Detail

Home - দর্শন ও বুদ্ধিজীবিতা - প্রবন্ধ: ’সমাজ পরর্বিতন: আর্শীবাদ নাকি অভশিাপ?’ – সফিকুল ইসলাম

প্রবন্ধ: ’সমাজ পরর্বিতন: আর্শীবাদ নাকি অভশিাপ?’ – সফিকুল ইসলাম

সমাজ ও সমাজের নানান অনুষঙ্গ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের কিছু অনুষঙ্গকে কেউ কেউ ইতিবাচক বলেন আর কিছু অনুষঙ্গকে নেতিবাচক বলেন। প্রথমেই কিছু উদাহরণ দেখি তারপর বিশ্লেষণ করি। এক. ঈদের দিনে ছোটরা বড়দেরকে পা ছুঁয়ে সালাম করে ও সালামী পায় এটাই ছিল রেওয়াজ, এখন সালামী আছে কিন্তু সালাম করার কোনো আগ্রহ নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেই। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিংবা দেশীয় নতুন কতিপয় মুফতির ফতোয়ার কারণে এখন নতুন প্রজন্ম পা ছুঁয়ে সালাম করা বন্ধ করে দিয়েছে। বরং সালামী এখন বিকাশেও নেওয়া হয়! দুই. খোলা পিকাপ ভ্যান গাড়িতে সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়ে পিকাপ ভর্তি ছেলেরা নাচানাচি করতেছে উদ্ভট সব গানের তালে তালে- এটাও আগে কখনো ছিল না। জীবন ঝুঁকিতে পড়া ও সড়ক আইনের নানান ধারার অমান্য করা এবং শব্দদূষণতো আছেই, সংস্কৃতির দুষণ হচ্ছে কিনা তাও ভেবে দেখার সময় হয়েছে। তিন. বর্ষার অবসরে কৃষকেরা আশেপাশের বাড়িতে বসে আড্ডা দিত, খেলাধুলায় মনোযোগ দিত কিংবা আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যেতো। এখন সেসব নেই। সবাই ঘরে শুয়ে বসে মোবাইল ও টিভি দেখে সময় কাটায়। শিশু কিশোরদেরকে বাড়ির আঙ্গিনায় বা জমিতে খেলতে দেখা যেতো, গাছে গাছে পাখির বাসা, কিংবা জমির সবজি চুরি বা ফল চুরির মতো দুরন্তপনায় কাটতো। এখন বাচ্চারা সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। আরও অভাবনীয় বিষয় হলো। যদি একটি গ্রামের সব মোবাইল চেক করে ইউটিউব ও টিকটক এপসগুলো চেক করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে তাদের ওয়াচলিস্ট কত জগন্য রকমের ও নিম্নরুচির। ভাড়ামি ও ছেবলামি টাইপের স্বস্তা বিনোদনের যত্তসব ফালতু ভিডিও দেখে তারা পুলকিত হয় এবং সময় কাটায়। সঙ্গতকারণেই তাদের সময় অপচয় হওয়া ছাড়াও তাদেও চিন্তা চেতনায় দারিদ্র্যতার ছাপ পড়ে। বিকলাঙ্ক এক ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। চার. আগের ছনের ঘর বা টিনের ঘর ছিল। ঘরগুলোও স্বকীয়তা বজায় রেখে গ্রামীন নানান আবহ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল । কিন্তু এখন সবাই ভবন নির্মান করছে। সেসব ভবনের ডিজাইন, ও রঙ দেখলে বোঝা যায় যে নাগরিকদে রুচির উৎস কী। নান্দনিকতা নয়, প্রয়োজন ও সুকুমারবৃত্তি নয়, কেবল টাকার জোরে সবাই ভবন করছে। টাকা যেভাবে কামিয়েছে সেভাবেতো আর রুচি অর্জন করা যায় না। নতুন বাড়িগুলো দেখলে মনে হয় যেন ঘরবাড়ি নয়, যেন হোটেল রেস্তুরাঁর রঙ, মাজার-মসজিদ-মন্দিরের ডিজাইনে তৈরি। নিশ্চয়ই বাড়িঘর, হোটেল-রেস্তুরাঁ, মসজিদ-মাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- প্রতিটির ডিজাইন, রঙ, স্টাইল এবং ফ্যাশন তথা স্থাপত্যরূপ আলাদা রকমের হওয়া বাঞ্চনীয়। ঘরের বাহির দেখে যদি মাজার মনে হয় আর ভেতর দেখে যদি মোড়ের রঙচঙা রেস্তুরাঁ মনে হয়- তবে তা আর বাড়ি হয়ে ওঠে না। পাঁচ. ভোরে ঘুম থেকে উঠা গ্রামের লোকদের একটা অভ্যাস ছিল, যা এখন কমে গেছে। কারণ গ্রামের মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের লোক এখন বসে বসে খায়, তাদের পরিবারে দুচারজন দেশের অন্য শহরে বা বিদেশে চাকুরি করে টাকা পাঠায় আর তারা বসে বসে খায়। কৃষি কাজ করে না। সঙ্গতকারণেই ৮টার পরে ঘুম থেকে উঠে। ছয়, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত দেওয়া হয়েছিল যেন গ্রামে গ্রামে কৃষি ভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠে। তা হয় নি। কৃষি সেচ আর গ্রামের ধান ভাঙানোর মেশিন ছাড়া গ্রাম এলাকায় উৎপাদন বা শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। কেবল এসি বা ফ্যানের নিচে শুয়ে বসে মোবাইল চার্জ দেওয়া ও টিভি দেখা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। সাত. মা, দাদু, নানুরা বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ঘুমাতে যেতো। ঘুমানোর আগে নানান ধরণের কিচ্ছা, গল্প, রূপকথা বলতো। সেসব শুনতে শুনতে বাচ্চারা ঘুমাতো। এখন বাচ্চাদের মায়েরা দ্রুত বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে নিজেরাই মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কখনো বাচ্চারাও এসবের সঙ্গী হয়, কখনো হয় না। য্-াই ঘটুক কিচ্ছা ও রূপকথা শুনে শুনে কল্পনাশক্তি বাড়ার উপায় আর থাকলো না।
এরকম আরও হাজারও উদাহরণ দেওয়া যাবে সমাজ পরিবর্তনের। সমাজ পরিবর্তনের নানান কারণ থাকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নতি, নগরায়নের বিস্তৃতি, বিশ্বায়ন ও আইসিটির ব্যবহার, ধর্মীয় আচারের প্রভাব, মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ইত্যাদি। জীবনধারণের বিভিন্ন অনুষঙ্গের সহজলভ্যতার জন্যও সমাজ পরিবর্তন হয়। যেমন বিদ্যুত, আবাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসুবিধা ইত্যাদিও কারণে নানাবিধ পরিবর্তন দৃশ্যমান। জিডিপি বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যু হার কমা, গড় আয়ু বৃদ্ধি ইত্যাদি পরিবর্তন ইতিবাচক। কিন্তু শিক্ষক নিগ্রহ, নারী নির্যাতন, মাদকের ব্যাপকতা, পারস্পরিক অশ্রদ্ধাবোধ তৈরি হওয়া, নৈতিক অবক্ষয়, বাক স্বাধীনতা কমে যাওয়া, সিনিয়র সিটিজেনদেরকে মূল্যায়ন না করা ইত্যাদি নেতিবাচক পরিবর্তন ইদানিং দৃশ্যমান হচ্ছে।
পরিবর্তনই সমাজের নিয়তি। সমাজ সবসময় পবির্তনের প্রক্রিয়ায় ঘুর্ণায়মান। তবে সেই পরিবর্তন কতটা আলোর দিকে আর কতটা ভালোর দিকে- সেটা ভেবে দেখা জরুরি। সামাজিক কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিষয়াদি খেয়াল করে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না করলে নতুন প্রজন্ম ক্ষতির মুখে পড়ে যার প্রভাব সমাজ ও দেশে পড়ে। হ্যাঁ এটা সত্য যে নতুন প্রজন্ম আমাদেও পুরাতন বিষয়াদি অনুসরণ করবে না। তবে নতুন নতুন যা তারা গ্রহণ করবে সেটাও যেন সুরুচির হয়, টেকসই উন্নয়নের হয় সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। যদিও রুচি বা সুরুচি নিয়ে বাদানুবাদ আছে, আছে বিতর্ক। কুতর্ক করে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হওয়া কোনো কাজের কথা হতে পারে না। সমাজ পরিবর্তন হয় নানান কারণে। প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় কারণে। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারও এখন একটা কারণ। সুতরাং এসব অনুষঙ্গতে বিদ্যমান প্রভাব কী কী ও এসব উপাদান দ্বারা আপকামিং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রভাব কী কী হতে পারে- তা চিহ্নিত করে গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যত করণীয় ঠিক করতে হবে।
সমাজ পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটলে তা প্রতিরোধ করা জরুরি। ন্যায় অন্যায় বা ভালো মন্দের মানদন্ড সমাজ দ্বারা নির্ধারিত হয় যেটাকে আমরা সামাজিক মূল্যবোধ বলি। মূলবোধ হলো সমাজের মানুষের আচার আচরণের মাপকাঠি। সেখানে ধ্বস নামলে পরিবার ও সামাজিক কাঠামোগুলো দৃশ্যমানভাবে পরিবর্তন হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। সমাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুরো সমাজের রূপান্তর বা অবস্থান্তর। আর এ স্থানান্তর অবস্থায় সমাজে অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হয় নানাভাবে। বিশেষ করে সমাজে বসবাসকারী মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের গঠন ও বিস্তার নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। ইতিবাচক পরিবর্তন হোক। কিন্তু নেতিবাচক বিষয়গুলো বিষদভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিকারের উপায় বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিটি সমাজেই যখন অন্ধকার এসেছে তখন একদল লোক আলোর দিশা দিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির কালো দিকগুলো দূর করে কেবল উজ্জল দিকগুলো সমাজে স্থায়ী হোক- সেই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের জন্য সৃষ্টি হোক নব নব রেঁনেসা- সেই প্রত্যাশা রইলো।
এসব নেতিবাচক মূল্যবোধ বা রুচির দূর্ভিক্ষে সংস্কৃতির অধপতনের বিষয়গুলো নিয়ে কোন কোন অতিমাত্রার স্বাধীন লেখক ও বুদ্ধিজীবীগণ সাফাই গান। বলেন যে, যার যা মনে চায় তা-ই করবে, সেটাই তাদেও রুচি। কোনটা সুরুচি আর কোনটা কুরুচি- তা আপেক্ষিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, মানুষের স্বাধীনতা ব্যক্তি পর্যায়ে থাকতে পারে। যা খুশি তা করুক। কিন্তু যে কাজ বা আচরণ সমাজের অন্য মানুষের উপর প্রভাব পড়ে, তা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিন্তা ভাবনা করে সুবিবেচনাবোধ দিয়ে বুদ্ধিজীবীদেরকে ভাবতে হবে। র্দীঘমেয়াদী প্রভাবগুলো মাথায় রেখে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সমাজের সাংস্কৃতিক অভ্যাসগুলোর সৃষ্টি, পুনরাবৃত্তি ও বহাল রাখতে হবে। জাতি গঠন বা সমাজ গঠনে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক মিল ও মেলবন্ধন থাকা জরুরি। বিচ্ছিন্নভাবে নাগরিকরা যা খুশি তা করতে থাকলে দেশের সামাজিক প্রথা বা রাষ্ট্রীয় আইন মানা নাগরিকের অভাব দেখা দেবে। দেশের আনাচে কানাচে নানান অরাজকতা দেখা দিবে। ভেঙ্গে পড়বে পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো যার প্রভাব রাষ্ট্রেও পড়বে।
জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের নানান দেশ ঘুরেছি। বিশ্বায়ন বা আইসিটি সেসব দেশেও প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লাইব্রেরি বা বই পড়ার সংস্কৃতি তাদেও আগেও ছিল এবং এখনও আছে। বিশ্বায়ন বা আইসিটির প্রভাবে হয়তো ইবুক বা অডিও ভিডিও কন্টেন্ট বেড়েছে কিংবা ইলাইব্রেরি যোগ হয়েছে। কিন্তু বই পড়া সংস্কৃতি বন্ধ হয় নি। যেখানে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে লাইব্রেরি সংখ্যা কমছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিগুলোও অযত্নে অবহেলায় থাকে, যথাযথ ব্যবহার হয় না। শিশু কিশোররা মোবাইলে স্বস্তা টিকটকে ব্যস্ত। কোনোভাবেই বই পড়ার সংস্কৃতিতে আগ্রহী হচ্ছে না। উন্নত দেশের ভালো দিকগুলো সেভাবে বাংলাদেশে গৃহীত হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। একইভাবে নেতিবাচক দিকগুলো দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে কিনা তাও দেখা দরকার। যেমন সমকামিতার ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়া, সুগার ডেডি সুগার বেবি চরিত্র ছড়িয়ে পড়া, পরকিয়া বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হওয়া, মাদকের নানান অনুষঙ্গ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বা শব্দ বা আচরণ সমাজে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়াদির লাগাম ধরা জরুরি।
সমাজ পরিবর্তন যেন ইতিবাচক হয়, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা যেন গড়ে উঠে সেজন্য শিশু কিশোরদেও জন্য সেরকম শিক্ষা কার্যক্রম ও পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাসঠাস। সুতরাং শিশুবয়স থেকেই বাচ্চাদেরকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। এবং এটা করতে হলে আমাদের বড়দেও চলাফেরার কালচার (যেমন সত্য বলা ও সততার সহিত উপার্জন এবং ভালো কাজের উদাহরণ সৃষ্টিকরণ) তৈরি করতে হবে। আবার রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সে ধরণের কালচার (যেমন সুশাসন ও ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, আইনের শাসন বাস্তবায়ন, আইসিটির সঠিক ব্যবহার ) প্রদর্শন করতে হবে। যাতে করে আজকের শিশুরা কালকের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
.
(দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ২০২৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত)
Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Rating*

error: Content is protected !!

My Shopping Cart