তরুণদের কেন বইমেলায় যাওয়া উচিত?- ড. সফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে বইমেলা হলো আবেগ, অনুভূতি, অনুরণন ও ভালোবাসার জায়গা। বই সারাবছর জুড়ে কিনলেও বইমেলাকে ঘিরে লেখক ও পাঠকদের একটা বাড়তি আগ্রহ থাকে। আমাদের সংস্কৃতি গড়তে, সমাজ তৈরিতে, বোদ্ধা শ্রেণি বানাতে বইমেলা একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
বইমেলায় কারা যায়? নিশ্চয়ই লেখক ও পাঠকরা যায়। তরুণ প্রজন্মের লেখক ও পাঠকদের ভিড় থাকে মেলায়। বয়স্করাও যান বইমেলায়। হেঁটে হেঁটে দেখেন। বই কেনেন। নারীরা সেজেগুজে বইমেলায় ঘুরে বেড়ায়। বাবা-মায়েরা সন্তানদেরকে নিয়ে যান বইমেলায়। প্রকাশকরা নানান রঙ্গিন সাজসজ্জায় সাজান বইমেলার স্টল ও প্যাভিলিয়ন। সব মিলিয়ে একটা আনন্দঘন উৎসবমূখর পরিবেশ। পাঠকরা ছাড়াও প্রকাশক, লেখকস্বত্বা প্রতিনিধি, বিক্রয় প্রতিনিধি, বই সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতারাও বইমেলায় যায়। এদের সবার জন্য বইমেলা হচ্ছে একটি একক আয়োজন। এর সাথে যুক্ত হয় খোদ লেখক এবং গণমাধ্যমের কর্মীবাহিনী। এছাড়াও একটা বড় অংশ আছে যারা কেবল বইমেলায় যায় ঘুরতে। কিছুই কিনবে না। দলে দলে ঘুরবে, ছবি তুলবে এবং পরে চলে আসবে। একটি রম্য রচনায় সঞ্জয় সরকার লিখেছিলেন যে, ‘‘পাঠক নানান রকমের হয়। যেমন সৌজন্য কপি পাঠক, ক্যাটালগ সংগ্রহ পাঠক, অংশগ্রহণই বড় কথা পাঠক, সেলফি কিং/কুইন পাঠক, খাদকশ্রেণির পাঠক, অটোগ্রাফ শিকারি পাঠক, টিভিতে মুখ দেখানো পাঠক, ইয়ো ইয়ো পাঠক, ভিসা কার্ড পাঠক, ও সর্বভূক পাঠক।‘‘
বইমেলায় মানুষ কী কিনে? বইমেলায় সবাই বই কিনতে যায়। নানান ধরণের বই। কেউ গবেষণাধর্মী বই খোঁজে, কেউ ফিকশন যেমন- গল্প, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি কিনে। কেউবা ননফিকশন প্রবন্ধ, সমালোচনা, সংকলন কিনে থাকে। বাচ্চাদের বইয়ের মধ্যে ছড়া, ভূতের গল্প, থ্রিলারসহ নানান জেনারের বই পাওয়া যায় যা পাঠকরা সংগ্রহ করে। কেউ কেউ আছে খেলনা বা হাবিজাবি কিছু কিনেও চলে আসে। কেউ কেবল ফুচকা বা হালিম খেতেও মেলায় আসে। বইমেলায় কেবল বই থাকে, তা নয়। বইমেলা একটি জাতির বা জনগোষ্ঠীর অনন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলা বা উৎসব। বইমেলায় বইয়ের দোকানদারি ছাড়াও নানান ধরণের অনুষ্ঠানমালা যেমন সেমিনার, আলোচনা, সংলাপ, বিতর্ক এবং নতুন বই বা বিষয়ের উপস্থাপনা, লেখকদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ সঙ্গীত, নৃত্য, প্রামাণ্যচিত্র, ছোট কলেবরে থিয়েটারসহ অসংখ্য কার্যক্রম চলমান থাকে। সেসবের সঙ্গ উপভোগেও মানুষ বইমেলায় যায়।
তরুণদের বা শিক্ষার্থীদের কেন বইমেলায় যাওয়া উচিত?
আমি কেন বইমেলায় যাই? নিজেকে এ প্রশ্ন করে দেখলাম। উত্তর অনেক বড়। বইমেলায় না গিয়ে থাকতে পারি না। বইয়ের পরিবেশে বইয়ের মধ্যে সারাক্ষণ ঘেরাও থাকবো- এর চাইতে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? কয়েকজনকে প্রশ্ন করে দেখলাম। কেউ বলেছেন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে তিনি বইমেলায় আসেন। কেউ আসেন পছন্দের লেখকের বই কিনতে। কেউ বা নতুন বই সংগ্রহ করতে চান। কেউ বইমেলাকে উৎসব মনে করে আনন্দের মধ্যেই বই সংগ্রহ করতে চান। অনেকে আছেন প্রিয় লেখকদের সাথে দেখা করতে আসেন। সেলফি তুলে যারা তাদের একজনকে বললাম কেবল কি সেলফি তুলতেই আসেন নাকি বইমেলায়? হেসেই জবাব দিলেন ‘‘প্রিয় সবকিছুর সাথে ছবি তোলা গেলে, প্রিয় মানুষের সাথে ছবি তোলা গেলে, প্রিয় বইমেলা বা বইয়ের সাথে সেলফি তুলতে কী সমস্যা?‘‘ উত্তরে যথার্থ ছিল; তাই আর কথা বাড়ালাম না।
বইমেলায় সাংবাদিক যায় খবর সংগ্রহ করতে, ফিচার লেখক যায় ফিচারের অনুষঙ্গ পেতে, পাঠক যায় বই কিনতে, প্রকাশক যায় বই কতটুকু বিক্রি হলো খবর নিতে, লেখক যায় অটোগ্রাফ দিতে, পাঠকের ভিড় দেখতে, বিক্রির অবস্থা জানতে, বাদামওয়ালা যায় বাদাম বেচতে, সেলফি কুইনরা যায় সেলফি তুলতে, প্রেমিক প্রেমিকা যায় কেবল হাত ধরে হাঁটতে। কারণ এরকম অবারিত সুযোগ আর কোথায় পাবে? কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। সারাদিন থাকলেও কোনো সমস্যা নেই!
অবশ্যই মানুষ বইমেলায় যায় বই কিনতে। কারণ লাখ লাখ বইয়ের সংগ্রহ একসাথে দেখা যায়। প্রতিটি দোকানেই সামনে পেছনে ডানে বায়ে কেবল বই আর বই। হাঁটতে হাঁটতে, চা খেতে খেতে বা বাদাম টিপতে টিপতে দোকানে দোকানে দাঁড়ায়। চোখ বোলায় বই নাড়াচাড়া করে। দীর্ঘ সময় নিয়ে বইয়ের ফ্ল্্যাপ বা কিয়দংশ পড়ে ফেলে। পছন্দ হলে বই কেনে। কিনতে না পারলে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেলে। পছন্দের বই সংগ্রহের জন্য এরকম বড় সংগ্রহশালা আর হতে পারে না। তাই পাঠকরা বইমেলায় যায়। বই পছন্দ করাও সহজ হয়। কারণ অন্যরা কী বই কিনছে, কী বই নিয়ে কথা বলছে, কী বই উল্টে পাল্টে দেখছে, কী বই কিনতে দাম দর করছে -সেসব দেখেও বই পছন্দ করতে পারে পাঠকরা।
পাশাপাশি নানান মঞ্চ বা সংগঠন বা প্রকাশনীর পক্ষ থেকে আলোচনা সভা থাকে। সেখান থেকেও নতুন বই, বিভিন্ন লেখক ও লেখা সম্পর্কে জানা যায। এসব মঞ্চ বা আলোচনা সভায় যোগ দিতে বা শুনতেও অনেকে বইমেলায় যায। বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনেক সংগঠন নানান ধরণের ঘরোয়া ও অনানুষ্ঠানিক আড্ডার আয়োজন করে। তাঁরাও বইমেলায় আসে, বই নিয়ে আলোচনা করে, সমালোচনা করে। এভাবেই সাহিত্য সংস্কৃতির আলোচনায় সময় কেটে যায়। এছাড়াও প্রকাশকগণ লেখক সাইনিং ইভেন্ট করে থাকে। সেখানে লেখকদের সাক্ষর নিতে, সান্নিধ্য পেতে, ছবি তুলতে পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনেক স্টলে লম্বা লাইন হয়ে যায়। বইপ্রেমীদের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ।
বাস্তবে, বইমেলা থেকে মানুষ কী নিয়ে ফেরে? বইমেলায় যে পরিমাণ মানুষ হয় সে পরিমাণ বই বিক্রি হয় না। বেশিরভাগ মানুষ বই না কিনে ঘুরেফিরে চলে আসে। গেটে দাঁড়িয়ে দেখলাম খুব কম মানুষই বই হাতে নিয়ে বের হচ্ছে। মেলায় ঘোরার সময় দেখলাম অনেক মানুষ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। মানে বইমেলায় গিয়েও বইয়ের দিকে তাকানোর সময় নেই। সোশাল মিডিয়া, চ্যাটিং, গেম খেলা, ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত। বইমেলায় যাওয়ার পরেও মানুষকে মোবাইল ডিভাইস ডিস্ট্রেক্ট করে ফেলেছে। মানুষ আগের মতো বই পড়ে না, বই কেনে না। এটা অনেকটা সত্য। তবে বইমেলাকে কেন্দ্র করে তবু প্রচুর বই বিক্রি হয়। এরপরেও আমি বলবো বইমেলায় যারা যায় তাদের মধ্যে অবশ্যই বইপ্রীতি আছে। কারও কম কারও বেশি। এমনকি যাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই তাদের মধ্যেও বই নিয়ে এক ধরণের ইলিউশন তৈরি হয়। বই, স্টল, প্যাভিলিয়ন, বইমেলা ইত্যাকার ছবি, দৃশ্যকল্প মানুষের মনে, মননে, মগজে, চিন্তায় রয়ে যায়। সুকুমারবৃত্তি চর্চার দিকে মানুষকে টানে। মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে আসে। তাই তরুণদের বইমেলায় আসাকে উৎসাহিত করা উচিত।
পুঁজিবাদের এ যুগে, গেøাবালাইজেশন ও মোবাইল দাপটের সময়ে মানুষের জন্য সুন্দর পরিবেশ খুব কম। বইমেলা একমাত্র ব্যতিক্রম। সাহিত্য, সংস্কৃতি, পড়াশোনা, সাহিত্যালোচনা ইত্যাদি নানান বিষয় ও অনুষঙ্গের সাথে দীর্ঘ সময় কাটানোর জন্য বইমেলা উত্তম জায়গা। এখানে গেলে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আসবেই। বিশেষ করে কিশোরকিশোরী ও শিশুরা বারংবার গেলে বইমুখী হবেই। নতুন প্রজন্মের মধ্যে বইপ্রীতি ঢুকিয়ে দিতে পারলে সমাজ পরিবর্তনের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। কথা বলে, শাসন করে, ধমক দিয়ে মানুষকে পরিবর্তন করা যায় না। বরং বই মানুষকে ধীরে ধীরে আলোর দিকে নিয়ে আসে। তরুণরা ও শিক্ষার্থীরা দলে দলে বইমেলায় আসুক। বই কিনুক বা না কিনুক, বইয়ের সংস্পর্শে থাকুক। সৎসঙ্গে যেমন স্বর্গবাস, বইয়ের সঙ্গে থাকা মানে স্বর্গে থাকা। আর বই যে শ্রেষ্ঠ সঙ্গী সে কথাতো মহামণিষীরা আগেই বলে গিয়েছেন।
শেষ কথা
অনেকেই বলে থাকেন যে, বইমেলায় লাখ লাখ বই আসে, সব বইয়ের মান ভালো না। জমিতে ধান করলে কিছু ধান চিটা হবেই। তাই বলে কি কৃষক ধান চাষ করবে না? ভালো বই, উত্তম মানের বই, নিম্ন মানের বই সব আসুক। যেগুলো ভালো সেগুলো টিকে যাবে। পাঠকরাই দীর্ঘমেয়াদে ঠিক করবে কোনটা ভালো আর কোনটা নয়। উচ্চমার্গীয় বোদ্ধা পাঠকের কাছে যেটা নিম্নমানের বই, সেটাই আবার কোনো পাঠকের কাছে প্রিয় বই হতে পারে। তাই নিম্নমানের বই আছে, শুধু একারণে উঁচু মানের বই লেখা, প্রকাশ, ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করা যাবে না। তাহলে ‘‘ব্যাড মানি ড্রাইভস আউট গুড মানি‘‘ এর মতো নিম্নমানের বইয়ে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। এ কারণে ভালো লেখক ও চিন্তকদের উচিত লেখা চালিয়ে যাওয়া, প্রকাশকদেরও উচিত সেসব বই বাজারে আনা ও বাজারজাত করা।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে বইমেলায় কিছু লোক কেবল বাদাম ফুচকা খেতে, আড্ডা দিতে, প্রেম করতে ও ঘুরতে আসে। বইমেলায় আসলে অবশ্যই বই কেনা উচিত। আমি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি। ওরাতো বইমেলাতেই এসেছে। গাজা বা মদের আসরে যায় নি। ভালো জায়গায় এসেছে, আসুক। আসতে আসতে অভ্যাস হোক। একদিন নিশ্চয়ই বোধোদয় হবে, বই কিনবে। দশ দিন আসলে দশটি না কিনলেও দুটি হলেও কিনবে। একটি হলেও পড়বে। না পড়ুক, বাসায় নিয়ে রাখলে অন্য কেউ না কেউ পড়বে। বই আসলে অপঠিত থাকে না। কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ কখনো না কখনও পড়েই।
আবার প্রকাশকদের মধ্যে এক ধরণের হতাশা দেখা যায়। বই বিক্রি হয় না; লস আর লস। বাস্তবের যে অবস্থা তাতে তা মনে হয় না। কারণ প্রতিবছরই বই বিক্রি বাড়ছে। বইয়ের সংখ্যায় ও বিক্রির মোট টাকার পরিমাণে বাড়ছে। এখন প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিক্রি হয়। প্রতিবছরই প্রকাশক সংখ্যা বাড়ছে। প্যাভিলিয়নের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি আয়োজন, ডিজাইন ও সাজসজ্জাও চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। বই বিক্রি না হলে প্রকাশকরা তা করতো? প্রান্তিক পর্যায়ের কোনো কোনো প্রকাশক হয়তো আশানুরূপ লাভ করতে পারে না। তাদেরকে বই বাজারজাতকরণের বিদ্যায় আরও একটু পটু ও যতœবান হতে হবে। তবে এটা বলা যায় যে, প্রকাশকগণ যথাযথ সম্পাদনের মাধ্যমে বই প্রকাশ করলে ও বইয়ের মার্কেটিং করলে বই বিক্রি বাড়তো। আর বুক রিভিউ করানো ও প্রকাশ করানো খুব জরুরি কাজ যাতে করে পাঠকরা রিভিউ দেখে এসে বই কেনে। মেলার শুরুর দিকেই বইয়ের রিভিউ থাকা দরকার যাতে পাঠকরা মেলায় শেষদিকে এসে বই কিনতে পারেন। বইমেলায় প্রচুর ময়লা জমে, তা নিয়মিত দ্রæত পরিস্কার রাখা এবং ধুলোবালি যেন না উড়ে সে লক্ষ্যে নিয়মিত পানি ছিটানো আবশ্যক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বই সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বইয়ের পর্যালোচনা, আলোচনা ও তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ এবং বাস্তবায়ন দরকার রয়েছে।
জার্নাল অব রয়েল এনথ্রোপোলোজিক্যাল ইনস্টিটিউট এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ব্রায়ান ময়েরান বইমেলাকে ‘মূল্যবোধের একটি টুর্নামেন্ট‘ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রকাশনা শিল্পে এর ভূমিকা পরীক্ষা করে বিশেষ করে প্রকাশনা চক্র, চেইন এবং পাঠক সৃষ্টিতে এর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে তিনি এ উপসংহার টানেন। বইমেলা আমাদের মননের উৎকর্ষ সাধন করে ও ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখে।
তাহলে কী দাঁড়ালো? ‘মূল্যবোধ‘ তৈরি করতেই আমরা বইমেলায় যাই! তরুণ প্রজন্ম সবাই অবশ্যই বইমেলায় যাওয়া উচিত, তবেই আমরা ভবিষ্যতে সচেতন নাগরিক পাবো, বোদ্ধা সমাজ পাবো, মেরুদন্ডওয়ালা লেখককূল পাবো।
……
ড. সফিকুল ইসলাম, বহুমাত্রিক লেখক ও গবেষক,
(তিনি অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন)
