Detail

Home - সমসাময়িক - প্রবন্ধ: ’দেশপ্রেম ও ক্ষমতা: সেকাল একালে তফাত কী?’ – সফিকুল ইসলাম

প্রবন্ধ: ’দেশপ্রেম ও ক্ষমতা: সেকাল একালে তফাত কী?’ – সফিকুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের প্রেরণা, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্ব। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অনেকগুলো প্রেক্ষাপট ছিল। যার কারণে আবাল বৃদ্ধ বণিতা কিশোর, যুবক, শ্রমিক কৃষক সকলে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো মুক্তিযোদ্ধা কারা ও রাজাকার কারা? একাডেমিক ও বাস্তব ইতিহাসের নিরীখে অনেকভাবে সংজ্ঞায়ন করা যাবে। তবে   আমরা যদি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে খেয়াল করি দেখবো যে, যেসব মানুষ দেশের মানুষের অধিকারের জন্য নিজের নিরাপত্তা না ভেবে, সকল স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে নিজের পদ পদবি, নিরাপত্তা, আর্থিক বা ক্ষমতার লোভের কারণে যারা পাকিস্তানিদের সাথে হাত মিলিয়েছিল, নিজের দেশ ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তারাই রাজাকার।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এখন যদি আমরা আমাদের নিজেদের দিকে তাকাই বা আশেপাশে অন্যদের দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখবো যে এখনো এই দুই ধরণের লোক রয়েছে। একদল যারা নিজের সুবিধাকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে সময়, শ্রম, অর্থ উতসর্গ করে। এরা যদি ৭১ সালেও জীবিত থাকতো তাহলে মুক্তিযোদ্ধাই হতো। অন্যদল রয়েছে যারা নিজের পদ পদবি, নিরাপত্তা, আর্থিক বা ক্ষমতার লোভে দেশ ও মানুষের অকল্যাণ করে বা ক্ষতি সাধন করে। এ লোকগুলো যদি ৭১ সালে জীবিত থাকতো তাহলে এরাও রাজাকারই হতো। দ্বিতীয় গ্রুপের সংখ্যাধিক্যই বেশি। নৈতিকতা, প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মানুষ এবং সৃষ্টির প্রতি সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে।

এসব বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। অত্যাচারী শাসক, স্বার্থপর বণিক শ্রেণী ও শোষক পেশাজীবিদের রূপ ইতিহাসের কালভেদে পার্থক্য থাকলেও ভূক্তভোগীদের কাছে দানবরূপ একটাই। মনে করি একজন লোক ১৯০০ সালে জন্ম নিয়ে ২০২০ সালে মারা যাবে। এর মধ্যে প্রতি দশকে দশকে সে বিভিন্ন নির্যাতন, অত্যাচার, অনাচার আর বৈষম্যের শিকার হলো। কখনো ব্রিটিশদের দ্বারা, কখনো স্বজাতি দ্বারা, কখনো পাকিদের দ্বারা, কখনো স্বধর্মের লোকদের দ্বারা, কখনো বিধর্মী দ্বারা, কখনো দূরের লোক দ্বারা, কখনো প্রতিবেশী দ্বারা, কখনো দেশী লোকদের দ্বারা, কখনো ডানপন্থী দ্বারা, কখনো বামপন্থী দ্বারা, কখনো মধ্যপন্থী দ্বারা। ভিকটিমের কাছে সব দশকের ক্ষমতাধর ওই সব লোক নমরুদ, ফেরাউন, আজরাইলের মতো ভয়ঙ্কর, লর্ড ক্লাইভ বা আমেরিকার সেনা প্রধানের মতো ধ্বংসাত্মক আইয়ুব খান বা জেনারেল নিয়াজি বা রাজাকারদের মতো হিংস্র, খন্ধকার মোস্তাকের মতো বিশ্বাসঘাতক ও শঠ, স্বৈরাচারদের মতো নিষ্ঠুর । আসলে ভিকটিমের কাছে সব অত্যাচারীর রূপ এক। অত্যাচারীর চেহারা মাত্রই ভিকটিমের কাছে যম। অত্যাচারী যেই হোক, আগের কিংবা পরের, সাদা কিংবা কালো, ডান কিংবা বাম, ধার্মিক কিংবা অধার্মিক। ভিকটিমের কাছে অত্যাচারীর চেহারা একটাই। স্থান, কাল, পরিপ্রেক্ষিতের কারণে পাত্রপাত্রী আলাদা হয় মাত্র।

এসব শোষণ ও অত্যাচারের জন্য স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বেছে নেয় গণমানুষের সেন্টিমেন্ট। কখনো ধর্ম, কখনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক ইস্যু, কখনো রাজনৈতিক  আইডিওলোজির বিভাজনের কৌশলগত বাজারজাতকরণ করে মানুষকে খেপিয়ে তুলে। এত কিছুর পরে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। উদাহরণস্বরূপ যদি বাংলার কথাই ধরি। মোঘল আমলে হিন্দু মুসলিম এ দুভাগে বিভাজনের রাজনীতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু মুসলিম বিভাজনের পাশাপাশি ইংরেজ বনাম স্বদেশী বিভাজন ছিল। হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে পুঁজি করে জিন্নাহ বা কংগ্রেস গং ভারত পাকিস্তান করলো। পাকিস্তানের সময়েও পূর্ব ও পশ্চিম এ বিভাজন ছিল। বৈষম্য ছিল। এ থেকে মুক্তি পেতেই বাংলাদেশর উদ্ভব। বাংলাদেশ হবার পরও মানুষ দুভাগে বিভক্ত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বিপক্ষে। পাশাপাশি অতি ধার্মিক আর উদার ধার্মিক ইত্যাকার বিভাজনতো আছেই।এখন সর্বশেষ দেশ দুভাগে বিভিক্ত ক্ষমতার লড়াইয়ে। স্বৈরাচারের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভাজন ৯০ দশকেও ছিল, এখনও বিরাজমান। মানুষের বিভাজন করা, এবং একে পুঁজি করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার যে খেলা – সে খেলা শেষ হবার নয়। চলছে চলবে। আর মানুষও উই পোকার মতো আগুনে ঝাঁপ দেবে।কিন্তু ‘তারপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো‘ গল্পের মতো এমন করে আর বলা যায়না। আহা বাংলা আহা মানুষ।

এসবের মাঝেও গণমানুষের নেতা কালে কালে আসে। মানুষের সত্যিকারের মুক্তির জন্য মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু মানুষ কাজ করে। বঞ্চিত ও নিপিড়িত মানুষের কথা ভাবে। উদাহরণস্বরূপ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের কথা আমরা জানি, দেশ বিভাগের সময়কার নায়কদের আমরা জানি, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব ও বীরদের খবরও আমরা জানি।  ১৯৯০ থেকে ২০২৪ এর বিরত্বগাথাও আমাদের এখন মুখস্থ। “পৃথিবীর মজলুম মানুষ সব এক, তারা যেখানেই বাস করুক।“  “ভোটের আগে ভাত চাই।“ “আমি খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলি“। ‘‘পৃথিবীর মানুষ দুইভাগে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে‘‘। ‘‘ আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়……. এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম‘‘। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক‘‘। এসব স্লোগান মানুষ গ্রহণ করেছে। এবং গণমানুষ যাকে সরানোর সরিয়েছে, যাকে গ্রহণের গ্রহণ করেছে। এরকম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মহাত্মা গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, চে গুয়েভেরাসহ পৃথিবীর বেশকিছু আত্মত্যাগী নির্লোভ নেতা পাওয়া যাবে, যারা সত্যিকার অর্থেই গণমানুষের স্বার্থে নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করে গেছেন। সফলও হয়েছেন। আলো জ্বেলে গিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীর নিয়মই পরিবর্তন। মানুষও দিনে দিনে পরিবর্তন হয়। যে বিশ্বাস, আশা, দেশপ্রেম ও মানবিকতার উপর ভিত্তি করে এসব সংগ্রাম সফল হয়, পরবর্তীতে এসব আর থাকে না। পরের প্রজন্ম এসে হয় ভোগে মত্ত্ব হয় কিংবা ক্ষমতার লড়াইয়ের খেলায় মেতে উঠে। গড়ে তুলে নানান রকম জোট ও ক্ষমতার ভাগাভাগির খেলা।   এসব খেলাতে কেউ নিরাপদ নয়। কে যে কখন ওঠে ও নামে তা বলা মুশকিল। নিরাপত্তাহীনতা ঝেঁকে বসে শাসকদের মনে। যীশু খ্রীষ্টের সময়ের গল্প স্মর্তব্য। রোমান রাজা এক গভর্ণরের এলাকায় বেড়াতে গেছেন। গভর্ণরের স্ত্রী রাজকীয় ডিনার দিলেন রাতে। পরে পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে রাজাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে বলেছেন। ‘You are quite safe here. No worries.‘ রাজা বললেন: Emperors are safe nowhere, never. এত পুরাণ কথা, তবু কত নবরূপে সত্য এটি। তবু মানুষ রাজা হতে চায়!

আর তাছাড়া ক্ষমতার জোট বা স্বার্থের কোয়ালিশনতো কখনোই স্থায়ী নয়। রোমান সভ্যতায় জুলিয়াস সিজার জোট করে পম্পে আর ক্রাসাসের সাথে। জুলিয়াস সিজার সিনেটের প্রধান, পম্পে সেনাবাহিনীর প্রধান আর ক্রাসাস ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রক।  ক্ষমতার বলয়ে থাকার জন্য সিজার নিজের মেয়েকে বিয়ে দেয় পম্পের কাছে। সিনেটরদেরকে পুতুল বানিয়ে সিজার নিজে পম্পের সেনাদের জমিদারি পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করে, ক্রাসাসকে সব ব্যবসায়ীক সুবিধা পাইয়ে দেয়। এসব করতে গিয়ে যত অন্যায় লাগে তাও করেছে জুলিয়াস সিজার। কিন্তু বিধি বাম।

যারা দেয় তাদের সব দেওয়া হয়ে গেলেও, যারা পায় তাদের পাওয়া শেষ হয়না। তাই বছর না যেতেই ক্রাসাস ও পম্পে মিলে সিজারকে সরাতে উঠে পরে লাগে। দুজনে মিলে সরিয়ে দেয় সিজারকে। প্রায় জোর করে তার অমতে কোন একটি ছোট জেলার গভর্ণর বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়। স্বার্থেরে জোট ভেঙ্গে যায়। সিজার খুব কষ্ট পায়। এ ধরণের ক্ষমতার জন্য্ ইঁদুর বিড়াল খেলা অলিগোপলি জোট চলমান রয়েছে।

 

ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকতে, সিংহাসনের স্বাদ নিতে মানুষ রাজনৈতিক   আইডিওলোজি থেকেও সরে আসে, বিকিয়ে দেয় সকল নৈতিকতার মানদন্ডও।  ডিগবাজি খাওয়া রাজনীতিবিদদের নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। ডান থেকে বামে বা বাম থেকে ডানে যারা যান, তারা কি আসলে শরীর নিয়ে যান, নাকি মনও নিয়ে যান। হুমায়ুন আজাদ তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ‘ বইয়ে দেখিয়েছিলেন যে আইডিওলোজিক্যালি পরিবর্তন হলে মানুষ কতটা নষ্ট হতে পারে।  তবে আমি সেটার সাথে সহমত হলেও বাস্তবে তা কমই ঘটে। বরং নিচের গল্পের মতো আমার মনে হয় দল পরিবর্তন করলেও নেতাদের মন, ভাবনা, চেতনা আগেরটাই থাকে। সাময়িক এ পরিবর্তন কেবল নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য। রাজনৈতিক অর্থনীতি। সবকিছুই রাজনীতি, রাজনীতিই সবকিছু। সবকিছুতেই রাজনৈতিক অর্থনীতি। তাহলে চলেন গল্পটা পড়ি। ‘‘সোনারগাঁওয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মারা গেলে সিংহাসনে বসার মতো সবল উত্তরাধিকারী ছিল না। সে সময় সুলতানের হিন্দু মন্ত্রী রাজা গণেশ হিন্দু রাজত্ব ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্যে সিংহাসন দখল করেন তিনি। প্রবল মুসলিমবিদ্বেষী গণেশ মুদ্রা জারি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নানা ব্যবস্থাপনায় মুসলিম সংস্কৃতির উচ্ছেদ করতে থাকেন। এমন অবস্থায় পাণ্ডুয়ার সুফি নূর কুতুব আলম বিহারের কাছে জৌনপুরের একমাত্র মুসলিম সুলতান ইব্রাহীম শর্কীকে বাংলার মুসলিম রাজ্য রক্ষার অনুরোধ জানান। আবেদনে সাড়া দিয়ে ইব্রাহীম শর্কী সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে পড়েন রাজা গণেশ। সামরিক শক্তিতে তিনি দুর্বল ছিলেন। তিনি তার বারো বছরের ছেলে যদুকে নিয়ে সুফি কুতুবের দরবারে যান। বলেন, একজন মুসলমানের হাতে রাজক্ষমতা দিলে তো আপনার আর আপত্তি থাকবে না। আপনি তাহলে যদুকে মুসলমান বানিয়ে তার হাতে রাজদণ্ড তুলে দেন। এই যদুই হলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত সুলতান জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহ। আসলে ক্ষমতার লোভে অথবা বিপদে পড়লে জাত-কুল মান অনেকেই বিসর্জন দিতে পারেন। মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে গণেশের হিন্দু জাতীয়তাবাদ উত্থানের আদর্শিক চিন্তা একটি ভান ছিল মাত্র।

ক্ষমতার লড়াই সিংহাসনের আসক্তি, অর্থ ও বিত্তলোভ কিছু মানুষের থাকবেই। তারা বিশ্ব বা দেশকে নিয়ন্ত্রণও করে। তবু পৃথিবী বা সভ্যতা  এগিয়ে যায়। কারণ গণমানুষের ভেতর অনেক কল্যাণকামী মানুষ নিভৃতে কাজ করে। সৃষ্টির কল্যাণে এবং দেশ ও মানুষের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। যত শটতা ও নিচুতাই থাকুক, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আলোকিত মানবের আগমন ঘটে। মোক্ষম সময়ে বারুদ জ্বলে, চারপাশ আলোকচ্ছটায় ভরে যায়। কারণ প্রকৃতি একঘেঁয়েমি পছন্দ করে না, প্রকৃতি শূন্যতাও পছন্দ করে না। প্রেম ও ভালোবাসাই প্রকৃতির পছন্দ।

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart