Detail

Home - গল্প - গল্প: রূপকথার বাস্তব গল্প

গল্প: রূপকথার বাস্তব গল্প

রূপকথার বাস্তব গল্প

-সফিকুল ইসলাম

বাচ্চাদেরকে প্রতিদিন গল্প বলতে বলতে ঘুম পাড়ায় জালাল। বাচ্চারাও গল্প শুনতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে শরীর কাহিল লাগলে গল্প বলার মুড থাকেনা। তখন জালাল বাচ্চাদেরকে তাদের মায়ের কাছে পাঠায়। কিন্তু বাচ্চাদের সোজা কথা। তারা মায়ের কাছে গল্প শুনবেনা। বাবার কাছেই শুনবে। কী আর করা। বাচ্চাদের বায়নার কাছে জালালের সমর্পন করতে হয়। গল্প শুরু করতে হয়। জালাল গল্প ধরে। অনেক কাল আগে এক দেশে ছিল এক রাজা। মেয়ে বলে “বাবা, তুমি শুধু অনেক কাল আগের গল্প বলো কেন?, বর্তমানের গল্প বলো। আর রূপকথার গল্প আর বলোনা, বাস্তব গল্প বলো।“ এদিকে ছেলে বলে ‘ না বাবা, তুমি অনেক আগের গল্পই বলো, রূপকথার গল্পই বলো। বাস্তব গল্প বলার দরকার নেই।“ শুরু হয়ে যায় ভাই বোনের মাঝে মারামারি। দুজনের খুনসুটি জালাল কিছুক্ষণ উপভোগ করে। পরে রেফারির ভূমিকা নেয়। পকেট থেকে কয়েন বের করে লেজ-মাথা টস বেছে নিতে বলে। টসে হেরে যায় ছেলে। মুখ গুমড়া করে বসে থাকে। মেয়ে খুব খুশি। বর্তমানের গল্প ও বাস্তব গল্প শুনবে বলে।

জালাল বর্তমানের গল্প কোনটা বলবে খুঁজে পায়না। মাথায় কত ঘটনা কিন্তু বাচ্চাদের উপযোগী কোনো গল্প আছে কিনা, বা থাকলে কোনটা আছে, ভেবে পায়না। বাচ্চারা এখন বড় হয়েছে। যা বলবে হয়তো তাই বুঝবে ভেবে একটি গল্প ধরলো জালাল। ঠিক আছে, আজ তোমাদের রূপকথার অবাস্তব গল্প বলবোনা। তবে বাস্তব এক গল্প বলবো যা রূপকথার মতোই।

অনেক কাল আগে নয়, কিছুকাল আগে, এই সেদিনের কথা। যখন আমরা ছোট ছিলাম তখনকার কথা। মেয়ে খুশি হয়। বলে “তোমাদের ছোটবেলার কথা শুনতে আমার ভালো লাগে।“ জালাল থেমে যায়। বলে গল্পের মাঝখানে কথা বললে গল্প থেমে যাবে। কোন কথা চলবেনা। শুধু ‘তারপর‘ বলা যাবে। মেয়ে মাথা নেড়ে সাই দেয়। ছেলে মন খারাপ করে মুখ লুকিয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু কান খাড়া করে আছে যেন গল্প মিস না হয়।

জালাল আবার শুরু করে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনকার কথা। রাত পোহালেই হাজার হাজার পাখি কিচিরমিচির ডাকতো। পাখিদের ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙতো। হাজার পাখির আওয়াজে কোনটা কোন পাখির আওয়াজ তা ঠাহর করা যেতোনা। কিন্তু সবগুলো মিলে একটা চমতকার ছন্দ তৈরি হতো। আমরা ঘুম ঘুম চোখে সেসব পাখির কলরব শুনতাম। ঘুম ভেঙ্গে চোখ মুছতে মুছতে পুকুর ঘাটে যেতাম। স্বচ্ছ পানিতে শান বাঁধানো ঘাটে বসতাম। কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতাম, আর মুখ ধূতাম। ঘাটের পানিতে আমাদের মুখ স্পষ্ট দেখা যেতো। ঘাটে বসে পুকুর পাড়ের গাছগুলো দেখতাম। পাখিদের বিষ্ঠায় গাছের অনেক পাতা সাদা হয়ে থাকতো। সবুজ সাদায় মিলে আনকোরা হাতের ড্রয়িং মনে হতো।

মুখ ধুয়ে আমরা মক্তবে যেতাম পড়তে। ভোরের কুয়াশায় আধা অন্ধকার ঠেলে আমরা মক্তবে যেতাম। আসা যাওয়ার পথে গাব গাছের নিচে বা বটগাছের তলে ভুতের ভয় করতো। ভয় করতো ঠিক কিন্তু কখনো কাউকে ভূতে ধরেছে এমনটা কেউ শোনেনি। তবে অনেকে ভয় পেয়েছে বা অ্যানেমিয়ায় আক্রান্ত মানুষকে জ্বীনে ধরা রোগী বলে আখ্যায়িত করেছে। কবিরাজ বা মৌলভীর কাছে নিয়ে গেছে। মক্তবে পড়তে গেলে হুজুর খুব যত্ন করে পড়াতেন। কোন হুজুর কারো সাথে কোন মন্দ আচরণ করেছেন এমনটা হয়নি। কেউ আরবী অক্ষর শিখতো, কেউ আমপাড়া পড়তো কেউ কুরানশরীফ। এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে গেলে সবাইকে খই খাওয়াতে হতো । কিংবা মিষ্টি জিলাপি। হাত পেতে পেতে খই বা জিলাপী নিতে আমাদের খুব আনন্দ হতো। কোন অন্যায় করলে বা পড়ায় ফাঁকি দিলে হুজুর বেত দিয়ে মারতেন। সেই বেত খেয়ে কাঁদতাম। কিন্তু কোনদিন বাবা-মাকে বলিনি। কারণ, বাবা-মা জানতো যে হুজুর বিনাকারণে মারবেনা। বাড়িতে বললে উল্টো নিজেই পুনর্বার মাইর খাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।

মক্তব থেকে এসে ঘরে যা থাকতো তাই খেয়ে ছুটতাম স্কুলে। স্কুলে ছিল অনেক দূরে। যাওয়ার পথে অনেক মজার ঘটনা ঘটতো। কেউ গাছে উঠে পাখির ছানা ধরতো, কেউ সাঁকো থেকে পড়ে যেতো, কেউবা কারো গাছের বরই ‍চুরি করতো, অন্যকেউ কেউ আমগাছে ঢিল দিতো, কেউ মিষ্টি আলু জমি থেকে তুলে পকেটে ঢুকাতো। আসা যাওয়ার পথে হেন কোনো দুষ্টুমি নেই যে আমরা করিনি।

ছেলে প্রশ্ন করে তোমরা ভয় পেতেনা? আর না বলে নেওয়াতো অন্যায়। ছেলের মন ভালো হয়ে গেছে আর গল্পে মন দিয়েছে দেখে জালাল হেসে ওঠে। কিন্তু জবাব দেয়না। বলে গল্পের মাঝে কোন প্রশ্ন চলবেনা। শুধু বলতে পারবে ‘তারপর‘।

জালাল আবার বলে যায়, স্কুলে গেলে শিক্ষকরা খুব আদর করতো। আমরা কী করি না করি সব জানতো, আমাদের বাবা-মা কী করেন, কার বাড়িতে কী কী সুবিধা অসুবিধা সব শিক্ষকরা জানতো। ক্লাসে মন খারাপ থাকলে খেয়াল করতেন। নিজের বাচ্চার মতো আদর করতেন। ক্লাসে মন দিয়ে পড়াতেন। কোন বিষয় না বুঝলে বুঝিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে পড়ার পরিবেশ দেখে যেতেন। মাবাবার কাছ থেকে খবর নিতেন। স্কুলে না গেলে খবর নিতেন। অসুস্থ হলে দেখতে আসতেন। দুষ্টুমি করলে শিক্ষকরা ইচ্ছামতো মাইর দিতেন। এ নিয়ে বাবা-মায়ের কোন অভিযোগ ছিলনা। বরং বাবা-মায়েরা শিক্ষককে বলতেন যে, “ছেলেকে দিয়ে গেলাম। শরীরের সব মাংস আপনার আর হাড্ডিগুলো আমার। দুষ্টুমি করলে আর পড়া না করলে পিটিয়ে সব মাংস ফেলে হাড্ডিগুলো বাড়িতে দিয়ে আসবেন।“ তাই বলে শিক্ষকরা বিনা কারণে মারতোনা। আদরই করতো বেশি। প্রয়োজনে বেত্রাঘাত করতেন। মানুষ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।

স্কুল থেকে বিকেলে ফিরে মা যাই রাঁন্না করতেন তাই খেতাম। এটা খাবোনা, ওটা খাবোনা বলে বায়না ধরতামনা। এরপরেও মা ঘরে থাকা উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন রেসিপি করতেন। বিকেলে খেলতে যেতাম মাঠে। নানানরকম দেশি খেলা। গোল্লাছুট, হাডুডু, দাড়িয়াবন্ধা, বউচি, ডাঙ্গুলি, বড়া খেলা, ফুটবল ইত্যাদি শত খেলা খেলতাম। খেলতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হতো, হাতাহাতি করতাম। আবার দুএকদিনে মিটেও যেতো। আবার একসাথে খেলা ও পড়ালেখা চলতো। এ নিয়ে বড় কোন বচসা হতোনা। বাচ্চাদের ঝগড়া নিয়ে বড়রাও কোনো মাথা ঘামতোনা।

বন্ধের দিনে সারাদিন খেলতাম। কখনো কখনো বিলে যেতাম মাছ ধরতে। কই, শিং, মাগুর, গুতুম, বাইম, পুটি, বোয়াল, টাকি, কত শত মাছ। শিং মাছের গুতু খেলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে চিল্লাইতাম। খুব ব্যথায় কাতর হতাম। তাতক্ষণিক প্রতিষেধক হিসেবে বিছকাটালি গাছ দিয়ে ক্ষতস্থানে বাড়ি দিতাম। কিংবা শিং এর গুতোর ক্ষতস্থানে সেখানে প্রস্রাব করে দিতাম। গরম লাগলে আরাম লাগতো। তখন ডাক্তার খোঁজার রেওয়াজ ছিলনা। গ্রামীন এসব প্রতিষেধক কাজ করতো। পথ চলতে গিয়ে হাত পা কেটে গেলে দুর্বাঘাস চিবিয়ে লাগাতাম ক্ষতস্থানে। প্রাকৃতিক ওষুধে ভালোই কাজ করতো।

মাঝে মাঝে বাবা বাজারে নিয়ে যেতেন। দইওয়ালা থেকে দই বা সন্দেস খাওয়াতেন, বাদাম বা হইমুল্লা কিনতেন আরেক দোকান থেকে। মিষ্টি কিনে দিতেন অন্য দোকান থেকে। সেসব খেতে খেতে বাড়িতে ফিরতাম। কোনদিন পেটে অসুখ হয়নি ওসব খেয়ে। সবাই সবাইকে চিনতেন। তাই খাবারও ভালো করে বানাতেন।

প্রতিবেশিরা খুব বেশি আসা যাওয়া করতো একে অপরের বাড়িতে। সারাদিন কথাবার্তা চলতো। সম্পর্ক ছিল খুব গভীর আর দেওয়া নেওয়ার। কেউ পিঠা বানালে পাশের বাড়িতে পাঠাতো, কেউবা পোলাও কোর্মা করলে অন্যদের না দিয়ে খেতোনা। এভাবে মিলেমিশে  একাকার হয়ে চলতো। বিশেষ করে বিয়ে শাদির প্রোগ্রামে প্রতিবেশিরা  আত্মীয় স্বজনরা এসে হাজির হতেন। সব কাজ নিজ হাতে করতেন। গেট সাজানো, ঘর সাজানো, কনে সাজানো, বাজার করা, রান্না বান্না সব নিজেরাই করতেন। এসবের মধ্যে দিয়ে সকলের মধ্যে হৃদ্যতার এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য দেখা যেতো।

এরকম সব ভালোই চলছিল। সবাই শান্তিতে আন্তরিকতায় কাটাচ্ছিল। পেটে ক্ষুধা থাকলেও মনে কোনো কষ্ট ছিলনা। কাপড় কম পরলেও কোনো হাপিত্যেশ ছিলনা। মুখে মুখে হাসি দেখা যেতো, সুখ-শান্তির আভা দেখা যেতো ঘরে বাইরে সমাজে ও দেশে।

এরপর একদিন বিশ্বে এলো এক বিশাল কিম্ভূতকিমার দৈত্য। দৈত্যের নাম “পুঁজিশাঙ্গঁ“। তার ছিলো অনেক ছানাপোনা। এদের নামও ছিলো সেরকম উদ্ভট। মালিকক্তি, লোভত্রাস, ভোগদাস, কামম্যাশ, লালসামা, লাভকান্তি, হিংসাত্রয়ী, ঈর্ষামনি, মধুকৈটভ ইত্যাকার সব নাম। এরা হলো নানান রূপের নানান ঢঙের। বিচ্ছিরি সব দেখতে। এসব ছানাপোনারা ছড়িয়ে পড়লো দেশে দেশে, জেলায় জেলায়, ঘরে ঘরে, কোণাকাঞ্চিতে। সেই থেকে সব বদলে যেতে লাগলো। পাখিরা আর গ্রামে গ্রামে ডাকেনা। ডাকবে কি গ্রামে এখন পাখিই নেই। কেউ লোভে পাখি খেয়ে ফেলে। কেউ বেশি ফসলের লোভে জমিতে কীটনাশক দেয়; সেসব খেয়ে পাখি মারা যায়। কেউ গরুকে মোটা করার জন্য ইনজেকশন দেয়; সেসব গরু মারা গেলে তা খেয়ে পাখিরা মারা যায়। এভাবে পাখি সব হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ নগদ লাভের আশায় গাছ সব কেটে ফেলছে। পাখিদের বাস করার স্থান কমে যাচ্ছে। অভয়ারণ্য আর নেই। তাই এখন আর পাখি ডাকেনা। শিশুরা এখন আর পাখির ডাকে ঘুম থেকে ওঠেনা। মা-বাবার ধমক খেয়ে ঘুম থেকে ওঠে।

দৈত্যর ছানাপোনাদের জ্বালায় আর গ্রামে গ্রামে পুকুর বেশি দেখা যায়না। গণহারে ভরাট হয়ে যাচ্ছে অনেক পুকুর। যা আছে তাতে আর স্বচ্ছ পানি দেখা যায়না। সেখানে মাছের চাষ হয়। মাছকে কেমিক্যাল ফিড খাওয়ানো হয়, দ্রুত মাছ বড় হওয়ার জন্য। পুকুরের পানিতে তাই কাইট পড়ে থাকে। মুখে নিয়ে কুলি করার মতো পরিস্কার পানি থাকেনা। কেমিক্যাল ভর্তি পানি থেকে মানুষ এখন দূরে থাকে। পানিতে এখন নিজের ছবি দেখা যায়না। মনে হয় মৃত্যুকূপ বা দৈত্যরা সব পানির নিচে।

দৈত্যরা সব পাল্টে দিচ্ছে। শিশুরা আর এখন খুব একটা মক্তবে যায়না। সবাই বাসায় বসে মোবাইল আর ট্যাব দেখে। বাবা-মায়েরা খুব ব্যস্ত সংসার আর গৃহস্থালী কাজে। ভোরবেলায় বাচ্চাদেরকে একা একা মক্তবে পাঠাতেও ভয় পায়। পথে পথে দৈত্যরা বদলোকদের দাঁড় করিয়ে রাখে। শিশুরা গুম হয়ে যায়, খুন হয়ে যায়, রেপ হয়ে যায় শুনতে শুনতে মানুষ এখন ভীত সন্তস্ত্র। তাই বাচ্চাকে মক্তবে পাঠায়না। এরই মাঝে যারা যায় মক্তবে তারাও কেউ কেউ ভিকটিম হয় মক্তবের হুজুরের হাতে। কালো লোমশ হাত যা করার  নয় তাই করে। তাই বাচ্চারা ভয় পায়। মক্তবে যেতে চায়না। আগের মতো সুন্দর পূত পবিত্র পরিবেশ বজায় নেই।

এ দৈত্যের ছানাপোনাদের দ্বারা আরও অনেক পরিবর্তন দেখা যায় দেশে দেশে। আগের মতো স্কুলে আসা যাওয়ার পথে আম জাম বড়ই কিছুই নেওয়া যায়না। মানুষ বাড়তে বাড়তে গাছ কাটতে কাটতে সব কমে গেছে। মানুষের আগের মতো গ্রহণ ক্ষমতা নেই। এখন কারো বড়ই গাছে ঢিল দিলে এ নিয়ে লঙ্কাকান্ড ঘটে যায়। হয়ে যায় বাড়ি বাড়ি মারামারি। তাই বাচ্চারা ভয়ে তটস্থ থাকে। স্কুলে যায় আর আসে। মোড়ে মোড়ে স্বস্তা কেমিক্যেল দেওয়া চিপস বা লজেন্স কিনে খায়। এসব খেয়ে পেটে পোকা বানায়।

স্কুলের পরিবেশও আগের মতো নেই। এখন আর শিক্ষকরা বাচ্চাদের নাম মনে রাখেনা। নাম কেউ কেউ মনে রাখলেও বাচ্চাদের পরিবারের খবর জানেনা। কেউ আসলোনা কেন তার কারণ খুঁজতে কেউ যায়না। পড়া দেয় পড়া নেয় এই হলো ক্লাসের কারবার। ক্লাসে পড়া এখন কেউ বুঝিয়ে দেয়না। প্রাইভেট ও কোচিং এ গেলে পড়া বুঝিয়ে দেবে- এ কারবারে নেমেছে অনেক শিক্ষকরা। আগের মতো বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষকরা খবর নেয়না। কথায় কথায় বাচ্চাদের নানান অজুহাতে পিটানো শুরু হয়েছিল। তা থামাতে সরকার বেত মারা বন্ধ করেছে বটে, তবে অন্যান্য সুক্ষ্ম নির্যাতন বা অনিয়ম বন্ধ করতে পারেনি। দৈত্যর ছানাপোনারা নানানরূপে দেশের মানুষের মনের ভিতর ঢুকে পড়েছে। সব ধরা যায়না, দেখা যায়না, ছোঁয়া যায়না। সবাই নগদের পেছনে ছুটছে। আদর্শ বা সম্মানের জন্য কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বাচ্চারা স্কুলে যেতে এখন আনন্দ পায়না। এ এক ভয়ার্ত অস্বস্থিকর পরিবেশ বিরাজ করে। জোর করে বাবা-মা পাঠায়, জোর করে স্কুলও চলে। কোথাও কোনো স্বতস্ফূর্ততা নেই। ভালোবাসা বা আন্তরিকতা নেই। দৈত্যৈর ছানাপোনারা সব কুঁড়ে কুড়ে খেয়ে ঝাজরা করে ফেলেছে।

বিকেলে খেলার পরিবেশও আগের মতো নেই। মোবাইল, ভিডিও গ্যামস, অ্যাপস জায়গা করে নিয়েছে আগের দেশি সব খেলার। যাদের টাকা আছে তারা এসব খেলে, যাদের টাকা নেই তারা এসব পায়না বলে মন খারাপ করে বসে থাকে। সাথে  এসেছে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল। আগের মতো বিনাপয়সার খেলা ডাাঙ্গুলি, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা বা গোল্লাছুট নেই। গ্রামের উঠান ছোট হয়ে  আসছে। মানুষ যে হারে বেড়েছে মাঠ সে হারে হয়নি। তাই বাচ্চাদের খেলার স্থান পর্যাপ্ত নেই। শহরেতো খেলার জায়গাই নেই। দৈত্যদের দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষ সব ছুটছে অস্বাস্থকর পরিবেশের দিকে। বাচ্চারা এখন ঘরে বসে থাকে। মোবাইল টিপে, গ্যামস খেলে। খেয়ে খেয়ে মোটা হয়, শারীরিক কসরত না থাকায় ফিটনেস ছাড়াই বড় হচ্ছে এখনকার নতুন প্রজন্ম।

এখন আর বন্ধের দিনে মাছ ধরতে যায়না বাচ্চারা। উন্নয়নের জোয়ারে রাস্তাঘাট হতে হতে বিল বা হাওড়ের পানিপথ সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর বিলে ঝিলে মাছ পাওয়া যায়না। মানুষ বাড়ছে বাড়ছে বাড়িঘর। জমি বিল ঝিল সব ভরাট হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। আগের সেই দেশি মাছ এখন খুব কম। নাই বললেই চলে। যাই কিছু থাকতো জমিতে কিটনাশক ব্যবহারের ফলে মাছের বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যহত হয়েছে। মাছের ডিম থেকে মাছ হওয়ার আগেই কিটনাশকের কারণে বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাচ্চারা এখন বিলে ঝিলে গেলে মাছ পায়না।

এখন বাবার সাথে বাচ্চারা বাজারে গেলে প্লাস্টিকের খেলনা কিনে। আর দোকান থেকে কিনে চিপস, আঁচার আর চকলেট। দৈত্যর ছানাপোনার মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যামিকেল আর অস্বাস্থ্যকর সব খাবার। যা খেয়ে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক বাচ্চা কোষ্ঠকাঠিন্য বা পেটের পীড়ায় ভূগছে। কেউ বা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রতিবেশীদের মধ্যেও আর আগের মতো সম্পর্ক নেই। সবাই এখন ঘরে বসে গোসল করে। পুকুর পারে বসে কথা বলতে বলতে গোসল করা বা বাসন মাঝার চিত্র দেখা যায়না। প্রতিবেশীরা আর আগের মতো হুট করে একে অপরের বাসায় যায়না। সবাই ভাবে ও  যেহেতেু আসেনাই, আমিও যাবোনা, কিংবা ও একবার দাওয়াত দিয়েছে, তাই আমিও একবার দাওয়াত দিব। এরকম ফরমাল রিলেশনের ভিড়ে আগেকার দহরম মহরম সম্পর্ক হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই দরজা বন্ধ করে টিভি দেখে, সিরিয়াল দেখে, ইউটিউব ও ফেসবুক দেখে। আন্তরিকতা ও সহজ সম্পর্কগুলো হারিয়ে গেছে।

বিয়েশাদীতেও এখন আর প্রতিবেশীদের সহযোগিতা লাগেনা। ডেকোরেটর ভাড়া করে। ইভেন্ট মেনেজমেন্ট ভাড়া করে। প্রতিবেশী আত্মীয়রা শুধু নির্ধারিত সময়ে খেতে আসে আর মেকি ছবি তোলায় পোজ দেয়, চলে যায়। গিফট এর পরিবর্তে খাম দিয়ে যায়। বিয়ে বাড়ির কাজকর্মে, আনন্দ উল্লাসে ঘটন অঘটনে, হাজার অনুষঙ্গে কেউ স্বশরীরে জড়িত হয়না।

এভাবে দৈত্যরা একে একে সব পাল্টে দিচ্ছে। ঘরে ঘরে মেকি উন্নয়ন হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে দৈত্যর ছানারা বাসা বেঁধেছে। মানুষের শান্তি উবে যাচ্ছে, বাচ্চাদের উল্লাস হ্রাস পেতে পেতে নেই হয়ে যাচ্ছে। কোথাও আন্তরিকতা নেই, হৃদ্যতা নেই, প্রশান্তি নেই, এটা নেই ওটা নেই। সব নেই এর এক কালো গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে বাস্তব রূপকথার এ দেশটি। গল্প শেষ! বলতে বলতে জালাল ঝাপসা চশমা চোখ থেকে নামায়।

গল্প শেষ হলে মেয়ের মন খারাপ হয়ে যায়। বাবার ঝাপসা চোখ দেখতে দেখতে মেয়েটি ছলছল চোখ নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। ছেলে ‘পঁচা গল্প আর মন খারাপ করা গল্প বলেছো কেন?‘ বলে বাবাকে একটু অনুযোগ করে মেজাজ খারাপ করে বালিশে মুখ গুজে।

১৭-০২-২০২০

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart