গল্প: ‘বাতির নিচে অন্ধকার’ – সফিকুল ইসলাম
গণি মিয়া মাঠে কাজ করছে। জমির আগাছা পরিস্কারে ব্যস্ত। দুপুরের প্রখর রোদ। পিঠ পুড়ে যাবার মতো অবস্থা। তবে সেদিকে গণি মিয়ার খেয়াল নেই। একমনে কাজ করছে। না, কাজ মন দিয়ে করছে তা নয়। অভ্যাসবশত তার হাত চলছে। মন পড়ে আছে অন্য বিষয়ে। আসার সময় তার বউ কড়া করে বলে দিল। মেয়ের জন্য ছেলে খুঁজতে। জরুরি বিয়ে দেয়া দরকার।গণি মিয়ার চোখে ভাসছে। এইতো সেদিন মেয়েটির জন্ম। কয়দিনে বেড়ে উঠেছে। ক্লাস এইটে পড়ে। এখনো সে বাচ্চা। ওকে বিয়ে দেবার কথা চিন্তাই করতে পারছেনা। তবে বউয়ের কথাওতো ফেলার মতো নয়। চারপাশে লোকজন বলাবলি করছে। মেয়ে ডাগর হয়েছে বিয়ে দিতে হবে। বউ তার খুব চালু। বুদ্ধি আছে বলতে হবে। চারপাশের খবর রাখে। এইতো প্রতিবেশী সামাদ মিয়ার তিন মেয়ে। বড় মেয়েটার কয়েক বছর আগে প্রতিবেশীদের কথায় বিয়ে দেয়নি। এখন আর বড়টার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসেনা। মেঝোটার জন্য আসে। কিন্তু বড়টাকে রেখে মেজোটাকে বিয়ে দেয় কী করে? এ চিন্তা করে মেজো মেয়েটারও বিয়ের বয়স যায় যায় অবস্থা। ওদিকে ছোট মেয়েটাও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে।গণি মিয়ার বউ এত বোকা নয়। সে চোখ কান খোলা রাখে। তাইতো সকালবেলা অনেক করে তাকে বোঝাল। মেয়ের জন্য বর খোঁজতে।শুধু বউকেই বা দোষ দেয কী করে। গত শুক্রবারে নামাজ পড়ে বের হবার সময় হাজী সাহেবও তাকে মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত দ্রুত করতে বললো। ডাগর মেয়েছেলে ঘরে বেশিদিন না রাখাই ভালো। বিভিন্ন পাপ বা অনাচারের সম্ভাবনা থাকে। মেয়ে বিয়ে দেয়া হজ্বের সমান ছাওযাব। ভেবে দেখলো বউ একেবারে মন্দ কিছু বলেনি।
না গণি মিয়া বউয়ের কথায় উঠে বসে মতো লোক নয়। সে বিনাতর্কে বউয়ের কথা মেনে নেয়নি। সে সকালে বউকে অনেক কথা শুনিয়েছে। পাশের বাড়ির রহমানের মেয়েটাকে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে দিল। ১ বছরও সংসার টিকলনা। পেটে বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি আসতে বাধ্য হয়েছে মেয়েটি। মেয়ে সংসারী নয়, কাজের নয়, আক্কেল বুদ্ধি কম এ অজুহাতে স্বামী তাকে ফেলে যায়। অনেক দেন-দরবার করেও কোন ফল হয়নি। গ্রাম্য সালিশ তাকে কোন সহযোগিতা করেনি। শেষে বাচ্চা জন্মের সময় রহমানের মেয়েটি প্রচুর রক্তক্ষরণে বাচ্চাসহ মারা যায়।ডাক্তার বলেছিল খুব কম বয়সে বাচ্চা নেযা ঠিক হয়নি। গণি মিয়া বউকে বলছিল- ”কেন রহমানের মেয়ের কথা তোমার মনে নাই? রহমানের মেয়ের ওই অবস্থা মনে করে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা কর”।বউ খ্যামটা মেরে গণি মিয়ার কথা ছুড়ে ফেলে দিল। তোমার যা কুডাক ডাকা স্বভাব! শুধু অশুভ চিন্তাই তোমার মাথায় আসে। ওই এক মেয়ের উদাহরণ দিয়ে চিন্তা করলে চলবে? গ্রামে আরো কত মেয়েরেই তো বিয়ে হয়েছে। কই কোন সমস্যা তো দেখিনা। ইসমাইলতো তার মেয়েকে বিদেশ থেকেই বিয়ে দিল। নানা হয়ে গেলো। আর তুমি দেশে থেকে মেয়ের জন্য কিছু করতে পারছ না।গণি মিয়া আর কথা বাড়ালোনা। বিড়বিড় করে শুধু বললো সব কথা কী আর শোনা যায়? বলেই বেরিয়ে গেল।বউ এরপরও অনেক কথা বলে যাচ্ছে। সেসব কথা গণি মিয়ার কানে আর গেলনা।
গ্রামের ওসব কমবয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের অনেক পারিবারিক দ্বন্দের কথা গণি মিয়া শুনেছে।কিছুদিন আগে পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের কথাও তার মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন “যে সময় মেয়েটি স্কুল কলেজে সহপাঠীর সাথে পড়াশোনা করা কথা কিংবা হাসিখুশি আর খেলাধূলা উচ্ছলতায় থাকার কথা সেই সময় নেমে আসে এক অভিশাপের কাল মেঘ।বাল্য বিয়ে। সন্তান নেয়ার চাপ, সংসার সামলানোর চাপ ইত্যাদি কারণে কৈশোরের সোনালী দিন বিসর্জন দিয়ে এক যন্ত্রনার কারাগারে বসবাস করে বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরী। অপরিণত বয়সে সন্তান জন্মদানের ফলে মেয়ে ও নবজাতক অপুষ্টিতে ভোগে, ভয়াবহ পরিণতিও হয়।” আবার বউয়ের মুখটি মনে পড়ছে গণি মিয়ার। সঙ্গে বাজখাই গলায় প্রশ্নটি “মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে যে দ্বিগুন যৌতুক লাগবে তা দেয়ার মুরোদ আছে তোমার?” নিজের মেয়ের ভবিষ্যত কী হতে পারে এ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই নিজ জমিতে এসে নিড়াতে শুরু করলো।জমির আগাছা কিভাবে পরিস্কার করতে হয় তা গণি মিয়া জানে, সমাজের আগাছা পরিস্কারের পথ তো তার জানা নাই।জগৎসংসারের এ সর্পিল পথ তার অচেনা।
বাড়ি ফিরেই বউয়ের সাথে পরামর্শ করে মেয়ের বিয়ের বিষয়ে। এক ঘটককে খবর দেওয়া হয়। ঘটক পান খেতে খেতে জানায় বিয়ে দেওয়া কোনো বিষয়ই না। হাজার হাজার পাত্র তার হাতে। মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক নিয়ে আসবে। তবে খরচপাতি কিছু করতে হবে। বিদেশ পাঠানো বা দেশে ব্যবসা করার জন্য নগদ ব্যবস্থা না করলে এখন পাত্র পাওয়া কঠিন। গণি মিঞার বউ এসব পাত্তা দিচ্ছে না। পাত্র ভালো হলে মেয়ের ভালোর জন্য যা যা করার তা তা করবে। গণি মিঞা কিছু বলে না। চুপ থাকে। শেষে ঘটক বললো যে, সব তো হলো কিন্তু একটা সমস্যা রয়ে গেলো। মেয়েরতো এখনো ১৮ বছর হয় নি। জন্মসনদ দিয়ে তো বিয়ে দেওয়া যাবে না। একটা নকল জন্মসনদ বের করতে হবে মেম্বারকে ধরে। স্কুলের সনদ দিয়ে বিয়ে দেওয়া যাবে না। কাজী কাবিন রেজিস্ট্রি করাবে না। ঘটকের বুদ্ধিমতো গণি মিঞা হাজীর হয় মনা মেম্বারের বাড়িতে। গত নির্বাচনে মনা মেম্বারের জন্য অনেক খেটেছে গণি মিঞা। নিজে ভোট দিয়েছে, পাড়া প্রতিবেশীর ভোট যোগাড় করে দিয়েছে। বিনিময়ে পানও খান নি। মনা মেম্বার ঘটনা শুনে প্রথমে না করেন। পরে গণি মিঞা চাপাচাপি করলে জন্মসনদের ব্যবস্থা করে দেন। ফরমে বয়স পরিবর্তন করে দিয়ে ফর্ম প্রত্যয়ন করে তা জমা দেন ইউপি সচিবের কাছে। ক্লাস এইটে পড়ে এ তথ্য গোপন করে চেয়ারম্যান অফিস থেকে নতুন জন্মসনদ নিয়ে দেন।
০২।
কয়েক মাস পরের ঘটনা। মনা মেম্বারের মেজাজটা আজ ভালো নেই। গতকাল থেকেই খারাপ। চেয়ারম্যানের মাধ্যমে উপজেলা থেকে খবর পাঠানো হয়েছে। তাকে যেতে হবে। অল্প বয়সী মেয়েকে ১৮ বছর লিখে জন্ম সনদ দেয়ায় ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। বড় অফিসাররা থাকেন উপজেলায়। তারা গ্রামের কী বুঝবেন? গত ভোটের সময় প্রতিবেশি গণি মিয়া তার জন্য কত কষ্ট করেছে! মেয়ের বিয়ে দেবে সার্টিফিকেট নিতে এসেছে। কাজী নাকি সার্টিফিকেট ছাড়া বিয়ে দেবেনা। তাই বয়স একটু বাড়িয়ে জন্মসনদ দিয়েছে। এতে কী এমন দোষ হয়েছে? গণি মিঞার জন্য মেম্বার হিসেবে সে এতটুকু করবেনা? তাছাড়া মেম্বার হিসেবে তো আয়ও নেই। ২০০/৫০০টাকা ভাতা ৬ মাস পরপর পাওয়া যায়-তা দিয়ে কী সংসার চলে? লোকজন মাঝে মাঝে এসব জন্মসনদ দেয়ার সময় কিছু টাকা নিয়ে জন্মসনদ দেয় মর্মে অভিযোগ করে। মেম্বারতো কখনো কারো কাছে কোন টাকা চায়না। তবে কেউ খুশি হয়ে দিলে না করবে কেন? গ্রামে একসাথে থাকে। প্রতিবেশি সবাই। জন্মসনদ চাইলে না করে দিবে। তা কি করে হয়? তাছাড়া মেয়েছেলে বাড়ন্ত অবস্থায় থাকলেই বরং ঝামেলা। বিয়ে দিয়ে দিলে বাবা মা নিশ্চিন্ত হন। ভোটারদেরকে এমন নিশ্চিন্ত হওয়া থেকে সে মেম্বার হিসেবে বঞ্চিত করবে কেন? পাশের ওয়ার্ডের মেম্বার আবার বয়স বাড়িয়ে জন্মসনদ দেন না। লোকজন প্রতিদিন বাজারে দেখা হলে গালাগালি করে। অমুক মেম্বার আইন দেখায়, বাল্য বিয়ের কুফল শোনায়। জ্ঞান দেয়। জন্মসনদ চাইলে ঘুরায়। আমার মেয়ে আমি বিয়ে দেব, মেম্বারের কী সমস্যা? ভোটের সময় তো এত জ্ঞানের কথা ছিলনা। এখন এত কথা কেন? পরেরবার ভোট আসুক দেখমুনে!
যতই যুক্তি থাকুক, মনা মেম্বারের উপজেলায় যেতে হবে- এ ভাবনায় মন চটে আছে। সে দুবার চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়েছে। চেয়ারম্যান বলে দিয়েছে, অন্যায় করেছো জবাব দিবা।আমারে আর ফোন করে বিরক্ত করোনা। কিন্তু পাল্টা জবাবে মেম্বার চেয়ারম্যানকে বলতে পারেনি যে, গত সপ্তাহে চেয়ারম্যান সাহেবের ভাতিজির বিয়ের সনদের জন্যও মেম্বার সাহেব থেকে একটি ফর্মে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। জন্মসনদ চেয়ারম্যানই দেন। তবে চেয়ারম্যানরা নিরাপদ থাকার জন্য মেম্বার সাহেবদের কাছ থেকে আবেদন ফর্মে স্বাক্ষর/সুপারিশ নেন। তখন চেয়ারম্যান সাহেব ফোন করে বিগলিত সুরে সুপারিশ দিয়ে দিতে বলেন। অথচ এখন কোন সহযোগিতা করছেন না। জমির ক্রয় বিক্রয়ে উত্তরাধিকার সনদও এরুপ করিয়ে নেন এ চেয়ারম্যান। মেম্বারের এরকম অনেক ঘটনা মনে পড়লেও চেয়ারম্যানকে কিছু বলতে পারলো না। কারণ সামনে টি আর কাবিখার বরাদ্দ আসলে আবার বন্টনে সমস্যা হবে। এলজিএসপির প্রজেক্ট থেকে তার ওয়ার্ড বাদ পড়বে! দেয়া নেয়ার অনেক হিসেবের মধ্যে মেম্বারের মাথায় বাল্য বিয়ে কী ও তার কুফল ঢুকার কথা না! যাই হোক পরদিন উপজেলায় গেল। অনেক জেরা আর কথার মাঝখানে মেম্বারের মুখ দিয়ে কোন কথা আসেনি। তবে হুট করে এটুকুই বলতে পারলো যে “গত মাসে যে ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বারনির ১৫ বছরের ছেলের সাথে ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বারের ১৪ বছরের মেয়ের বিয়ে হলো তখনতো কিছু বললেননা, আমি গরীব ভোটার গণি মিঞাকে সহযোগিতা করতে সনদ দেয়ায় আমার দোষটা দেখলেন।”! অফিসার তৎক্ষণাৎ চেয়ারম্যানকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা পেলেন! তবে আগে জানতে পারেন নি। পাত্রপাত্রী অন্য জেলায় আছে! অফিসার নরম করে শুধু এটুকুই বললেন- ঐ মেম্বারের অপরাধ তার, আপনার অপরাধ আপনার। সুতরাং ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন মার্সি নেই। তবে অফিসার মনে মনে ভাবে- বেড়ায় যখন ক্ষেত খায়, সে খেত কে বাঁচায়! বাতির নিচে অন্ধকার দশা!
০৩।
রাত বারোটা পার হয়েছে। অফিসার ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে কেউ একনাগারে কথা বলে যা্চ্ছে। “স্যার আমতলী গ্রামের পূর্বপাড়ার কামাল মিঞার মেয়ের বাল্য বিয়ে হচ্ছে। স্যার বিয়েটা ঠেকান। ইত্যাদি। অফিসারের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ইউপি চেয়ারম্যান আর মেম্বারকে ফোন করে ব্যবস্থা নিয়ে বাল্য বিয়ে বন্ধ নিশ্চিত করে তৎক্ষণাত জানাতে বললো। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসতে চায়না। অফিসারের মাথায় বাল্য বিয়ের আজব সব ঘটনা ঘুরতে লাগলো। ষাট বছরের বৃদ্ধ ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে করছে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ার পর মেয়ে ও মেয়ের মা রীতিমতো চার্জ করেছে অফিসারকে । আমার বিয়ে আমি করবো আপনার কি? যেভাবেই বিষয়টিকে মেনেজ করে বরকে আটক করা হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় পরদিন এ বিয়ের পক্ষে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সকল বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের পদস্থ কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তাসহ অনেকেই ষাট বছর বয়সী লোকের পক্ষে ফোন করে তদবির করেছিল।তবে বিয়েটা হতে দেয়া হয়নি। আবার বিয়ে হয়তো আটক থাকেনি।অন্য জেলায় গিয়ে সম্পণ্ন হয়ে থাকতেও পারে!
আরেকটি বিয়ে ভাঙার পরদিন জানা গেল মেয়েটির পরিবার এলাকা ছাড়া। কারণ আর কিছুই নয়। মেয়েটির বা তার বাবা-মার বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল না।বখাটের হাত থেকে রক্ষার জন্যই বিয়ে ঠিক করেছিল। অফিসার এসে বিয়ে ভেঙ্গে দেন। কিন্তু স্থানীয় বখাটে এত ক্ষমতাবান যে মেয়েটি বা তার বাবা-মা আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছিল। যদিও অনেকে বলেছিল, প্রশাসনকে জানাও প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে। ওই পরিবারের উপলব্ধি হলো, প্রশাসন কি প্রতিদিন আমার মেয়েকে পাহাড়া দিবে? কথাটাতো হালকা নয়।নির্মম সত্য। অফিসারের ঘুম আজকে আর হলোনা বুঝি। মাথার ভিতর বাল্য বিয়ের কাহিনীর জটলা বাধঁছে। আরেকটি বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে অফিসার রওয়ানা হয়েছে। মাননীয় সংসদ সদস্যের ফোন। সংসদ সদস্য বলে কথা। বাল্য বিয়ের পক্ষে সরাসরি কিছু বললেন না। তবে যা বললেন তাতে যা দাঁড়ায় তা হলো- আপনি যান বিয়েটা বন্ধ করে দিয়ে চলে আসেন। পরে আমার লোকজন ব্যবস্থা নিবে। আপনাকে কেউ ফোন দিলে ফোন ধরবেন না। ঠিক আছে? জ্বি স্যার!অফিসারের কপালটা ঘামলো। এও কী সম্ভব? বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত আইনতো সংসদেই পাশ হয়েছে! যাক, সে বিয়ের আসরে গিয়ে বরকে পাওয়া গেল না। ঘটককে পাওয়া গেল। কারাদন্ড দেয়া হলো। এ নিয়ে পরে অনেক হৈচৈ। সাংসদদের কাজ সংসদে আইন করা। তাঁরা এখন এলাকার বাড়ির সীমানা, বিয়ের ঝামেলা, গ্রামীন বচসা ইত্যাদিতে নাক গলান। এসব তুচ্ছ বিষয়ে সময় দিলে দেশের জন্য মানসম্মত আইন তৈরি করবে কারা? – অফিসার ভেবে পায় না।
অফিসার আবারও এপাশ থেকে ওপাশে ফিরে শোয়। ডান হাতের তালুতে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করতেই আবার আরেকটি বিষয় মাথায় ঘুরে। বাল্য বিয়ে বন্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। অনেক খবরে তাঁদের মাধ্যমেই আসে। তবে ভিন্ন ঘটনাও আছে। এক সাংবাদিক একবার ফোন দিল। স্যার অমুক গ্রামে আমি আসছিলাম। এখানে একটা বাল্য বিয়ে হচ্ছে। অফিসার আসছি বলে ফোন রেখে দিল। বিশ মিনিট পর ঐ একই সাংবাদিক জানালো স্যার আপনার কষ্ট করার দরকার নেই। আমার ভুল হয়েছে। মেয়েটির বয়স ঠিক আছে। অফিসারের সন্দেহ হওয়ায় ওখানকার মেম্বারকে ফোন দিল। মেম্বারও বললো মেয়েটির বয়স ঠিক আছে। তো অফিসার আর গেলনা । সাত দিন পর খবর পাওয়া গেল মেয়েটির বয়স ১২ ছিল। মেয়েটির বাবার কাছ থেকে সাংবাদিক ও মেম্বার সুবিধা গ্রহণ করে তথ্য গোপন করেছে। ততক্ষণে বরকণে অন্য জেলায়। মেয়েটির বয়সের প্রমান স্কুল থেকে জানা গেছে। কিন্তু সাংবাদিক ও মেম্বারের কৃতকর্মের কোন প্রমাণ নেই!
অবাক করার মতো বিষয় হলো অনেক বাল্য বিয়ের খবরই জানা যায় না। যখন আশেপাশের সবাই মিলে বিয়েটি সংঘটিত করান তখন তা কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনা। মূলত কয়েকটি কারণে বাল্য বিয়ের খবর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। যারা এসব খবর প্রচার করে তারা হলো- ক) স্থানীয় বখাটে যার প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, খ)গত নির্বাচনে ভোট না পাওয়া মেম্বার, গ) প্রতিবেশী যার সাথে ঝগড়া, ঘ) ইতিপূর্বে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নাকচ হওয়া পরিবার, ঙ) মেয়েটির অল্পবয়সে অসমাঞ্জস্য কোথাও প্রেমে পড়া ও বাবা-মার কাছে ধরা খাওয়ায় প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক এসব খবর প্রচার করেন, চ) গ্রামের জমি নিয়ে, বাড়ির সীমানা নিয়ে বচসা রয়েছে এমন পরিচিত কেউ, ছ) রাজনৈতিক বা ধর্মীয় তীব্র মতভেদ থেকে ঈর্ষায় ভোগা কোন ব্যাক্তি ।ইত্যাদি। সত্যিকার অর্থে বাল্য বিয়ের কুফল থেকে বাঁচাতে কেউ ফোন করে এমনটা খুব কম ঘটে।
অফিসার খুব আতঙ্কিত হয় আরও একটি মারাত্মক সমস্যার কথা ভেবে- বাল্য বিয়ের অনেক ক্ষেত্রে নিকাহনামায় নিবন্ধন হয় না। যেহেতু মেম্বার বা চেয়ারম্যান কোন জন্মসনদ দেন না সেহেতু কাজী বিয়ে পড়ান না। স্থানীয় মসজিদের ইমাম শরীয়া নিয়মে কবুল বলান। এতে মেয়েটির জীবন সম্পূর্ণ অনিশ্চায়তার মধ্যে পড়ে। আইনগত কোন ভিত্তি তৈরি হয়না। এরকম একটি বিয়ে তিনমাসের মধ্যে ভেঙ্গে যাওয়ার পর মেয়েটির বাবা অফিসারের কাছে এসছিলেন। সহযোগিতা কামনা করতে। তখন আর কি করা যায। মেয়ে, মেয়ের মা আর বাবার চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোন গত্যান্তর আছে কি? নিজেই নিজের জন্য খাদ বানালে তাকে কে রক্ষা করে?
অফিসারদের মধ্যেও চিন্তার তারতম্য রয়েছে। অফিসারের এক সহকর্মী ঐদিন সভাশেষে বলছিল- বাল্য বিয়ের বিষয়ে তিনি খুব কঠোর। এক বছরের নিচে কোন কারাদন্ড নেই। কোন ছাড় নেই।খবর পেলেই হলো। সঙ্গে সঙ্গে হাজির। বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া, গ্রেফতার ও কারাদন্ড।
অন্য অফিসার আবার বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখেন। আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় তিনি চিন্তা করেন। গরীব পরিবার, মেয়ে বিয়ে দিয়ে একটু ভার লাগব করতে চায়। তাই হুট করে এসব বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়ে তার বিয়ে ভাঙতে ভালো লাগে না।
অন্যজন বলেন, আইন ও বাস্তবতার মধ্যে একটা ব্যালেন্স করা দরকার। মানুষকে সচেতন করতে হবে, বোঝাতে হবে। বাল্য বিয়ের কুফল অনেক। অধিক জনসংখ্যা, মাতৃ মৃত্যুহার ও শিশুমৃত্যুহার এর সাথে সম্পৃক্ত। মাঝে মাঝে দু একটা শাস্তিও হতে হবে। অফিসার নিজেও বিষয়টি নিয়ে দোদোল্যমানতায় ভোগেন । আইনি বিধান, মেয়ের পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থা, সমাজে বখাটেদের দৌড়াত্ম, কম বয়সে মা হওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি, বাল্যবিয়ের সাথে দেশের জনসংখ্যা, জনসম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন ইত্যাদি বিবেচনা করতে গেলে এ বিষয়ে সুক্ষ্ম ন্যায়বিচার সুদূরপরাহত।
রাত তিনটা বেজে যায়। অফিসারের আর ঘুম আসে না। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র এ অফিসার সমাজ বিশ্লেষণ করে কোনো কূল কিনারা পান না। সমাজবিদরা ঠিক করেছেন বাল্য বিয়ে দেশের পক্ষে অমঙ্গলজনক। এতে সন্তান দুর্বল হয়, পরিবার ভাঙ্গে, দম্পতির কষ্টে লোনাজলে হাবুডুবু খেতে হয় ইত্যাদি। সরকারি বিধানে বাল্য বিবাহ দন্ডনীয় অপরাধ হলেও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ নিয়ে গোপনে অনেক মত প্রচলিত। কেউ বলে বাল্য বিয়ে ভালো কেউ বলে মন্দ, কেউ বলে উচিত কেউ বলে অনুচিত, কেউ বলে মঙ্গল, কেউ বলে অমঙ্গল। নানুদের এখনো বিশ্বাস ঋতুস্রাব শুরু হওয়া মাত্র কনের বিয়ের দেয়া উচিত।
আসলে প্রত্যেকেই নিজস্ব অবস্থান, শিক্ষা ও ধারণা নিযে উপসংহার তৈরী করে। অনেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা তুলে ধরেও অবস্থান নেয়। এমন ছেলেও আছে যে কিনা নিজে বাল্য বিয়ের জন্য আসামীকে গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদানে সহযোগিতা করেছে আবার পরে নিজেই ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছে। এমন ছেলেও আছে যে এনজিওর পক্ষ থেকে বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত সচেতন প্রোগ্রাম করে বেড়ায় কিন্তু বাস্তবে নিজে ষোড়শীকে বিয়ে করেছে।এমন মেয়েও বিদ্যমান যে হাত ধোয়া প্রোগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রামের সচেতন প্রোগ্রামে কাজ করতো এবং বাল্য বিয়ে নিয়ে অন্যদের সচেতন করতো। পরে শোনা গেল মেয়েটি কারো হাত ধরে রাতের আঁধারে পালিয়েছে। দুজনেই ২১/১৮ অতিক্রম করেনি। আমরা যা ঘৃণা করি অবচেতনে আবার সেইটেই ভালোবাসি। এ এক অপার লীলা। বাল্য বিয়ে মেয়েদের জন্য ভালো নয় এমন বিশ্বাসী নারী নেত্রীকে দেখা যায় যিনি বেশি বয়সী মেয়েকে নিজের ছেলেকে দিয়ে বিয়ে করাবেন না। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে আমাদের সমাজে বা্ল্য বিয়ে সম্পর্কে সবাই সজাগ ও সবাই সচেতন। পরিহাস হলো এই যে এ সজাগ ও সচেতনদের অনেকেই বাল্য বিয়ের প্রতি আসক্তিতে ভোগেন। তাই এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব না হলেও কঠিন। সবসময় সবখানে সর্বাবস্থায় বাল্য বিয়ে নিষিদ্ধকরণ সঠিক কিনা সে নিয়েও একাডেমিক আলোচনা ও গবেষণা হতে পারে।আমাদের সমাজে অনেকের মধ্যেই আনমনে এটা কাজ করে যে কমবয়সী মেয়েরা বিয়ের জন্য ভালো।অশুভ চক্রের মধ্যে সমাজ ঘুরছে।সমাজের ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথা‘ দশা।
০৪।
এরকমভাবেই দিন মাস আর বছর যায়। এক সকালে একটা খবর শুনে মনা মেম্বারের মন খুব খারাপ। গণি মিঞার মেয়েটি বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে হাসপাতালে মারা গিয়েছে। গণি মিঞা ও গণি মিঞার বউ পাগলের মতো অবস্থা। রক্তশূন্যতা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে বাচ্চা নেওয়া ও প্রসবের মতো শারীরিক অবস্থা তৈরি হয় নি গণি মিঞার মেয়েটির। হাস্যোজ্বোল মেয়েটির মুখ মনে পড়ে মনা মেম্বারের। মার হাত থেকে পান এনে দিয়েছিল“ একদিন। উচ্ছল সেই কিশোরিটি আর বেঁচে নেই তা মনা মেম্বার আর ভাবতে পারে না। কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মনা মেম্বারের ভূমিকা ছিল। মনা মেম্বার গণি মিঞাকে বাধা দেয় নি। মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নি। মনা মেম্বারের নিজের মেয়েটি উঠানে বউচি খেলতেছে। চুল বেণী করা দূরন্ত কিশোরী। মনা মেম্বার নিজের মেয়ের মুখে গণির মিঞার মেয়ের মুখটি দেখতে পায়। মনা মেম্বারের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। অনুশোচনায় ভেঙ্গে পড়ে। আল্লাহর কাছে মনে মনে মাফ চায়। হে আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে রক্ষা করো। মেয়েটা আমার জীবন।
