুষের জমি, জল, জঙ্গলের উপর অধিকারকে স্বীকৃতি দিলে আমি মনে করি সম্প্রীতির আবহ গড়ে উঠবে। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সমমর্যাদায় বাস করতে পারবো এবং এই নিশ্চয়তাটুকু পেলেই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।”

 

জাতীয় #ইতিহাস কী বলে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের অনেকে অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে ইউ কে চিং মারমা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম খেতাবও পেয়েছিলেন। তবে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়সহ একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তখন।

স্বাধীনতার পর পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও জাতিগত স্বাতন্ত্র্য চেতনার বিস্তার ঘটেছিল। তখন জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। বাংলাদেশের সংবিধান চূড়ান্ত করবার সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি অ-উপজাতীয়দের সেখানে থাকা নিষিদ্ধ করার দাবিও জানান তিনি। সংসদে বক্তব্যে তিনি পাহাড়ি জনগণের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বিষয়টি উত্থাপন করেন।

কিন্তু এম এন লারমার দাবিতে সরকার কর্ণপাত করেনি। উল্টো ১৯৭৩ সালে পার্বত্যাঞ্চলে নিরাপত্তার কথা বলে প্রথম সামরিক ক্যাম্প বসানো হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠে জেএসএসের সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন এম এন লারমার ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।

আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ‘‘আশির দশকে সামরিক শাসন শুরুর পর পাহাড়ি জনগণের প্রতি রাজনৈতিক অস্বীকৃতি রূপ নেয় সামরিক শাসনে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র বাঙালিদের অর্থ ও জমির দেওয়া হবে এরকম সুবিধা দেখিয়ে পার্বত্যাঞ্চলে পুনর্বাসিত করবার কাজও চলে ব্যাপকভাবে। হাজার হাজার পরিবার পাহাড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।‘‘

১৯৯৭ সালে আওয়ামীলীগ আমলে শান্তিচুক্তি হয়। শান্তি চুক্তির পর পাহাড়িদের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে দেখা দেয় বিভেদ। তাতে জনসংহতি সমিতি ভেঙে গড়ে ওঠে আরেকটি দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এই দুই সংগঠন আবার ভেঙে যায়। এখন পাহাড়িদের চারটি সংগঠন সক্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। চারটি দল থাকলেও তারা দুই ভাগে বিভক্ত। চুক্তির পক্ষের সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং চুক্তিবিরোধী প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এখন এক হয়ে কাজ করছে। সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বাধীন জেএসএস (এমএন লারমা) এবং শ্যামল কান্তি চাকমার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এক হয়ে কাজ করছে বলে এলাকাবাসী মনে করে। পাহাড়িদের অনেকেই মনে করেন এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব না থাকলে পাহাড়ে এত গোলযোগ, সমস্যা, চাঁদাবাজি, জিম্মি ও খুনের ঘটনা ঘটতো না।

তাহলে পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে লাভ কী হয়েছে? শান্তি চুক্তি হয়েছে বলেই তো রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যে সহিংসতা, সেটা বন্ধ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা গেছে। সমতলের মানুষের জন্য সেখানে চলাচল অবারিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলায় জেলা পরিষদ গড়ে উঠেছে।

উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। পাহাড়িদের অনেকেই কাপ্তাই বাঁধ চায় নি। এর কারণে হাজার হাজার মানুষের ফসলি জমি বা বসত নষ্ট হয়েছে। অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ড যা হয় তাতে স্থানীয় জীববৈচিত্র বিনষ্ট হয়। একপক্ষ এসব উন্নয়ন ও আধুনিকতা চায়। অন্য পক্ষ রাস্তাঘাট বা অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প চায় না। সুতরাং বিরোধ দিনে দিনে বাড়তেই থাকে।

#সেনাবাহিনী পাহাড়ে দরকার আছে কিনা?-

এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়। কেউ বলে পাহাড়ে সেনাবাহিনী প্রয়োজন নেই। তারা মনে করে তারা সেখানে নিজেদের মতো থাকবে। কেউ তাদের বিরক্ত করবে না। শান্তি শৃংখলা বিরাজ করবে। তাদের মতে সেনাবাহিনী আরও বাড়তি সমস্যা তৈরি করে, বা ভয় তৈরি করে। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্র হেম্পার হয়। আবার অন্য পক্ষ মনে করে সেনাবাহিনী প্রয়োজন রয়েছে। সেখানে পাহাড়ি বাঙালি সংঘর্ষ ছাড়াও সীমান্ত সমস্যা রয়েছে। জিওপলিটিকসের বিষয় রয়েছে। পাহাড়ের গহীণ ভিতরে সিভিল পুলিশের পক্ষে অনেক সময় যাওয়া সম্ভব হয় না। সেখানে আইনশৃংখলা,  মাদক, অস্ত্র, পাহাড়ি ৪টি বাহিনীর মধ্যে আন্তকোন্দল থেকে পাহাড়কে মুক্ত রাখতে হলে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে। আমার মনে হয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব প্রতিরক্ষা বাহিনীর। সে জন্য কোথায় ঘাঁটি গাঁড়তে হবে, সেটি নির্ধারণ করার দায়িত্বটা রাজনৈতিকের চেয়ে সামরক নীতির অংশ বলেই মানি। সে হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকবে কিনা— সে সিদ্ধান্তটা আসলে সামরিক কৌশল ঠিক করা লোকদের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।

.

#গুজব ও বাস্তবতা

সিংগেল স্টরি শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠা যাবে না। বাঙালি পরিবারের একটি কাহিনী শুনে মনে হতে পারে পাহাড়ি সবাই খারাপ। আবার পাহাড়ি একটি পরিবারের কাাহিনী শুনে মনে হতে পারে বাঙালি সবাই খারাপ। এরকম শর্টকাট উপসংহার নেওয়া যাবে না। পাহাড়িদের মধ্যে বেশিরভাগ পরিবার ভালো। তারা তাদের মতো আছে। নিজের মতো থাকতে চায়। তারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সংবিধান মানে। তাদের নিজস্ব বসবাস ব্যবস্থাটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে দিতে চায় না। বাঙালিদেরও বেশিরভাগ পরিবার ভালো। তারা যেভাবেই হোক সরকারের নির্দেশনায়, চাকুরি ব্যবসার মাধ্যমে ওখানে গিয়ে নিয়ম মাফিক বসবাস শুরু করেছে। কয়েক প্রজন্ম ওখানে বাস করছে। ওখানকার পাহাড়িদের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে। তাহলে সমস্যা কারা? দুপক্ষেই কিছু দুষ্টু লোক আছে। যারা অর্থ, অস্ত্র, রাজনীতি, ব্যবসা বা নানান সুবিধার জন্য নানান অপকর্ম করে। যখন বাঙালিদের কেউ এসব করে তখন পাহাড়িরা সকল বাঙালিকেই গালি দেয়। আবার পাহাড়িদের কেউ যখন এসব অপকর্ম করে তখন বাঙালিরা পাহাড়িদেরকে এসব কাজের  জন্য দায়ী করে। ৫% লোকের জন্য আমরা বাকি ৯৫% লোককে কোনো লেভেল দিতে পারি না। মনে রাখতে হবে সেনাবাহিনীর মধ্যেও পাহাড়ি লোক আছে, শান্তিবাহিনীতে পাহাড়ি আছে, পাহাড়িদের মধ্যে ধনী, ব্যবসায়ী, মাদক কারবারি, রিসোর্ট মালিক, গাড়ির মালিক, নানান পাওয়ারফুল লোক রয়েছে। পাহাড়ি মানেই জুম চাষ হত দরিদ্র অসহায় নয়। আবার বাঙালিদের মধ্যেও জোর করে দখলদার, নানান রকম ব্যবসায়ী, ধনী, মাদককারবারি আছে। বাঙালি মানেই অসহায় ভেসে আসা ভিকটিম সেখানে নয়।  কিন্তু মন্দ লোকের সংখ্যা দুপক্ষেই কম। তাদের জন্য আমরা পাহাড়ি বা বাঙালিদের সকলকে মন্দ বলতে পারি না। জমি দখলের ঘটনা অন্যান্য জেলাতেও আছে। কিন্তু পাহাড়ে জমি দখল মানেই পাহাড়ি-বাঙালি  সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হয়। সন্ত্রাসী ঘটনা অন্যান্য জেলাতেও আছে। কিন্তু পাহাড়ে সন্ত্রাসী ঘটনা মানেই পাহাড়ি বাহিনীর গ্রুপিং এর সমস্যা মনে করা হয়। এরকম সহজ উপসংহার টানা যাবে না। দখলকারীর কোনো জাত থাকে না, সন্ত্রাস মাদককারবারীর কোনো নির্দিষ্ট গোত্রের হওয়া লাগে না। অন্যান্য জেলাতেও বাঙ্গালীদের ভিতরেও ভালো , খারাপ, কুচক্রী , উপকারী , অপকারী , ধনী, গরীব ,দালাল, দেশপ্রেমিক ইত্যাদি পাওয়া যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাওয়া যাবে।

আমরা যদি শুধু সেনাবাহিনীর গল্প শুনি , তাহলে কি পুরোটা জানতে পারবো? আমরা যদি শুধু পাহাড়িদের গল্প শুনি তাহলেও কি পুরোটা জানতে পারবো? আমরা যদি শুধু পাহাড়ের বাঙ্গালীদের গল্প শুনি তাহলে কি পুরোটা জানতে পারবো? এই যে তিন দলে ভাগ করলাম , তার ভিতরে ধনী, গরীব, ক্ষমতাশালী , ক্ষমতাহীন, রাজনৈতিক , অরাজনৈতিক , পক্ষীয় , নিরপেক্ষ ইত্যাদি উপদল সবার গল্প যদি না জানি, আমরা কি কোন দিনও বুঝবো আসলেই কোনটা সত্যি হতে পারে?

যে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা সাধারণ কোনো অপরাধ হিসেবে প্রথমে ভাবা উচিত। যেটা অন্যান্য জেলাতেও ঘটে। সকল ঘটনাকে পাহাড়ি বনাম বাঙালি প্রলেপ দিলে সমস্যা বেড়ে যায়। যে কোনো অপরাধ ঘটার শুরুতে কেবল অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সমাধানে যেতে হবে। পরে যদি সেখানে পাহাড়ি বাঙালির উপাদান পাওয়া যায় তবে নেতৃস্থানীয়রা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় দ্রুত সমাধান করতে পারে। তাতে যে কোনো সমস্যা সহজে সমাধান হবে। অন্যথায় রিউমার ও গুজব ছড়িয়ে ছোট সমস্যাকে আরও বড় করা হয়। এতে কার কী লাভ তা স্থানীয়রা ভালো করেই বোঝে। তবে অনেক পরে বোঝে।

 

পাহাড়িরা কি #স্বায়ত্তশাসন চায় বা জুম্মু ল্যান্ড চায়?

এটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বেশিরভাগ পাহাড়িই বাংলাদেশকে মানে বিশ্বাস করে। এর সংবিধানের আলোকে আইন মেনে জীবন যাপন করে। কতিপয় পাহাড়ি হয়তো স্বায়ত্বশাসন বা জুম্মু ল্যান্ড চাইতে পারে। সেটাকে সকল পাহাড়ির চাওয়া হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বা ইউপিডিএফ বা জনসংহতি সমিতি এরকম কিছু সংগঠন বা তাদের সমর্থকরা সায়ত্তশাসন দাবি করে আসছে। সেটা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সতর্কভাবে দেখছে। এসব বাহিনীর দাবিগুলোকে ঠান্ডা মাথায় সরকার সমন্বয় ও সমাধান করবে। এখানে আমাদের জনসাধারণের বেশি সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই।

.

যাই হোক,

পাহাড় কিম্বা সমতলের মানুষ — আমরা সবাই বাংলাদেশী। এটাই আমাদের আত্ম পরিচয়। ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগতভাবে আমাদের মধ্যে ভিন্নতা আছে, বৈচিত্র আছে ; এটাই আমাদের দেশের সৌন্দর্য। এ বিশ্বাস কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবারই আছে যে, আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করেছি— সমতার সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণ করতে।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart