Detail

Home - গল্প - গল্প: ‘বাতিকগ্রস্ত জীবন’ – সফিকুল ইসলাম

গল্প: ‘বাতিকগ্রস্ত জীবন’ – সফিকুল ইসলাম

আওয়াল মজুমদার সবকিছু নিজের হাতেই করে। তার বন্ধু সহকর্মীরা পিয়ন চাপরাশি ছাড়া চলতে পারে না। সরকারি অফিসে বড়কর্তা হলেও মজুমদার সাহেব নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। অফিসে বা বাসায় সবকিছু নিজের মতো করে নিজের হাতে করে। টুকিটাকি সব কাজ। থাকে ইস্কাটনে। বাসায় একা একাই থাকে। স্ত্রী গত হয়েছে কয়েকবছর আগে, আর সন্তানরা থাকে অন্য শহরে।

ঘরের সব কাজ নিজে করলেও কিছু ভারী কাজ এখন কাজের বুয়া করে। স্থায়ী কেউ নেই। কেবল ঘর মুছা ও কাপড় ধোঁয়ার জন্য খুব ভোরে একজন ঠিকে ঝি আসে। ঠিকে ঝির কাজ শেষ হলে ঠিকে ঝি বের হওয়ার সময় মজুমদার সাহেব নিজেও বের হয়। রমনায় হাঁটতে যায়।

আজকে ঠিকে ঝির কাজ শেষ হবার আগেই মজুমদার সাহেব প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। রমনায় যাবার জন্য। ঠিকে ঝিকে রেখে রমনায় যেতে পারছে না। মজুমদার সাহেব মনে মনে ভাবছে। যদি তালা খোলা রেখে চলে যায়, ঠিকে ঝি পরে তালা লাগিয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু তবু মজুমদার সাহেব বের হচ্ছে না। মনে সন্দেহ যদি বুয়া চুরি করে, যদি কিছু নিয়ে যায়। কী কী নিয়ে যেতে পারে তা ভাবতে গিয়ে তেমন কিছু পেলো না মজুমদার সাহেব। বাসায় নগদ টাকা বা সোনা গয়না কিছু নেই। টিভি বা বড় আসবাব যা আছে তা নিতে পারবে না, কারণ নিচে সিসি ক্যামেরা আছে।

মানুষ এখন মানুষকে বিশ্বাস করে না। সিসি ক্যামেরাকে বিশ্বাস করে। মানুষ, মন, চোখ সবকিছুর দায়িত্ব এখন সিসি ক্যামেরাই পালন করে। মানুষের গুরুত্ব ক্রমেই কমে যাচ্ছে। সিসি ক্যামেরা যেহেতু আছে সেহেতু বুয়া কিছুই নিয়ে যেতে পারবে না। তবে পিঁয়াজ মরিচ, বা সামান্য তরকারি বা খাবার বা এরকমই ছোটখাটো কিছু জিনিস কাপড়ের তলায় করে নিয়ে যেতে পারে। তবু মজুমদার সাহেব বের হচ্ছে না। লাঠি হাতে নিয়েছে, ক্যাডস পরেছে, চোখে চশমা দিয়েছে। তারপর ড্রয়িং রুমে হাঁটছে আর পায়চারি করছে। বুয়ার ঘর মুছা ও কাপড় ধোয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে।

পাঁয়চারি করতে করতেই মজুমদার সাহেবের মনে পড়ে গেলো তার লন্ডনে থাকার সময়কার কথা। ওখানে ছুটির সময় এক বয়স্ক লোকের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেছিল। এমন অনেকদিন হয়েছে যে বাড়ির মালিক তার কাছে চাবি দিয়ে চলে গেছে। সে তার কাজ শেষ করে তালা দিয়ে চাবিটি বাগানের এক জায়গায় রেখে দিতো। লন্ডনের বয়স্ক লোকটি বিদেশী এক ছোকরাকে বিশ্বাস করতে পেরেছে। সে বাঙ্গালি হয়ে বাঙ্গালি আরেক হাউজমেইডকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু তবু তিনি বুয়ার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। বুয়া বের হবার পরে ভালো করে তালা দিলো। সেই তালা আবার কয়েকবার চেক করলো। তারপর গেলো হাঁটতে।

রমনাতে ঢোকার গেটেই কয়েকজনকে নিয়মিত পাওয়া যায়। কেউ প্রেশার মাপে, কেউ সব্জি বেচে, কেউ বনাজি ইউনানি শরবত বেচে। পিচ্ছিল পিচ্ছিল শরবত। শক্তি বাড়ায়, বলবর্ধক, কুষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, প্রেশার কমায়। যার যেটা দরকার সেটা ভেবেই সে পান করে। এই লোকগুলো মার্কেটিং না পড়লেও মার্কেটিং এর সব জানে। সকাল বেলায় রমনাতে কারা আসে, তাদের কী কী প্রয়োজন হতে পারে, সেসব ভেবে তারা পন্য সংগ্রহ করে ও সেবা প্রদান করে। বাজারজাতকরণের টুলস বা গবেষণা জানা নেই, কিন্তু বাস্তবিকই তারা বাজারজাতকরণের সকল তত্ত্ব বাস্তবায়ন করে। মার্কেটিং এর জনক ফিলিপ কটলার কিংবা বাজারজাতকরণের উপর সর্বাধিক বাংলা বইয়ের লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মীজানুর রহমান যদি এসব দেখেন তবে তাজ্জব বনে যাবেন। কারণ তাঁদের বই না পড়েই রমনা পার্কের গেইটে বসা ব্যবসায়ীরা সব বাস্তবে করে।

মাঝে মাঝে ওজন মাপে বা প্রেশার মাপে মজুমদার সাহেব। মাপলেও ওজনের যন্ত্র ও প্রেশার মাপার যন্ত্রের উপর কোনো আস্থা নেই তাঁর। নিশ্চয়ই দুনম্বরি জিনিস দিয়ে কোনোরকমে বসে আছে। সন্দেহ মনে থাকলেও মাপায়। মাঝে মাঝে শরবতও খায়। জানে যে এসব শরবতে ডায়াবেটিস বা কুষ্ঠকাঠিন্য কোনোকিছুই কমবে না, বাড়বে না শরীরের বলও। তবু খায় । সন্দেহ নিয়েই খায়। যদ্দেশে যদাচার। মিথ্যার বেশাতিতে ভাসছে দেশ। সেখানে পার্কের সামনের ফুটপাতের দোকানদারকে আর কী দোষ দিবে?

পার্কে ঢুকে তিন রাউন্ড চক্কর দেয়। এক রাউন্ডে দুই কিলো হয়, তিন রাউন্ডে ছয় কিলোমিটার হয়। মাঝে একটু পানি খায়। পানিওয়ালা ছেলেটাকে ডাক দেয়। ছেলেটাকে আগে থেকেই চেনে। নিয়মিত পানি কেনা হয় বিভিন্ন হকারের কাছ থেকে। তার মধ্যে এই ছেলেটিও আছে।

ছেলেটির নাম মনির। নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করে না মজুমদার সাহেবের। এই পিচ্চি  বলে ডাক দেয়।  দৌঁড়ে আসে মনির। ‘‘স্যার পানি লাগবে?‘‘ মনিরের আগ্রহ দেখে তার  আসার দিকে থাকে মজুমদার সাহেব। মনে মনে ভাবে নিশ্চয়ই এ পানি অরিজিনাল না। মাম পানি বা প্রাণ কোম্পানীর বোতল হলেও এগুলো অরিজিনাল নাও হতে পারে। কারণ তিনি শুনেছেন যে বোতল টোকানোর পরে এসব বোতলে পানি ভরে পুনরায় বিক্রি করা হয়। বস্তিতে বোতল পরিস্কারের ও ছিপি লাগানোর ব্যবস্থা আছে। দুনম্বরি ব্যবসা। এসব সন্দেহ মাথায় নিয়েই মনিরের কাছ থেকে পানি কেনে। পানির বোতলটা মাম কোম্পানীর কিংবা প্রাণ কোম্পানীর নাকি নকল তা ভাবতে ভাবতে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক গিলে। বিশ টাকা দিয়ে মজুমদার সাহেব হাঁটতে শুরু করে। এভাবে ছয় কিলোমিটার দৌঁড়ানোর পরে রমনার মাঝখানে কিছুক্ষণ স্ট্রেচিং করে। পরে চোখ বন্ধ করে ইয়োগা করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ বসে বা শুয়ে থেকে। মানিব্যাগ, লাঠি পাশে রেখেই ইয়োগা করার চেষ্টা করে। তবে মানিব্যাগ ও লাঠি চুরি হয়ে যায় কি না এ ভয় নিয়ে নিয়েই ইয়োগার কাজটি শেষ করে। ইয়োগাতে মনোযোগ দরকার হয়। কিন্তু মানিব্যাগ ও লাঠি কেউ নিয়ে যায় কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে পূর্ণ মনোযোগে ইয়োগা করতে পারে না মজুমদার সাহেব। মনের মধ্যে একটা খচখচ নিয়েই একবার চোখ খুলে একবার তাকায় একবার বন্ধ করে। এভাবেই ইয়োগা অংশটি শেষ করে।

মর্ণিংওয়াক শেষে বাসায় ফেরার পথে একটি ফার্মেসীতে প্রবেশ করে। সেখানে কিছু ওষুধ অর্ডার দেয়। দোকানদার ওষুধগুলো দেয়। মজুমদার সাহেব ওষুধগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখে। মনে মনে সন্দেহজনক ভাবনা উদয় হয়, যে ওষুধগুলো অরিজিনাল কি না! বাজারে নকল ওষুধে ভরে গেছে। নকল ওষুধ হলেতো ঝামেলা। যেভাবে চারদিকে ফেইক পন্য বানানোর হিড়িক পড়েছে, সেখানে জীবন রক্ষাকারী ওষুধে যে তা করবে না তা বলা মুশকিল। গত কয়েক মাস আগে মিডফোর্ডে ম্যাজিস্ট্রেটগণ অপারেশন করে কোটি কোটি টাকার ওষুধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করেছে। একদিন বাজেয়াপ্ত করেছে আর হাজার দিন যে বাজারে সরবরাহ হয় সেগুলো নিশ্চয়ই মানুষ কেনে। এসব ভাবতে ভাবতেই  দোকানদারকে এক হাজার টাকার নোট দেয়। দোকানদার এক হাজার টাকার নোটটি বারবার করে চেক করছে। টাকাটি জাল কি না এ কারণে দোকানদার বারবার চেক করে। ও চেঞ্জ ফেরত দেয়। শেষে  মজুমদার সাহেব বাসায় রওয়ানা দেয়। কিন্তু ফিরতে ফিরতে ভাবতে থাকে, সকাল থেকে প্রতিটি বিষয়ে অন্যের উপর বিশ্বাস না করার যে ইস্যূগুলো আসলো তা নিয়ে চিন্তিত বোধ করলেন। ঘরে বাইরে এখানে সেখানে অফিসে আদালতে সবখানে অবিশ্বাসের যে বেড়াজাল তৈরি হয়েছে তাতে মানসিক শান্তির কোনো উপায় পান না। মজুমদার সাহেব সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করে ভাবনায় মগ্ন হলেন। জীবনের কতশত কাজ করে এসে এখন দেখেন মানুষ কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। এত বেশি পরিমাণ জালিয়াতি ও ভোগদখল হয়েছে যে সাধারণ মানুষ হিসেবে তিনিও এখন কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। অবিশ্বাসের যে আবরণ মজুমদার সাহেবের মনে পড়েছে তা খুলে ফেলা বা জিরো করে তোলা কঠিন। মানুষ এখন নিজের পরিবারের সদস্যদেরকেও বিশ্বাস করাতে পারছে না।

০২।

কী জানি কী কারণে মজুমদার সাহেব পার্ক থেকে ফিরে বেডরুমে বিছানায় শুয়েছিল। একটি পিঁপড়া তার হাত বেয়ে উপরে উঠছে। সুরসুরি লাগছে। কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে হলো না। পিঁপড়াটি হাত বেয়ে কাঁধ বেয়ে তার কান ও গাল পেরিয়ে নাকের দিকে যাচ্ছে। হাত তুলে পিঁপড়াটিকে সরানোর মতো অবস্থায় ছিল না। ক্লান্তি আর আলসেমিতে চোখ বন্ধ করে লাশের মতো শুয়ে থাকলো। কিংবা ঘুমিয়ে গেলো। এমন একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে চলে গিয়েছে। পিঁপড়াটি নাকের ভেতের ঢুকে তাঁর শ্বাসের গরমের কারণে হোক আর ভেতরের অন্ধকার দেখে হোক বেরিয়ে গেলো। তিনি আধো জাগরণ ও আধো ঘুমে স্বপ্নে চলে গেলো।

 

পিঁপড়াটি বসে নেই। তাঁর নাক থেকে বেরিয়ে আবার কাঁধ ও হাত বেয়ে বিছানা বেয়ে মাটিতে নেমে গেলো। পাশেই নামাজের বিছানা বিছানো। সেটা পেরিয়ে রুমের দরজা দিয়ে টয়লেটে ঢুকলো। কমোড বেয়ে ভেতরে নেমে গেলো। মজুমদার সাহেব হয়তো বাথরুম করে ফ্ল্যাশ করতে হয়তো ভুলে গিয়েছে। পিঁপড়াটি সেই বিষ্ঠার উপর দিয়ে চলে গেলো অন্য পাশে। মাঝে একবার থামলেও মনে হলো খাবার হিসেবে পছন্দ করলো না। চারতলা থেকে নামতে নামতে চলে গেলো একেবারে নিচে।

 

সেখান থেকে পাশের বাড়ি গিয়ে ওই বাড়ির বাগান পেরিয়ে পাশেই মসজিদে চলে গেলো। মসজিদের ফ্লোর পেরিয়ে মিম্বরের পাশে তাকে রাখা কুরআন শরীফের উপরে গিয়ে বসলো। বসে দাঁত দিয়ে কাটার চেষ্টা করলো। কিন্তু মনে হয় পারলো না। কিংবা অস্থির স্বভাবের এ পিঁপড়াটি চলে গেলো অন্যকাজে।

 

মসজিদ থেকে বেরিয়ে দুদিন চলতে চলতে পাশেই থাকা এক হিন্দু বাড়িতে ঢুকলো। সেখানো পুজোর জন্য সাজিয়ে রাখা ফুলগুলোতে গিয়ে উঠলো। ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে পিঁপড়াটি কিছুক্ষণ নাচানাচিও করলো। সেখান থেকে নেমে পিঁপড়াটি চলতে শুরু করলো। কয়েকবাড়ি পেরিয়ে এক মন্দিরে ঢুকলো। পুরোহিতের পা বেয়ে শরীর পেরিয়ে ঘাড় বেয়ে কপালের তিলকে গিয়ে বসলো। নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারে না পিঁপড়া। সে নেমে আসলো। মন্দিরের প্রতিমার শরীর বেয়ে উঠতে লাগলো। উঠতে উঠতে মাথার চুলে গিয়ে হারিয়ে গেলো। চুলের গহীনে ঘন্টা দুই একটু জিরিয়ে সে নেমে এল নিচে। নিচেই পেলো গীতা, বেদ, মহাভারত। সব বইয়ে একটু একটু করে চড়ে নিল। ঘ্রাণ নিলো।

সেখান থেকে আবার হাঁটতে শুরু করলো। কয়েক মহল্লা পেরিয়ে তিন দিন তিন রাত পরে পাশের এক গীর্জাতে গিয়ে ঢুকলো। গীর্জার ঘন্টার আওয়াজে আওয়াজে নাচতে নাচতে পিঁপড়াটি গিয়ে উঠলো যীশুর ক্রস এ।

এসব ঘটনা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন মজুমদার সাহেব দেখলেন। আর বাস্তবে হয়তো দেখলেন রাম, রহিম ও পল। মানুষের বিষ্ঠা খেয়ে আসা বিধর্মী স্থান, বস্তু ও চিহ্ন বেয়ে আসা পিঁপড়াটির প্রতি ক্রোধ জন্মালো এ তিন জনের। তিনজনেই পিঁপড়াটিকে মারতে উদ্যত হলো। এবং মেরে হত্যা করলো। পা দিয়ে ভর্তা বানিয়ে মেরে ফেলা নিশ্চিত করলো।

 

তিনজনেই স্বর্গ বা বেহেশত নিশ্চিত হয়ে খুশিমনে নিজেদের বাড়ি গেলো। গিয়ে পরমানন্দে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।

আর এদিকে পিঁপড়াটির আত্মা হাসতে হাসতে চলে গেলো বেহেশতে, স্বর্গে।

আর মানুষের বিষ্ঠা, রহিম, রাম, ও পল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পুস্তকগুলোর দাবিদাররা রয়ে গেলো পৃথিবী নামক জাহান্নামে।

এসব স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আওয়াল মজুমদার ঘুমে আচ্ছন্ন। তখনই বাসায় নক করে প্রতিবেশী হারুণ। হারুণের কলিং বেলের রিং এ ঘুম ভাঙ্গে। মজুমদার সাহেব বুঝতে পারে যে পিঁপড়াকে দেখছিল স্বপ্নেই। স্বপ্ন হলেও বাস্তবই মনে হলো। মজুমদার সাহেব ঘুম ঘুম চোখের আয়েশে থেকেই ভাবতে থাকে। পিঁপড়া নামক প্রাণীটি সকল ধর্মের পথ ও ধর্মগ্রন্থ পদদলিত করে সুখেই জ্ঞানের রাজ্যে ও বিশ্বাসের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারলেও মানুষ পারে না। মজুমদার সাহেব পারে না।  মানুষের মধ্যে বিভাজনের যে সংস্কৃতি আর অন্যদেরকে অবিশ্বাস ও অবহেলা করার যে সংস্কৃতি তা অন্য কোনো প্রাণীতে নেই বলে মজুমদার সাহেব সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

কলিং বেল আবারও বাজতেছে। দরজার খোলার আগে দরজার ফুটো দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে কে এলো। দেখা যায় প্রতিবেশী হারুণ। মজুমদার সাহেব দরজা খুলতে ইতস্তত করছে। সকাল সকাল হারুণ কেন হাজির তা ভেবে পাচ্ছে না। নিশ্চয়ই টাকা ধার চাইতে এসছে। একবার তিনলাখ টাকা ধার নিয়ে তিন বছর ঘুরিয়ে দিয়েছে। আজ আবার কোন মতলব নিয়ে এসছে কে জানে! সন্দেহ ও উদ্বেগ নিয়েই দরজা খুললো। হারুণ বিগলিত হাসিতে সালাম দিলো। আসসালামু আলাইকুম। মজুমদার সাহেব ওয়ালাইকুম বলে বিরক্তি নিয়ে তাকালো হারুণের দিকে। হারুণ একটি প্যাকেট বের করে দেয়। বলে, রাঙামাটি ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে পাহাড়ি কলা ও পেঁপে নিয়ে আসছি আপনার জন্য। মজুমদার সাহেব অবাক হয়। মনে মনে কিছুটা লজ্জাও পায়। লজ্জা ও বিব্রতভাব লুকিয়ে তিনি হাসিমুখে প্যাকেটটি তার কাছ থেকে নেন।

হারুণ সাহেব বসেন না। বাসায় ঢুকেনও না। আবারও সালাম দিয়ে চলে যান। মজুমদার সাহেব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তার মনে সন্দেহ রোগটি বেশি দানা বেঁধেছে। তার কারণ খুঁজতে থাকলেন। পত্রিকা নিয়মিত পড়েন তিনি। পত্রিকায় সব নেতিবাচক নিউজ। নেতিবাচক নিউজ, স্বার্থের রাজনীতি, প্রতারণার খবর, খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে যতসব নেতিবাচক নিউজ ও নৈতিক অবক্ষয়ের খবর পড়তে পড়তে মাথায় সব সেট হয়ে গেছে। এখন যাকে পায় তাকেই সন্দেহ লাগে। এটা মনে হয় রোগে পরিণত হয়েছে। ডাক্তার দেখাতে হবে। স্বপ্নে কি সব পিঁপড়ার হাঁটাহাঁটি দেখলো। এটা নিয়েও মজুমদার সাহেব অস্বস্তিতে আছে। ডাক্তার কাকে দেখাবে ভেবে পাচ্ছে না। ডাক্তাররাওতো আজকাল নকল। ডাক্তার না হয় খোঁজ করে অরিজিনাল ডিগ্রিধারী ও পদধারীর কাছে যাওয়া যাবে। কিন্তু ডাক্তারের যে নৈতিক অবক্ষয় হয়ে পেশাদারিত্ব হারিয়ে হায়েনা ব্যবসায়ীতে রূপ নেয়নি সেটা বোঝা মুশকিল। কারণ সমাজের অন্য সব শ্রেণীর মতো ডাক্তারী, শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা এ তিন পেশাতেও অবনতি দৃশ্যমান।

মজুমদার সাহেব পণ করেন। ভূয়া ডাক্তার বা ব্যবসায়ী ডাক্তার দেখানো বা নকল ওষুধ খাওয়ার চেয়ে ডাক্তার না দেখানোই ভালো। যা হবার হবে।  দরজাটা দরাম করে লাগিয়ে তিনি বাথরুমে ঢুকেন গোসল করার জন্য। গোসলে সারা শরীর ফেনাফেনা করে সাবান দিয়ে ঢলে পরিস্কার করেন।

মনে মনে ভাবেন যেভাবে শরীরের চামড়াটা পরিস্কার করতে পারছেন, সেভাবে যদি নিজের মন, চিন্তা ও কর্মপরিকল্পনাগুলো পরিস্কার করা যেতো, সকল সন্দেহ দূর করা যেতো- তবে কতই না ভালো হতো!

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart