Detail

Home - গল্প - গল্প: ‘ এক আনার জীবনের বাহাদুরি’ – সফিকুল ইসলাম

গল্প: ‘ এক আনার জীবনের বাহাদুরি’ – সফিকুল ইসলাম

অনেকদিন পর বুড়ী নদীর পারের গ্রামে আসলো সোহেল। তাদের বাড়ির পাশেই ব্যস্ত সড়ক। সড়ক পেরোলেই বিশাল প্রান্তর। প্রান্তর আর সড়কের মাঝে একটি ছোট পুল রয়েছে। পুলের রেলিং এ বসে প্রান্তরের সবুজ দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগে তার। তাই গ্রামে আসলেই সোহেল এখানে আসে। পুলের রেলিং এ বসে। ধু ধু প্রান্তরের অবারিত সবুজ দৃ্শ্য সে দেখে। কৈশোরের দূরন্তপনার অনেক ছবি সে দেখতে পায় এখানে বসেই।একটার পর একটা দৃশ্য তার চোখের সামনে ভাসে। ব্যস্ত সড়কে মানুষের হাঁটাচলা আর যানবাহনের আওয়াজ তার চিন্তায় কোন ব্যঘাত ঘটাতে পারেনা। সুখস্মৃতির আবেশে এতটাই মগ্ন থাকে যে এসব তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। ভাবতে ভাবতে সে হারিয়ে যায় স্বপ্নের আবেশে, গড়ে তোলে স্বপ্নের দেশ, স্বপ্নের শহর। আবার দু;খ জাগানিয়া স্মৃতিতের মনে করে করে সে কেঁদে ভিজিয়ে ফেলে কপোল।

কী সোহেল মিয়া বাড়িতে কবে আইলা? হঠাৎ একটি ডাকে সে নড়েচড়ে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখতে পায়, গ্রামের মাতবর সাব আসতেছে। গ্রামের মাথা বলে নিজেকে দাবি করে, লোকদেরকেও বলতে বাধ্য করায়, গ্রামের তথা আশেপাশের সালিশ দরবার তাঁর হাতে। সালিশ মানেই অনেক প্যাঁচের খেলা, জিলাপীর থাকে আড়াই প্যাঁচ, আর মাতবরদের থাকে সাড়ে বারো প্যাঁচ। আসমানের আছে সাত স্তর, আর সালিশের থাকে সাত-সাতা ঊনপঞ্চাশ স্তর। সব স্তরে ঘটনা সাজিয়ে, সব প্যাঁচ কষিয়ে সালিশ সাজায়। সালিশ ব্যবসার অনেক লাভ। ক্ষমতা পোক্ত হয়, পকেটও ভারী হয়।

এই সেই মাতবর যাকে ছোটবেলায় একটি মারামারিতে দেখেছিলাম। দুপাশে দু গ্রাম। মাঝখানে সবুজ প্রান্তর। সবার হাতে বল্লম, মুলি (বাঁশের ধারালো কঞ্চি), রান দা, ইট ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। একপক্ষ আরেকপক্ষকে এলোপাথারি নিক্ষেপ করছে।আমি দূর থেকে দেখছিলাম। পাশে  এই মাতব্বর। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ”গ্রামের মান বাঁচাও”, ”গ্রামের মান বাঁচাও” । আর এ চিৎকারে গ্রামের জওয়ানদের গ্রামপ্রেম উথলে উঠে আর ঝাঁপিয়ে পড়ে!

রাষ্ট্র পর্যায়ে ”জাতীয়তাবাদ” যেমন ট্রাম্প বুশরা ব্যবহার করেন; গ্রাম পর্যায়ে “গ্রামের মান বাঁচাও”, গোষ্ঠীর মান বাঁচাও” নামক গ্রামপ্রেম/গোষ্ঠীপ্রেমের/ধর্মপ্রেমের চরম অপব্যবহার হয়।সেই ছোটবেলায় বুঝেছিলাম যে মাতব্বর ভুল বলছেন। এই মাতব্বর চিৎকার করছেন। তিনি চুল পাকিয়ে ফেললেও বুঝতে শেখেননি মানবপ্রেম বাদ দিলে গ্রামপ্রেম থাকে না, মানুষের মান না থাকলে গ্রামের মান থাকে না।

গ্রামের মানুষগুলো একসাথেই চলাফেরা করে। একসাথেই দশকের পর দশক মিলেমিশে চলে। বিয়ে খতনা একসাথে খায়। বাজারে যায়; বিলে কাজ করে; ঈদের মাঠে কুলাকুলি করে; শুক্রবারের জুম্মায় খুতবা শোনে; শীতকালের মাহফিলে হুজুরের ওয়াজ শুনে; পাশাপাশি বসে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ফেলে। কিভাবে সম্ভব মেরে ফেলা ! আমি ভেবেই পাই না। আমি ভেবে না পেলেও মাতব্বররা তাদের স্বার্থে মানুষের মাঝে ঝগড়া লাগিয়ে রাখে। যত জমি জমার ঝামেলা, যত মারামারি, যত মামলা মোকাদ্দমা, তত মাতব্বরদের লাভ।

 

সেই মাতবর ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে আজ সোহেলের দিকে। সোহেল যে ব্রিজের উপর বসা সেখান দিয়েই যাচ্ছে। হাতে সিগারেট। মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বয়স ষাটের কোটায়। প্রৌঢ় চেহারায় অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট।

:স্লামালেকুম চাচা কেমন আছেন?

:ভালো। বলে একটু অন্যদিকে তাকান। একটু দম নিয়ে মুখের অভিব্যাক্তিটায় একটা ভাব আনার চেষ্টা করেন। তা কখন আইলা? গ্রামেতো আসোই না!বলেই চোখ দুটো কুচকে মুখটা গোল আর বাঁকা করে সিগারেটে টান দেন। লম্বা টান।

: জ্বী চাচা। গতকাল আসছি। আজকে আছি। কাল চলে যাবো।

: মুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে যান। আরে কাল চলে গেলেই হবে নাকি? থাকো । তোমরা গ্রামে এলে ভালো লাগে।তোমরাই তো গ্রামের ভবিষ্যত।

:জ্বি চাচা। গ্রামে আসলে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু কী করবো ছুটি নেই। তাই।

: তা ঠিক আছে। মন্নানের ছেলে রহমত তো গ্রামে আসেইনা। সে নাকি বুয়েট না ফুয়েটে পড়েছে। শুনলাম সে এখন বড় অফিসার হইসে। তার বাবার তো কোন পড়াশোনা নেই। গরীব কৃষক ছিল।জমিজমা ছিলনা। খাওয়া পড়ার খুব কষ্ট ছিল। অভাবের মধ্যেই দিন পার করেছে। বংশ বড় বিষয়। বুঝলা? বংশ নিচু হলে যা হয় আর কি।বলেই মাতবর সাব কপালের ভাজগুলোকে উপরে তুলে চোখের কীরকম একটা খেলা দেখালো।

: সোহেল বুঝতে পারে, ইচ্ছাকৃতভাবে মাতবার সাব রহমতকে হেয় করার জন্যই এগুলি বলতেছে।রহমতের বাবা কৃষক ও আর্থিক সঙ্গতি ভালো ছিলনা – তা ঠিক আছে। কিন্তু ওর দাদা পৈরদাদাদের অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল গ্রামে-সে কথাটা বেমালুম গোপন করে যাচ্ছে মাতবর। সোহেল সব বুঝতে পারে।  তবুও দাঁতে দাঁত চেপে বলে। চাচা বংশ নিচুর বিষয়টি বুঝলামনা!

: আরে বুঝলানা? গোবরে পদ্মফুল আর কি! বলে মাতবর সাব আবার সিগারেটে টান দিল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রহমতের পারিবারিক শত বিষয় টেনে বানিয়ে বানিয়ে বলতে থাকলেন।অযাচিত ও অপ্রাসাঙ্গিক সব কথা।

: সোহেলের রাগ উঠছে। আর কোন কথা কানে যাচ্ছেনা। মনে মনে ভাবছে, আপনিতো মাতবর। আপনার পড়াশোনা কতটুকু? আপনার বাবা কি ছিলেন, আপনার দাদা কি ছিলেন সে খবর মনে আছে কি? নিজের ছেলে দুইটা যে পড়াশোনায় আগাতে পারেনি, গাঁজা মদ খায় সেদিকে খেয়াল আছে? কিন্তু সরাসরি কিছু না বলে শুধু বললো। চাচা, যদি কিছু মনে না করেন। কিছু কথা বলবো? মানে একটু সময় লাগবে। এ ধরেন দুমিনিট।

: না না অসুবিধা কি। বল বল। তোমরা পড়াশোনা করছো। তোমাদের কথা শুনতে ভালোই লাগে।

: সোহেল বলতে শুরু করলো। ১৯৭১ সালে দেশ সাধীন হয়েছে। এর আগে কোন গ্রামে কোন কোন পরিবার ছিল তা সকলের জানা। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগে পরে কে কে কোন গ্রামে এসছে তাও সবাই জানে। হিন্দুদের দেশ ত্যাগের সময় কে কার সম্পদ কিভাবে দখলে নিয়েছে সেটাও জানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কার অবস্থান কি ছিলো সেটাও নিশ্চয়ই আপনার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কোন গ্রামের কোন পরিবার আগে আসছে আর কোন পরিবার পরে এসছে সেটা খুব বেশি পুরণো ইতিহাস নয়। সুতরাং অন্যের খুঁত ধরার আগে নিজের ন্যাংটি শুকনা কিনা একটু দেখে নেয়ার দরকার আছে বলে আমার ধারণা।

:মাতবরের চেহারাটা পরিবর্তন হয়। ভ্রু ‍কুচকে সোহেলের দিকে তাকায়। হাত উচু করে সোহেলকে থামতে ঈশারা করার চেষ্টা করে।

: সোহেল থামে না। গলার স্বর কিছুটা উচুতে উঠে বরং। একাধারে বলে যায়। তাছাড়া ১৯৫০ সালের আগে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন ছিল না। তার মানে কোন জমির মালিক কোন ব্যাক্তি ছিল না। সকল ভূমির মালিক ছিল সরকার। ১৯৫০ সালের পর সাধারণ মানুষ জমির মালিকানা লাভ করে। যদি ভূমি দিয়ে মানুষের স্টেটাস ভাবেন তবে তো ১৯৫০ সালের আগে মানুষের কোন নিজস্ব জমি ছিলনা। যারা মুগল আমলের জমিদার বা ব্রিটিশ আমলের চৌধুরী ছিল, বিভিন্ন এলাকার জমি তাদের আয়ত্ত্বে ছিল।  তারা ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের তোষামোদ করতো আর বিনিময়ে রাজস্বের একটি অংশ পেত। ইতিহাসে অনেকেই এসব জমিদার  বা টাইটেলধারীদেরকে ইংরেজদের দালাল বলে চিহ্নিত করেছেন। এসব জমিদারদের অনেকেই জাতভাই বাঙ্গালির উপর অনেক জুলুম অত্যাচার নির্যাতন করেছেন। জাতভাই বাঙ্গালির রক্তচোষে জমিদার বাড়ির দালান হয়েছে, শান বাধানো ঘাট হয়েছে, জৌলূস দেখাইছে। তেলতেলে ঘোড়া হাঁকাইছে। আরও কত কী।

যদি ১০০ বছর আগে চিন্তা করি ।কোন গ্রামের কে কোথা থেকে এসছে আর কার কত জমি ছিল তাতো অজানা থাকবে না।১৭৭৬ এর মনন্থর, ১৯৪৩ সালের দূর্ভিক্ষ, ১৯৭৪ সালে যুদ্ধবিধ্ববস্ত দেশে না খেয়ে থাকা এগুলি বিবেচনায় নিলেতো  গ্রামের কাউকে দেখিনা যিনি আহামরি কিছু ছিলেন। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, ৭০০ বছরের মুসলিম শাসন বিবেচনায় নিলেতো ধর্মটাও কি ছিল সেটাও গবেষণা করে বের করতে হবে। তবে হ্যাঁ এসব জোয়ার বাটায় অনেকেই সুযোগ নিয়েছেন। যেটুকু বড় হয়েছে অনেকে তা সবারই জানা।হিন্দু শাসনামলে হিন্দুদের দাপট, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ তোষামুদি, বাঙ্গালির রক্ত চোষা, মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের অত্যাচার; ১৯৪৫ পরবর্তীতে হিন্দু সম্পত্তি অবৈধ দখল; ১৯৭১ থেকে অদ্যাবধি রিলিফ চুরি, গম চুরি, ঠিকাদারির জুচ্চুরি, ইত্যাদির মাধ্যমে অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এবং এরাই ধরাকে সরাজ্ঞান করে নিজেকে ভদ্রলোক আর বাদবাকি সবাইকে গোবরে পোকা ভাবেন।

অন্যের বিষয়ে প্রশ্ন তুলার আগে নিজের বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি। আমাদের উচিত আয়নায় মুখ দেখা। কাচের আয়নায় নয়, নিজের মনের আয়নায়। নিজেকে জানি। নো দ্যাইসেলফ।

মাতবর সাবের চেহারাটা কালো হয়ে যায়। কিন্তু পাকা মাতবর। হঠাৎ করে হা হা হা করে হাসতে থাকে। হাসি থামতেই চায়না।হাসির মধ্যেই বলতে থাকে। দুকলম শিক্ষা দেখি তোমার ভালোই মুখ ছুটেছে। মুখে কথার খই ফুটছে। হাত থেকে সিগারেটের শেষ অংশটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাটা শুরু করে।হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে আমার তাড়া আছে।সালিশ আছে, বাজারে যাওয়া লাগবে। ভাতিজা ভালো থেকো। আঁমার জন্য দোয়া করো। শরীরটা কয়দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না, বলেই হনহন করে চলে গেল। সোহেলের উত্তর শোনার অপেক্ষায় থাকল না।

সোহেল বসে বসে ভাবতে থাকে। মেজাজটা গরম করা মনে হয় ঠিক হয়নি। বিষয়টা অন্যভাবেও বলা যেত। ”গুনেই মানুষের পরিচয়”। ”সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। ”মানুষ মানুষের জন্য”। ”অর্থসম্পদ দিয়ে মানুষের মানুষত্ব যাচাই হয়না“।বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতা বিজ্ঞানীর ভুরি ভুরি উদাহরণও দেয়া যেত যাদের বাবা-মার আর্থিক সঙ্গতি ভালো ছিলো না। বলা যেতো যে এক আনার জীবন। এ তুচ্ছ জীবন নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কিছু নেই। কিন্তু এসব নীতিকথায় মাতবরের মাথায় ঢুকতো না। তাই একতরফা কথাগুলো বলা। পাশেই ব্রিজের নিচে খড়জাল দিয়ে মাছ ধরছে মনির। তার দাদা ছিলেন এ এলাকার অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাক্তি। অথচ আজ তাকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আইয়ুব বাচ্চুর গানটি একেবারে মিথ্যা নয়। ”এক পুরুষে গড়ে ধন আরেক পুরুষ খায়, আরেক পুরুষ এসে দেখে খাবার কিছু নাই। আমার তিনপুরুষ।” তাই মনিরের কপালে শিক্ষাও জোটেনি, তথাকথিত সমাজের তথাকথিত ভালো পেশার কাজও পায় নি। নরওয়ের জেলেরা কত ধনী হতে পারে তা বাংলাদেশের মাতবররা কল্পনাও করতে পারবে না।সোহেলের মায়ের দুটো প্রবাদ মনে পড়লো। ”দুইদিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন”। ”জাতে ভাতে কুমারের ঝি/ পাতিল দেখে বলে এটা আবার কী? মাতবরের মতো অনেকেই আছে অন্যদের নিয়ে চট করে মন্তব্য করে । মন্তব্যের আগে নিজের গভীরতা মাপে না।নিজের ছায়া নিজেকে দেখতে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হলে চিন্তায়, ধ্যানে, জানায়, ও বিবেচনায় অনেক বড় হওয়া লাগে। মাতবরদের এত সময় কই? লালসালু উপন্যাসের আব্দুল মজিদের মতো “ তোমার দাড়ি কই মিয়া” টাইপ ধমক দিয়ে মূল ঘটনা আড়াল করে সালিশ করে। এতেই দিন গুজার আর রুজি রোজগার।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart