Detail

Home - সমসাময়িক - বিভাজিত বাঙ্গালী বৈশাখেও বিভক্ত।

বিভাজিত বাঙ্গালী বৈশাখেও বিভক্ত।

সংস্কৃতি তাই যা শত বছর আগেও ছিল এখনো চলছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যও সেভাবেই গড়ে উঠেছে। আজকের অনলাইনের যুগে নতুন যা শুরু হবে তারও কিছু অনুষঙ্গ স্থায়ীত্ব লাভ করে আগামী শত বা হাজার বছর পরে ঐতিহ্য হবে। কোন ঐতিহ্যই পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে ছিলোনা। সময় জীবনযাত্রার হাজার অনুষঙ্গ তৈরি করে বা তা থেকে কিছু অনুষঙ্গ স্থায়ীত্ব লাভ করে সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। অতীতের নতুন আজকের পুরাতন, আজকের নতুনই আগামীর পুরাতন। এভাবেই সভ্যতা চলে।

মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের জন্ম দিয়েছিলেন, ৯৬৩ হিজরি সন হিসাব করে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে, তার সিংহাসনে আরোহণের দিনকে নির্দিষ্ট করে। তবে এ গণনা পদ্ধতি কার্যকর হয় আরও কিছুটা পেছন থেকে। এটি করা হয় কর আদায়ের সুবিধার্থে। ভারতীয় শকাব্দ ও আরবি হিজরি মাসকে মিলিয়ে তিনি তারিখ-ই-এলাহী নামে এ ক্যালেন্ডার চালু করেন। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি আর একটি বিশেষ কাজ করেন। হিজরি চন্দ্রবর্ষপঞ্জিকে ভারতীয় সৌরবর্ষপঞ্জিকার সাথে মেলান সিরাজি। ৯৬৩ হিজরিতে কাগজ-কলমে বাংলা সনকে কার্যকর দেখালেও আরবি হিজরি সনের ৯৬৩ বছরও নতুন জন্ম হওয়া এ বাংলা সনের সঙ্গে যোগ করে দেন। ফলে বাংলা সনটি জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে এর বয়স হয় ৯৬৩ বছর। মোটা দাগে বলা যায়, সম্রাট আকবর মুসলমান ছিলেন। যদিও মুসলমান ছিলেন তবুও তিনি কর আদায়ের সুবিধার্থে ভারতীয় সংস্কৃতি (সৌরপঞ্জি) ও মুসলিম সংস্কৃতির(হিজরি) সাথে মিলিয়ে  একটি সমন্বিত পথ বেছে নিয়েছিলেন। তখনকার সৌরপঞ্জি, কৃষি, কর আদায়, চন্দ্রপঞ্জি ও অন্যান্য কালচারের বিষয় মাথায় রেখেই তিনি বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তথা বাংলা সন প্রবর্তনে তদকালীন বিদ্যমান ধর্মীয় জনগোষ্ঠীল অন্তর্ভূক্তি বা তাদের কৃষ্টি ও কালচার বিবেচনায় ছিল।

কাল ও মানুষ পরিবর্তন হয়। যোগ হয় নতুন কিছু বাদ যায় অনেক কিছু। এরই মাঝে টিকে যায় কিছু কিছু। কৃষকের চৈত্রসংক্রান্তির সাথে বণিকের হালকার পার্থক্য রয়েছে, জমিদারের কর আদায়ের নববর্ষের সাথে বাংগালী সমাজের সাধারণ নববর্ষ ভিন্নতা রয়েছে, মোঘল আমলের বর্ষবরণের সাথে ইংরেজ আমলের বর্ষবরণের পার্থক্য থাকবেই। এখনো যেমন গ্রাম ও শহরের উতসবে রয়েছে দৃশ্যমান বৈসাদৃশ্য। যদিও টেলিভিশনের কল্যাণে অনেক কিছু গ্রামে পৌঁছেছে। শাড়ি পাঞ্জাবীর সাথে জিনস-ফতুয়ার পার্থক্য থাকবেই।  ইতিহাসের এসব নিয়মের কারণেই সংস্কৃতির আবহে হোক আর পুঁজিবাদের খেলায় হোক, কলকাতায় যেখানে বর্ষবরণ হারাতে বসেছে, ঢাকায় সেখানে এটি বড় উতসবে পরিণত হয়েছে।

মঙ্গলযাত্রা হোক আর গ্রামের পান্তা খাওয়া হোক এসব অনুষঙ্গে দেশের মেজরিটি মানুষের বিশ্বাস ও কালচারকে মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে। কারণ এসব অনুষ্ঠান সর্বজনীন। সর্বজনীন মানেই হলো সকলের সমান অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভূক্তিকরণ। যেখানে সকলে সকলের বিশ্বাস ও কালচারের বিষয়গুলো প্রকাশ ও আচার করতে পারেন। মূর্তি হিন্দু ধর্মীয় কৃষ্টি বা কালচার, মুসলমানদের এরকম কোন হাইলাইটিং বিষয় থাকলে তারাও সেখানে তা নিয়ে যেতে পারেন। না নিতে পারলে বা নেওয়ার সুযোগ না থাকলে তা আর সার্বজনীন থাকেনা। পাঞ্জাবী বা লম্বা আলখাল্লা মুসলিমদের একটি পরিধান বা আচার। গত কয়েকশো বছর ধরে হিন্দুরাও এ জামা অনেকে পরিধান করছে।এরকম আরো অনেক কিছু আছে। আবার মুসলিম মেয়েরা শাড়ি পরে, কপালে টিপ দেয়। এটি হিন্দু আচার হলেও মুসলিমরা দেয়। তথা বাঙ্গালী হিসেবে মুসলিম ও হিন্দু উভয়ে উভয়ের কিছু কালচার বা দৈনন্দিন অভ্যাস নিজেরাই অদলবদল করেছে। যা সর্বজনীনতায় রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের সবাই বাঙ্গালী। এদের মধ্যে কেউ মুসলমনা, কেউ হিন্দু বা কেউ অন্য। কেউ মুসলমান বা হিন্দু হলে বাঙ্গালীত্ব বাদ যায়না, যেমন যায়না কেউ কালো কিংবা সাদা হলে।

এ প্রসঙ্গে সর্বজনীন শব্দে অর্থ জেনে নিই। ‘সর্বজনীন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ, সর্বসাধারণের জন্য অনুষ্ঠিত, বারোয়ারি, সর্বসাধারণের সহায়তায়কৃত, সকলের জন্য মঙ্গলকর বা কল্যাণকর, সবার জন্য হিতকর, সবার মঙ্গলের জন্য কৃত, সকলের জন্য উদ্দিষ্ট। যেমন : ভালোবাসা সর্বজনীন বিষয়। ফল সর্বজনীন খাদ্য। মানবাধিকার সর্বজনীন অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এখন বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশে উদযাপন শুরু থেকেই সর্বজনীন।  কিন্তু এর মধ্যে শত বছরের পরিক্রমায় পুরো দিনটি মানুষ কীভাবে পালন করেছে তার সাথে অনেক অনুষঙ্গ প্রবেশ করেছে। ভোরের প্রার্থনা, প্রত:রাশ, পরিধেয় বস্ত্র, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাজার-হাট, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, মধ্যাহ্নভোজনসহ নানান বিষয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সাথে সাথে এসব ছোট ছোট বিষয়ে অনেক অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। প্রতিটি সমাজের মানুষের কৃষ্টি, কালচার ও বিশ্বাস থেকে।   কিছু বৌদ্ধ ধর্ম থেকে, কিছু হিন্দু ধর্ম থেকে। সময়ের প্রেক্ষাপটে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে। যে কারণে আমরা দেখি বাংলার িএকেক অঞ্চলে একেক রকম অনুষঙ্গ যোগ হয় নববর্ষে। সিলেটে কিংবা চট্রগ্রামে খুলনায় কিংবা রাজশাহী কিছু অনুষঙ্গ পাওয়া যাবে যা পুরোই ব্যতিক্রম। আবার বন্দরবানের মার্মা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চইঙ্গা, রাঙ্গামাটির চাকমা কিংবা মৌলভীবাজারের মণিপুরী ও খাসিয়াদের নববর্ষ একই দিন হলেও দেখা যায় বেশকিছু অনুষঙ্গ ভিন্ন।  এর সাথে প্রতিটি বৃহত্তর সমাজের কৃষ্টি, বিশ্বাস, আচারের সম্পর্ক রয়েছে। তাই মঙ্গলযাত্রা সর্বজনীন কিনা, সর্বজনীন হলে সকল মতের সকল পথের সকল অনুষঙ্গ উপস্থাপনের সুযোগ থাকা উচিত কিংবা শুধু বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে। ধর্মীয় অনুষঙ্গের পরস্কার বহিপ্রকাশ করা যেমন মূর্তি প্রেজেন্টেশন থাকলে অন্য ধর্মের তারাও তাদের ধর্মের কোন বিষয় প্রকাশের জন্য আনতে পারে। সর্বজনীন বললে সর্বজনীনতা রক্ষা করাও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

নববর্ষ ‍উদযাপন আজকে যেরকম হয় ৫০ বছর আগে সেরকম ছিলনা। ১০০ বছর আগে অন্যরকম ছিল। ১৮০০ সালে, কিংবা ১৭০০ সালে কিংবা ১৬০০ সালে নববর্ষ উদযাপন ওই সময়ের শাসনকর্তা ও প্রজাসাধারণের মোড়লদের সিদ্ধান্তে তখনকার নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনাচার, বিশ্বাস, আচার, কৃষ্টি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই পালিত হয়েছে। সুতরাং কোন একটি অনুষঙ্গকে বলা যাবেনা যে এটি আমাদের শত বছরের কালচার বা হাজার বছরের ইতিহাস।  প্রতিটি ছোট ছোট অনুষঙ্গের সাথে ছোট ছোট ইতিহাস জড়িত যেখানে তখনকার নাগরিকদের জীবনাচার প্রভাব ফেলেছে। তথা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মেজরিটির প্রভাবই ওসব অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে বাাদ গিয়েছে। তাই প্রতিটি শতকের নববর্ষ উদযাপনে নিশ্চয়ই বেশকিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে। নববর্ষ উদযাপন হবে সকলে মিলে এটি সর্বজনীন। সবসময় সবার জন্য ছিলো, যারা বাংলায়। কিন্তু উদযাপনের সময়ে গঠিত অনুষঙ্গে নিশ্চয় পরিবর্তন হয়েছে। ওসব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে ক্ষমতার কাছে থাকা রাজা, জমিদার, ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় নেতারা। তাই আজকের দিনেও এটি তেমনভাবেই প্রভাবিত হবে। মেজরিটির মুভমেন্টে সব বদলে যায়, আর যায় ব্যবসায়ীদের খেলা গেইমে

আবার নতুন বিতর্ক আছে পহেলা ১৪ এপ্রিল নাকি ১৫ এপ্রিল। ঢাকা ও কলকাতায় এটি পালন হয় যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ এপ্রিল। বঙ্গাব্দ সৌরবর্ষ থেকে এসছে আর খ্রিষ্টাব্দও সৌরবর্ষ থেকে এসছে। সুতরাাং এর সাথে চন্দ্রবর্ষ এর কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছেনা।  অনুষঙ্গ পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু ধর্মের নামে দিন বদলের কোন কারণতো দেখিনা। পঞ্জিকা আর গণকের গণনায় সব গুবলেট করে ফেললে মর্ম হারিয়ে যায়।

মঙ্গলযাত্রায় যাবে কিনা- এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে নিশ্চয়ই মুসলমানদের একটি অংশ ফতুয়া দিয়ে নাজায়েজ বলবে।  আরেক অংশ হয়তো যাবে নিজেদের মতো অংশ নিতে পারলে বা ভূমিকা রাখতে পারলে।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart