Detail

Home - সমাজ ও ধর্ম - ত্রিতত্ত্বে কুরবানি: উৎসর্গ/ত্যাগ তত্ত্ব বনাম পশু-বধ-উৎসব তত্ত্ব বনাম মনের পশু বধ তত্ত্ব।

ত্রিতত্ত্বে কুরবানি: উৎসর্গ/ত্যাগ তত্ত্ব বনাম পশু-বধ-উৎসব তত্ত্ব বনাম মনের পশু বধ তত্ত্ব।

পশুতো নিয়মমাফিক জবাই দিতেই হবে। সাথে নিজের ভেতরের সকল পাশবিকতাকে কুরবানি দেই। রাগ ও উগ্রতাকে পরিহার করি, লোভের জিহ্বাকে সামলাই, লালসার থাবাকে প্রতিহত করি, মিথ্যাকে না করি, হিংসা ও ঈর্ষাকে দূরে ঠেলি, কামকে সংবরণ করি, তথা পঞ্চইন্দ্রীয়ের সকল বদরূপের লাগাম ধরি।কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু ও ত্বকের যথাযথ কাম্য ব্যবহার করি। প্রতিনিয়ত প্রতিক্ষণ ত্যাগের মধ্যেই যাপন করি।নফসকে যত্ন করি। এটাই তো সেরা কুরবানি। নাকি?

আমিতো বলেই নিস্কৃতি নিলাম। কিন্তু ত্যাগ কি এতই সহজ? দরকার ইচ্ছাশক্তি। আমি যেন বলতে পারি আমি ত্যাগ করবো। প্রতিদিনই যদি ইচ্ছাকে এ ত্যাগের অভিমুখে প্রস্তুত না করি তবে মৃত্যু ও ক্ষতি যখন সম্মুখে এস দাড়াবে তখন ফাঁকি দিব কী করে?নিজেকে নিজে ফাঁকি দেয়া যায়? তাই পূর্ণ হবার জন্যেই আমাদের দরকার ত্যাগ।কিন্তু ত্যাগ করবো কেন? সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে ত্যাগ না করলে স্বাধীন হওয়া যায়না। যখনি আমরা কিছু ত্যাগ করতে পারিনা তখনি সেটি আমাদের আবদ্ধ করে রাখে।মায়ার বাঁধনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। সুতরাং ত্যাগের দ্বারা আমরা নিজেকে মুক্ত করবো। ত্যাগের সাথে প্রেমের গভীর সম্পর্ক। প্রেম ছাড়া ত্যাগ হয়না, আবার ত্যাগ ছাড়া প্রেম হয়না। বীজ যখন চারা হয় তখন নিজেকে বিদীর্ণ করে ত্যাগ করেই সে চারা হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে।

আমার উপরের বক্তব্য পড়ে এ পর্যায়ে পাঠক নিশ্চয়ই দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাবেন। প্রথমত. অনেকেই ভাবতে পারেন। সঠিক কথা বলা হয়েছে উপরে। মনের পশু জবাই করাই জরুরী। পশু কুরবানি নয়। তাঁদের জ্ঞাতার্থে ও সদয় বিবেচনার্থে বলতে চাই। মনের পশু জবাই করতে গিয়ে ধর্মীয় রীতির পশু কুরবানি বন্ধ করা যাবে না। সেটি ভাবার আগে ধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেন। ধর্মীয় কারণে যে কুরবানির কথা বলা হয়েছে তাতে প্রাণপ্রিয় জিনিসকে কুরবানি করতে বলা হয়েছে। ইব্রাহীম আ) এর প্রাণপ্রিয় সন্তান কুরবানি (পরে আল্লাহর নির্দেশে দুম্বা কুরবানি), খ্রিষ্ট ধর্মের যীশুর নিজের জীবন ক্রুশবিদ্ধকরণ/শ্রেষ্ঠ ত্যাগ, হিন্দু ধর্মের প্রাণপ্রিয় পশু বলিদান ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ প্রাণপ্রিয় বস্তু বা বিষয়কে কুরবানির দৃষ্টান্ত এসেছে। সুতরাং এসব বিষয়ে মন্তব্য করার আগে প্রতিটি ধর্মের সেক্রিফাইস বিষয়ক ঘটনা, শানে নুযুল, পটভূমি ও মাহাত্ম জেনে নেয়া ভালো। মনের পশু কুরবানির সাথে ধর্মীয় নির্দেশনার কুরবানিকে মুখোমুখী দাড় করাবার কোন সুযোগ নেই। আপনি যদি পশু প্রেমিক হন, তবে আপনার কাছে প্রশ্ন আপনি কি বাজার থেকে মাছ বা অন্য কোন প্রাণীর মাংস কিনে খাননা? যদি খান তবে কুরবানি আসলে মায়াকান্না আপনাকে মানায় না। যদি আপনি ভেজেটারিয়ান হন তবে জেনে রাখেন বৃক্ষ বা তৃণলতারও প্রাণ আছে। মূলকথা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে নির্বিচারে-প্রাণীবধের আন্দোলনকে মিলিয়ে বিষয়টিকে ঘোলা করবেননা।যদি করেন তবে আপনার আলাদা লক্ষ্য আছে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়!

দুই. অনেকে আবার ভাবতে পারেন যে আমি মনের পশু জবাই করতে বলে ধর্মীয় রীতিকে খাটো করছি। বিষয়টি তা নয়। ধর্মীয় রীতির কুরবানিও দিতে হবে আবার ধর্মের সেক্রিফাইস বিষয়ক ঘটনা, শানে নুযুল, পটভূমি ও মাহাত্ম জেনে-বুঝে সেভাবে জীবনের সকল প্রাণপ্রিয় অভ্যাস, কাজ, কথা, বস্তু এমনকি নিজ জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে।ইদানীং ভোগবাদী সমাজে যা দেখা যায় তা চরম দৃষ্টিকটু। নামাজ ফরজ আর কুরবানি ওয়াজিব বা সুন্নাত বা নফল ।(এ নিয়ে মাজহাবভেদে ও দলী্লভেদে ভিন্ন মতামত রয়েছে, সেটা নিজ দায়িত্বে বিশ্বাস করেন)। নামাজ মিস করলে লজ্জা লাগেনা, কুরবানি মিস হলে লজ্জা লাগে।স্পষ্ট যে, এ লজ্জা সৃষ্টিকর্তার প্রতি না, আশেপাশের মানুষের প্রতি।পশুটা বড় কিনতে হবে। কেন সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার জন্য নাকি আশেপাশের মানুষদের কাছে নিজের বড়ত্ব প্রমাণের জন্য? বিষয়টি খুবই গভীর কারণ এর সাথে ঈমান ও তাকওয়া জড়িত।যদি আপনি বিশ্বাসী হন। যারা বিশ্বাসী না, তাঁদের জন্য হিসেব আলাদা। তো কার জন্য ত্যাগ? সৃষ্টিকর্তার জন্য ত্যাগ।সৃষ্টিকর্তার সকল নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সৃষ্টির যা যা ত্যাগ করা লাগে সব ত্যাগ করাই কুরবানি বা ত্যাগ। হযরত ইব্রাহীম (আ) সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই ত্যাগের মহিমা স্থাপন করেছিলেন। কুরবানি মানে ত্যাগ। কী ত্যাগ? ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।পশু কুরবানি। বেশি মাংসের জন্য কুরবানি? ফ্রিজে রাখার জন্য? প্রতিবেশি আত্মীয়কে মাংস দিতে হবে? প্রতিবেশি ও আত্মীয়কে শুধু কুরবানির মাংস দিলেই হবে? সারাবছর তাঁদের সার্বাক্ষণিক হক আদায় করতে হবে না?

তাই প্রশ্ন আসে শুধু পশু কুরবানি দিলেই ত্যাগ? নাকি অন্য কিছু? সময় কুরবানি। সৃষ্টির কল্যাণে সময় কুরবানি দেয়া যেতে পারে। অর্থসম্পদ কুরবানি। সৃষ্টির কল্যাণে তা ব্যয় করা যেতে পারে। চিন্তা, লেখা ও কথা কুরবানি। সৃষ্টির কল্যাণে তা করা যেতে পারে। সম্পর্ক কুরবানি, ভালোবাসার কুরবানি, বন্ধুত্বের কুরবানি, ছোট ছোট আকাঙখার কুরবানি আরও কত কী হতে পারে। জীবনটাই ত্যাগ, বিলিয়ে দাও। জীবনটাই ভালোবাসা, ভালোবেসে যাও।

কুরবানি নিয়ে কাজী নজরুলের কিছু লেখা স্মর্তব্য

ইব্রাহিমের কাহিনী শুনেছ? ইসমাঈলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু-ছাগ?
আল্লাহর নামে ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্ররে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেহ হেন ত্যাগী? (বকরিদ)

অন্যত্র বলেছেন

মনের পশুরে কর জবাই
পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।
কশাই-এর আবার কোরবানি! (শহীদি ঈদ)

…….

বাংলাদেশের যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে তাঁদের অধিকাংশই প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার তথা মাছ-মাংস ঠিকমতো খেতে পারেনা।
যাদের কুরবানি দিবার সামর্থ নেই নি:সন্দেহে তারা সারাবছরই প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের অভাবে থাকেন। দেশের অপুষ্টিতে ভোগা জনতার অধিকাংশ তারাই।
আর যারা কুরবানি দেয় তারা সারাবছরতো প্রোটিন খায়ই, সাথে ঈদে আরও বেশি খাবে এবং ফ্রিজ ভরেও রাখবে।
অথচ ধর্মীয় বিধান হচ্ছে তিনভাগ করার। এক ভাগ নিজের, এক ভাগ গরীবের আর আরেক ভাগ আত্মীয়স্বজনের।

এখন যারা কুরবানি দিচ্ছেন তারা নিজেরা ফ্রিজ না ভরে গরীবদের ভাগটুকু ঠিকমতো দিয়ে দেন। যদি দেন তবে প্রতি গরীব যারা কুরবানি দেয়নি তারা ৫০ ঘর থেকে আধা-কেজি করে পেলেও ২৫ কেজি মাংস পাবে। এবং তা তাদের অনেক দিনের প্রোটিনের অভাব দূর করবে।

গরীবকে বেশি করে কুরবানির মাংস দিন। এবং তাঁদের জমানো মাংস (তাঁদের যদি ফ্রিজ না থাকে), তবে আপনার ফ্রিজে রাখতে দিন।
দেশের সকল অপুষ্টিতে ভোগা জনতার অপুষ্টি আপনি দূর করতে পারেন।
সারাদেশেরটা করার দরকার নেই। আমরা শুধু আমাদের আশেপাশের জানাশোনাদের মানুষজনকে করলেই হবে। এভাবেই দেশের লাখো অপুষ্টিতে ভোগা গরীব উপকৃত হবে।

আপনার আমার কুরবানির মাংসে ফ্রিজের পেট না ভরে, অপুষ্টিতে ভোগা, কুরবানি না দেওয়া গরীবের পুষ্টির যোগান হোক।

বিশ্বের অপুষ্টিতে ভোগা সকল জনতাকে শুভেচ্ছা

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart