Detail

Home - গল্প - গল্প: ‘শূন্য জীবনে ভালোবাসা’ – সফিকুল ইসলাম

গল্প: ‘শূন্য জীবনে ভালোবাসা’ – সফিকুল ইসলাম

অনেককাল আগের কথা। নিজ গ্রাম থেকে ৪ ক্রোশ দূরের এক গ্রামে লজিং থাকে শরীফ মাস্টার। সব ঠিকঠাক চলছিল। ওই গ্রামের যে বাড়িতে শরীফ থাকে, ঠিক তার পাশের বাড়িতে ছিল  এক লোক। টিবি রোগী। বয়স বেশি হবেনা; বড়জোর ত্রিশ। বউ আছে; একটা বাচ্চাও আছে। গরীব তাই অর্থকষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। টিবি রোগে চিকিৎসা করতে না পারায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে লোকটি। হাড় গোনা যায় সব; চোখও কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে। দেখলেই ভয় লাগে। বউ তাকে ছেড়ে চলে যাবে যাবে করছে; বাবা মাও তাকে দেখভাল করে না।

 

একদিন শরীফ মাস্টার ওযু করতে যায় টিউবওয়েলে। টিউবওয়েলটি দুই বাড়ির মাঝখানে। টিউবওয়েলের পাশেই টিবি রোগীর মায়ের রান্নাঘর। ওখান থেকে কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওযুশেষে শরীফ মাস্টার কালিমা শাহাদত বিড়বিড় কর পড়ছিলেন। তখনি শুনতে পায়। টিবি রোগীর মা বলতেছে ‘‘ যেটা দিছি সেটাই বেশি, তুই না খেয়ে থাকবি, না খেয়ে মরতে পারিস না? কোন কাজ করার তাগদ নেই, সারাদিন কেবল খাই খাই।‘‘ জবাবে টিবি রোগী খুবই ম্রিয়মান গলায় বলল ‘‘ আমি তো সারাদিন খাই খাই করি না। আমি তো বুকের ব্যথায় খেতেই পারি না। দুবেলা খাবার দাও, তাও কম। কাঁশতে কাঁশতে আমার দম যায়। আমার শ্বাস কষ্ট হয়। তোমরা সবাই খেলে গরম গরম রুটি আর আলু ভাজি। আর আমাকে দিলে গতকালের শুকনা আটার রুটি। শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে। আমি গিলতে পারি না। পানি দিয়েও গলা দিয়ে নামে না।‘‘ জবাবে তার মা খেঁকিয়ে ওঠে, ‘‘কাজ করতে পারিস না, বউ বাচ্চা নিয়ে পড়ে আছিস, খাওন যা দেই তা-ই বেশি।‘‘  শরীফ মাস্টার আড়চোখে দেখতে পায় টিবি রোগীর দুগাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। দারিদ্র্য আর অসুস্থতার কষাঘাতে মা-সন্তানের সম্পর্কও কত রুঢ় হতে পারে- তা ভাবতেই শরীফ মাস্টারের চোখ ছলছল করে।

 

টিবি রোগীর আরও কয়েকজন ভাই বোন আছে। যারা তাগড়া, আয় করে, সামর্থবান। তাদের নিয়েই ব্যস্ত বাবা-মা। টিবি রোগী হলো তাদের বড় ছেলে। তার দিকে তাকানোর সময় নেই কারো। টিবি রোগীর থাকার ঘর নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই। আসলে তার জন্য কিছুই নেই। মাঘ মাসের শীতে কাঁশতে কাঁশতে তার জীবন বাইর হয়ে যায় অবস্থা । তবু তার জায়গা গরুর গোয়ালের একটি অংশে; একপাশে মেঝেতে। কোনরকমে দিন যাচ্ছে। টিবি রোগীর বউও ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে। একদিন শরীফ মাস্টার পড়ার টেবিল থেকেই দেখতে পায়, দূরের আমগাছটির নিচে দাঁড়িয়ে টিবি রোগীর বউ। কোলে বাচ্চা নিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে পাশের বাড়ির এক লোকের সাথে। কী জানি কথা হচ্ছে কে জানে! তবে উভয়েই আনন্দে মেতে আছে। হতে পারে গোপন সম্পর্ক বা গোপন সম্পর্ক না হোক কথাবার্তার ধরণে তাদের মধ্যে আত্মিক সংশ্লেষটা বোঝা যায়। এরই মাঝে লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে টিবি রোগী হাজির আমগাছতলায়। দেখেই টিবি রোগীর বউ শক্ত হয়ে যায়। কেন ঘর থেকে বের হলো, কেন এত নড়নচড়ন ইত্যাদি নিয়ে হুল ফুটিয়ে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। পাশে দাঁড়ানো লোকটি চলে যায়। তারপরও টিবি রোগীর বউয়ের কথার হুল ফোটানো বন্ধ হয় না। অকেজো বেকার পুরুষ কতটা অবহেলিত হতে পারে, আর কতভাবে অপমানিত হতে পারে তা টিবি রোগীকে না দেখলে শরীফ মাস্টার বুঝতেই পারতো না।

 

শরীফ মাস্টার মনে মনে ভাবে টিবি রোগীর সাথে কি তার বউয়ের শারীরীক সম্পর্ক হয়?, শরীরের যে অবস্থা তাতে টিবি রোগী তা পারার কথা না। টিবি রোগীর বউ তবে কি নিয়ে থাকবে? স্বামীর শরীর নেই, আয় নেই, শাশুড়ি, ননদ ও দেবরদের প্রতিনিয়ত অপমান সহ্য করে কোনোরকমে টিকে আছে। এরপরও প্রেম কোথা থেকে আসবে টিবি রোগীর প্রতি! শরীফ মাস্টার জেনেছে যে কয়েকবছর আগেও টিবি রোগীর শরীর ভালো ছিল। ঢাকাতে  বেকারির হকার ছিল। মাসে মাসে ভালো আয় করতো। সংসারের খরচ সব সে-ই দিতো। ভাইবোনদের পড়ালেখার খরচও। আজ টিবি রোগে মৃত্যুপথযাত্রী হওয়ায় তার কোনো মূল্য নেই কারও কাছে।

 

শরীফ মাস্টার লোকটিকে দেখে, মায়া লাগে। কষ্ট লাগে। জগত সম্পর্কে বুঝতে পারে না, তবু কেমন ভাবনা এসে তার মধ্যে ভর করে। বই খাতায় যা পড়ে, মসজিদের বয়ানে যা শুনে, আর স্যারেরা বা মুরব্বীরা যা বলে তার সাথে কোন মিল পায় না। ভেতরে ভেতরে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয় শরীফ মাস্টার। শরীফ মাস্টারের কিশোর মন কষ্টে কাঁপে, ক্ষোভে ফাটে। কিন্তু কিছু করার নেই।

.

এভাবেই একদিন প্রতিবেশী টিবি রোগী মারা যায়। তারে দাফন কাফন করার তেমন লোকও পাওয়া যায় নি। কারো চোখে কোন কান্নাও চোখে পড়েনি। বিলাপের আওয়াজ কানে আসে নি। সে যেন মরে গিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। এমন অবস্থার মধ্যেই ধর্মীয় নিয়মে তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা হলো। জানাযায় শরীফ মাস্টারসহ কয়েকজন লোকই ছিল। শরীফ মাস্টারের মনে আশ্চর্যই লেগেছে। এত কম মানুষ নিয়ে জানাযা সে গ্রামে কখনো পড়ে নি। ইমাম সাহেবও কোনোরকমে জানাজা পড়িয়ে বিদায়। যেহেতু হাদিয়া দেওয়ারও কেউ নেই। আজ বড়লোক কেউ হলে, জানাজা পড়িয়ে কবরস্থানে গিয়ে লম্বা দোয়া হতো। একদফা দোয়া নয়, তিন দফা দোয়া হতো। তিনটাই লম্বা লম্বা সুরে নানান ইনানি বিনানি দোয়ার আয়োজন হতো। স্তুতি ও দোয়ায় মৃতের বাড়ির কোনো কিছু বাদ পড়তো না। লম্বা টানে হুজুর ঘন্টা লাগিয়ে দিতো। কিন্তু এখানে যেহেতু হাদিয়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেহেতু হুজুরের তাড়া বেশি। জানাজা শেসে দ্রুত কেটে পড়েছে হুজুর। অন্যরাও। দুতিনজন লোক মিলে কোনো রকমে মাটি চাপা দিয়েছে। যাক, বেচারা মরে গিয়ে বেঁচেছে। মাটির নিচে নিশ্চয়ই শান্তিতে আছে। জীবিত থাকতে যে অবহেলা আর নিষ্ঠুরতা সে দেখেছে, তাতে তার মরে গিয়েই ভালো হয়েছে। প্রতিদিন দেখতে দেখতে শরীফ মাস্টার বিচলিত ছিল। শরীফ মাস্টারও কেমন যেন একটু মুক্তি মুক্তি অনুভব করলো।

.

যাক ঘটনা এখানেই শেষ না। তখনকার সমসাময়িক ঘটনাগুলোর মধ্যে ওই গ্রামে একটি ঘটনা ঘটে। গ্রামের দুই গোষ্ঠীতে ঝগড়া হয় এবং রাহাজানি ও মারামারিতে একজন খুন হয়ে যায়। একজন ভালো মানুষ, নির্দোষ লোক খুন হন। যে লোকটি খুন হন তার ছেলে সন্তান নেই। দুটি মেয়ে সন্তান। কিশোরী। বাবার মৃত্যুতে কিশোরী দুটো এতিম হয়ে যায়। তাদের মা বিধবা হিসেবে অকূল সাগরে পড়ে। বিধাতার বিচার বুঝতে পারে না। গ্রামের ক্ষমতাওয়ালাদের ঝগড়া। সেই ঝগড়ার মাঝে তার স্বামী কেন মারা গেলো তা ভেবে পায় না। এত লোক ঝগড়া করলো। দা বল্লম টেট্টা নিয়ে অংশ নিল। তাদের কেউ খুন হলো না। খুন হলো যে কারো সাতে পাঁচে নেই। সাধারণ নিরীহ মানুষ। যার দুটো মেয়েকে দেখবার বা খাওয়াবার জন্য কেউ নেই। গ্রামের সবাই অবাক হয়, দু:খ পায়।

 

খুন হওয়া পক্ষ মামলা করে। মামলায় খুনী পক্ষ ফেঁসে যায়। অনেক বড় বড় লোক আসামী। গ্রামের দুপক্ষেই অনেক বড় বড় লোক, টাকাওয়ালা আছে। জাতীয় পর্যায়ের ধনী লোক। লক্ষ লক্ষ টাকা যাচ্ছে কিন্তু কোন সমাধান হচ্ছে না। খুন করা পক্ষ কোনভাবেই মামলায় সুবিধা করতে পারতেছে না।

.

এভাবেই দিন কাটছিলো। গ্রামের মানুষের মেল-মিটিং, বাজার-সওদায়, পথে ঘাটে এ নিয়ে বিশাল আলোচনা। মামলায় কোন পক্ষ এগিয়ে বা পিছিয়ে, কার বেশি টাকা, কার কম টাকা, উপরে কার লোক বেশি, কার লোক কম- ইত্যাকার নানান বিষয়ে হাজারো কল্পকাহিনী। হঠাৎ একদিন শরীফ মাষ্টার শুনে যে, ম্যাজিস্ট্রেট আসবে, পুলিশ আসবে, টিবি রোগীর লাশ উত্তোলন হবে, ইত্যাদি । সে কিছুই বুঝতে পারিনা। ঘটনা কি? যে মানুষ জীবিত থাকতে কেউ তাকাতো না, খেতে দিতোনা, চিকিতসা ছিলোনা, মরে যাওয়ার পর তার লাশ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো যে রাষ্ট্র আসতেছে! ম্যাজিস্ট্রেট আসতেছে, পুলিশ আসতেছে। ঘটনা কী!

.

পরে যা শুনলো, দেখলো ও বুঝলো তা আর ভাষায় প্রকাশের না। ওই যে গ্রামের দুপক্ষের মারামারিতে একপক্ষ খুনের মামলার আসামী তারা মামলায় সুবিধা করতে পারতেছিল না। তাই তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানান সুযোগ খুঁজতেছিল। তাদের পক্ষের কেউ টিবি রোগীর মা-বাবার সাথে কন্টাক্ট করেছে। চুক্তি অনুসারে বাবা-মা গিয়ে বলেছে যে ‘তাদের বড় ছেলেকে (টিবি রোগী) হত্যা করা হয়েছে“। এবং এ মর্মে বিরোধী পক্ষকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলা করেছে বাবা-মা বাদী হয়ে । বিরোধী পক্ষ আদালতকে জানিয়েছে ওটা স্বাভাবিক টিভিজনিত মৃত্যু। আদালত আদেশ দিয়েছে তদন্ত করার জন্য। সেই মামলার কারণে আদালতের আদেশে ম্যাজিস্ট্রেট/পুলিশ আসতেছে লাশ তুলতে। এবং তুলেছে। হাজার হাজার লোক, নেতা-পাতিনেতা, সাংবাদিক, লোকে লোকারণ্য। শরীফ মাস্টার দেখে আর ভাবে মরার সময় জানাযায় লোক ছিল না কয়েকজন। আর এখন লাশ উত্তোলনে হাজার হাজার লোক। লাশ তোলার দৃশ্য সবাই দেখতেছে। টিবি রোগীর লাশ তুলে মাটির উপরে রাখা হলো। কবরস্থান নয়। যে পরিত্যাক্ত জমিতে মাটি দেওয়া হয়েছিল সেখান থেকেই লাশ তুলে জমিতে রাখা হলো। লাশ দেখা ও কাটাছেঁড়া ও স্যাম্পল সংগ্রহে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার ব্যস্ত। টিবি রোগীর আত্মাটি ভাবলো যা-ই এই ফাঁকে একটু মাকে দেখে আসি।

 

টিবি রোগীর মা তখন নামাজের বিছানায় বসে আল্লাহকে ডাকতেছে। আল্লাহর কাছে ছেলের জন্য দোয়া করায় ব্যস্ত। আল্লাহ যেন তার ছেলেকে মাফ করে দেয়। মা হয়ে মিথ্যা খুনের মামলা দায়ের করেছে – এ অপরাধ যেন আল্লাহ পাক মাফ করে দেন। সেই দোয়াও তিনি করছেন। দরজা বন্ধ করে কেঁদে কেঁদে বিধাতার নিকট হাত তুলে দোয়া করছেন। মানুষ এমনই। জগন্য সব অপরাধ করবে আর তারপর আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করবে মাফ করতে। এমনকি অপরাধ চলমান রাখা অবস্থাতেই মানুষ আল্লাহর নিকট দোয়া করে। নিরাপত্তা চায়, নাজাত চায়, মুক্তি চায়, নিষ্পাপ হতে চায়। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করেই টিবি রোগীর মা দোয়া, কান্না বা মায়াকান্না করে যাচ্ছিল। তখনই টিবি রোগীর আত্মা এসে ঘরে হাজির। হঠাত টিবি রোগী কথা শুরু করে।

‘‘মা, তুমি কীভাবে পারলে আমার লাশ ব্যবহার করে এরকম মিথ্যা মামলা করতে? এখন যে ওরা আমার লাশ তুলে কাটাকাটি করতেছে আমার কি কষ্ট হচ্ছে না? তোমার কি ভালো লাগছে? ওরা নাকি আমার কলিজা নিয়ে যাবে। বায়োপ্সি টেস্ট করবে। আমার কলিজা তো জীবিত থাকতেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল। তোমরা যে আচরণ আমার সাথে করেছো তাতে আমার কলিজা কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। আমি তোমাদের সবাইকে মুক্তি দিতে মরে গিয়েছিলাম। মরে গিয়ে নিজেও বেঁচেছিলাম, তোমাদেরও বাঁচিয়েছিলাম। মুক্তি পেয়েছিলে তোমরা। তবে এখন কেন এই মিথ্যা মামলা? আচ্ছা ওরা যদি কলিজা নিয়ে গিয়ে জেলা সদরে বায়োপসি করে ওরা কি জানতে পারবে, কারা আমার কলিজাকে এমন ক্ষতবিক্ষত করেছে? তুমি, আমার মা হয়ে তা করেছো, আমার ভাই, আমার বোন, আমার বউ, সবাই মিলে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করেছো। যদি বায়োপসি টেস্টে সত্যি প্রতিবেদন ধরা পড়ে তবে তো তোমরা ফেঁসে যাবে মা।‘‘

 

ছেলের কন্ঠ শুনে ভয় পেয়ে যায় টিবি রোগীর মা। ঘরের এদিক ওদিক তাকায়। কেবল কথা শুনতে পায়, কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলতে যায়। কিন্তু সে-ই পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এর আগেই বেহুশ হয়ে পড়ে যায়। টিবি রোগীর আত্মা মায়ের বেহুশ হওয়া দেখে নিজের কবরের কাছে ফিরে যায়। কাটাকুটি শেষ। পুনরায় দাফনের কাজ শুরু। আত্মাটি আবার কবরে ঢুকবে নাকি আকাশে চলে যাবে এসব ভাবতে ভাবতে দুদোল্যামানতায় সময় পার করছে।

 

আর  আশেপাশের লোকজন টিবি রোগীর মাকে কোথায় না পেয়ে ঘরে গিয়ে নক করে।  অনেক পরে দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। টিবি রোগীর মার জ্ঞান ফিরে। পাশে শতলোক দেখলেও কোনো প্রশ্নের ‍ুতিনি দিতে পারেন না। সবার কাছে তিনি সব লুকালেও নিজের কাছে তিনি কিছুই লুকাতে পারছেন না ।হাউমাউ করে কেঁদে ভেঙ্গে পড়েন টিবি রোগীর মা।

 

পরে আবার ওযু করে নামাজের আসনে বসে। দোয়া দরুদ পড়ে।  আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে প্রার্থনা করছে। ‘‘ হে আল্লাহ আমার ছেলেকে তুমি মাফ করে দাও। আমার ছেলেকে তুমি বেহেশত নসীব করে দাও। দুনিয়াতে আমার ছেলে অনেক কষ্ট করেছে, এখন মারা যাবার পরেও তার কলিজা কাটা হচ্ছে। তুমি তার কষ্ট লাঘব করে দাও। তুমি তো জানো আমি ছিনাল মা। ছেলের জন্য আমার মন কাঁদতো। ছেলের কষ্ট আমি সইতে পারতাম না। তাইতো ছেলের সাথে মাঝে মাঝে রাগারাগি করতাম। অভাবের সংসার। সবাইরে খাবার দিয়ে তারপর আমরা এই ছেলেকে খাবার দিতাম। সবাই যেহেতু কাজ করে তাই সবাইকে খাবার দিতে হতো। সে যেহেতু বসে থাকতো সেহেতু ওর উপর সবার রাগ বা বিতৃষ্ণা ছিল। আমি তো মা আমার তো বিতৃষ্ণা নেই। আমি চারপাশ সামলামে পারতাম না বলেই রাগে গজগজ করতাম। আমার ছেলেটা আমার কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন বাকি সন্তানদের নিয়েও অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আর এ মামলাতো আমি করতে চাই নি। আমি জানিও না। সর্দার মাতব্বররা বুদ্ধি নিয়ে এসছে, তাই রাজি হয়েছি। আমার এক ছেলে গেছে আরও ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে আছে। ওদের নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাই। এক ছেলেকে বিদেশ পাঠাবে আর নগদ তিন লাখ টাকা দিবে এ আশাতেই মামলাতে রাজি হলাম। ভাবলাম যে, যে ছেলে গেছে সেতো গেছে। বাকিদের নিয়ে আর কষ্ট না করি। না খেতে খেতে অভাবে অভাবে আমার যে মনোবল ভেঙ্গে গেছে। আমার যদি ভুল হয়ে থাকে আমাকে মাফ করে দাও। আমার ছেলেকেও মাফ করে দাও। ছেলেটার খুব কষ্ট হচ্ছে। তার কলিজা নাকি কেটে নিয়ে যাবে। তুমি গাফুরুর রাহিম, তুমি মাফ করে দাও। তুমি রাহমানির রাহীম তুমি আমাদের উপর রহমত নাযিল করো। তুমি তো কষ্ট লাঘবকারী, তুমি আমার ছেলের কষ্ট দূর করে দাও। মা হয়ে ছেলের উপর ভিত্তি করে মামলা দিয়েছি। এটা বড় অন্যায় হয়েছে আমার, আমাকে মাফ করে দাও। আমার  আরও সাত সন্তান রয়েছে। সকলের আরামের জন্য আমি এ অন্যায়টুকু করেছি। আমার এ অন্যায় তুমি মাফ করে দাও। আমার সন্তানের কবরে শান্তি এনে দাও।‘‘

দোয়া করতে করতে কান্না করতে টিবি রোগীর মা আবারও মূর্ছা যায়। প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসে। মাথায় পানি ঢালে। কেউ বলে ‘‘আহারে, ছেলের জন্য শোকে কানতে কানতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে‘‘। কেউ বলে ‘‘কত ঢঙ আর অভিনয়। মিথ্যা মামলা করেছে ছেলের নাম দিয়ে, আবার এখন ছেলের জন্য অজ্ঞান হয়। কত তামাশা দেখবো দুনিয়ায়! হাহ!‘‘

 

 

এদিকে শরীফ মাস্টার কিছুটা অবাক হয়ে, কিছু বিহবল হয়ে লাশ তোলা দেখতেছিল। লাশ পঁচে গেছে। শুকানোর পথে। এ জিনিস তুলে আর কি পাবে বা পাবে না, আল্লাহ মালুম। তবু রাষ্ট্রের নিয়ম আর টাকাওয়ালাদের মামলার খেলা। রাষ্ট্রযন্ত্র এমনই। খেলা দেখাতে পছন্দ করে। আর আমজনতাও তেমনি খেলা দেখতে পছন্দ করে। শরীফ মাস্টার স্বগতোক্তি করে ‘‘আহা মানুষ, আহা পৃথিবী, আহা সৃষ্টির সেরা জীব!‘‘

 

পরে শরীফ মাস্টার জেনেছিল যে, মিথ্যা মামলার বিনিময়ে বাবা-মা নগদ টাকা পেয়েছে, এবং এক ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিবি রোগী জীবিত থাকতে যে বাবা-মা খবর নিতো না ঠিকমতো, সেই বাবা-মা জীবিত সন্তানদের ভবিষ্যত গড়ার জন্য যে চলে গেছে তার সব জলাঞ্জলি দিয়েছেন। অভাবের সংসারে সব ভালোবাসাই নিয়তির নির্মমতার শিকার হয়। এখানেও হয়তো তাই হয়েছে।

আরও অভাবনীয় বিষয় হলো টিবি রোগীর স্ত্রী বা সন্তান একদিন এসে হাজির। টিবি রোগী মারা যাবার পরে তাদের এ বাড়িতে জায়গা হয় নি। তাই বাধ্য হয়ে চলে গিয়েছিল বাপের বাড়ি। এখন তার লাশ নিয়ে মামলা হয়েছে সেখান থেকে টাকা পেয়েছে। সেই টাকার ভাগ নিতে হাজির হয়েছে স্ত্রী ও সন্তানরা। কিন্তু টিবি রোগীর বাবা মা ভাইবোনেরা এই মহিলাকে বাড়িতেই ঢুকতে দিতে রাজি না। মহিলা প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যায়। বিচার দেয়। কিন্তু কোনো প্রতিবেশিী এগিয়ে আসে না। কারণ প্রতিবেশীরা বিষয়টাতে বিরক্ত। সামনে কিছু না বললেও মনে মনে পুরো মামলা ও আর্থিক লেনদেনের ঘটনা তাদের হতবিহ্বল করেছে। মহিলা সর্দার মাতব্বরদের কাছে যায়। সর্দার মাতব্বর সবাই টাকার ভাগ পেয়েছে। সুতরাং কেউ মহিলাকে পাত্তা দেয় না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে আশ্বাস দেয়। বলে, পরে আসতে , পরে ব্যবস্থা করে দেবে। এভাবেই দিন যায়, রাত যায়। স্ত্রী সন্তানরা উক্ত মিথ্যা মামলা থেকে প্রাপ্ত টাকার কোনো ভাগ পায় নি। যেহেতু চুক্তি হয়েছে বাবা-মার সাথে আর মামলা করেছে বাবা-মা, সেহেতু টিবি রোগীর স্ত্রী সন্তান কোনো সুবিধা পায় নি। কয়েকদিন দ্বারে দ্বারে ঘুরে টিবি রোগীর স্ত্রী চলে যায় বাপের বাড়ি।

 

যাওয়ার সময় যে পরিত্যাক্ত জমিতে টিবি রোগীর ওটার পাশ দিয়েই যায়। টিবি রোগীর স্ত্রী হঠাত করে থেমে য়ায়। কে যেন তার হাত ধরে টানছে। হাত ছাড়াতে পারছে না। হাতটি তার স্বামীর হাতই মনে হচ্ছে। ভয় পাচ্ছে আবার ভালোও লাগছে। ফিসফিস করে কী যেন কথা বলছে।

:কেমন আছো লালবানু? প্রশ্ন শুনে লালবানুর মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। ভয় পায়। সত্য ও বাস্তবতার এক মর্মজালে নিজেকে স্তম্বিত ও নির্বাক লাগে।

টিবি রোগীর কন্ঠ আরও শোনা যায়।

‘‘তোমাকে আমি ভালোবাসি লালবানু। ভালোবাসতামও। ভালোবেসেই দুটি সন্তান নিয়েছিলাম। বিধাতা আমাকে কেন টিবি রোগ দিল আর কেন অক্ষম বানিয়ে দিলো জানি না। যখন আমার শরীর ভালো ছিলো, তখন তোমার প্রেম ও আদিখ্যেতা দেখে আমি খুব আপ্লুত হতাম। ভাবতাম, আমাকে কত ভালোাবাসো তুমি। কিন্তু যখনই শরীর অসুস্থ হয়ে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলাম তখনই তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে। ভাই বোন সবাই না হয় মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু তোমার আচরণ ও অবহেলা আমি কিছুতেই নিতে পারছিলাম না। বিশেষ করে পাশের বাড়ির ছেলেদের সাথে তোমার আচরণ, কথা ও সম্পর্ক আমাকে বিদীর্ণ করতো। আমি মরতে চাইতাম প্রতিদিন। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করতো না একদিনও। বিধাতার কী লীলা! যে আমাকে তোমরা দেখতে পারতে না। সেই আমাকে নিয়েই এখন মামলা। আমাকে পুঁজি করে তোমরা সবাই বড়লোক হতে চাচেছা। আমি মরে যাওয়ার পরেও তোমাদের আর্থিক বা বৈষয়িক ইস্যু হয়ে থাকলাম। তোমাদের অন্তরে ঠাঁই হলো না, ঠাঁই হলো না ভালোবাসায়। আচ্ছা লালবানু, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে?‘‘

এসব শুনতে শুনতে লালবানু হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। টানতে টানতে হয়রান হয়ে হঠাত করে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে পাশের বাড়ির লোকেরা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি করে। রক্তশূন্যতা ও অনুশোচনাজনিত মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়। ডাক্তারের চিকিতসা পেয়ে ভালো হয়ে যায়।

 

সময় মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয় আর পরিস্থিতি মানুষ দিয়ে সব করিয়ে নেয়।

 

তারপর দিন যায়,বছর যায়, মামলা বাইতে বাইতে দুইপক্ষ হয়রান হয়ে আসে। থানা পুলিশ, উকিল, আদালত,স্থানীয় মাতবর, সালিশ, টাউটদের সবার পকেট ভার হয়, দুই হোমড়াচুমড়া কোটিপতির কোটিখানেক খরচ হয়। এভাবে সবার খায়েশ আয়েশ সব মেটে। দৌড় শেষ হয়। কয়েকবছর পরেই গ্রামে শান্তি ফিরে এসেছিল। দুই গোষ্ঠীর সমাজ মিলেমিশে বাজার করে, জেয়াফত খায়, সামজিক আয়োজন করে, মাহফিলে শরীক হয়। সব স্বাভাবিক। কিন্তু ওই সময়ে টিবি রোগীকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে ও সমাজের চোখে যে মিথ্যা-প্রলোভন আর নিষ্ঠুরতার ছাপ রেখে গেছে, তা আজও রয়ে গেছে। আর রয়ে গেছে বলেই শরীফ মাস্টারের ওই সময়ের কিশোর কচি মন আজ পরিপক্ক হবার পরেও তা ভুলতে পারেনি।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart