Detail

Home - স্মৃতিচারণ - বিবাহনামা

বিবাহনামা

১।

সুফিয়ান বিয়ে নিয়ে একটা স্মরণিকা প্রকাশ করবে। আমাকে একটা লেখা দিতে বললো। বাই দ্যা বাই জানতে পারলাম সুফিয়ান বিয়ে করেছে। ভাবলাম একটু উপদেশ দিই।

বললাম, ‘‘জানেন বিয়ের প্রথম ১৫ বছরই সবচাইতে কঠিন। তারপর কেবল আরাম আর আরাম, শান্তি আর শান্তি। শুনে সুফিয়ান বললো, ‘‘ আপনার বিয়ে হলো কত বছর?‘‘

উত্তরে আমি বললাম ‘‘ ১৫ বছর‘‘!!

.

পাশেই বসা ছিল আরেকজন ব্যক্তি যিনি চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে তবু বিয়ে করেনি।  আমি আর সুফিয়ান এর কারণ জানতে চাইলাম।

লোকটি বলল, ‘‘সারা জীবন আমি একজন পারফেক্ট মেয়ের খোঁজ করেছি।‘‘

আমরা বললাম: তা একজন পারফেক্ট মেয়েও পাননি?

দ্বিতীয় ব্যক্তি: পেয়েছিলাম একজন। কিন্তু সে আবার একজন পারফেক্ট ছেলের অপেক্ষায় ছিল!!

.

যাই হোক সুফিয়ান বিয়ে করে আমাদের লেজকাটা গ্রুপে যোগদান করেছে, সেইজন্য তাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

২।

সম্প্রতি মোটর সাইকেল চালিয়ে গিয়ে এক মেয়ে বিয়ে করেছে। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। আমি মনে করি মোটর সাইকেল চালিয়ে বিয়ে করতে যাওয়া উত্তম উদাহরণ হয়েছে।

যারা সমালোচনা করছেন, তাদের সমালোচনাও সঠিক আছে।

যারা নারীকে মোটর সাইকেল চালাবার স্বাধীনতা দিতে চায়না, আর যারা মানুষকে ‘নারীর মোটর সাইকেল চালানোর‘ বিষয়ে সমালোচনা করতে দিতে চায়না, তারা উভয়কূল এক পথের পথিক।

নারীকে মোটর সাইকেল চালাতে দিন, বিয়ে করতে দিন। সমালোচনাকারীদের সমালোচনাও করতে দিন। এসব সমালোচনা গায়ে না মেখে নারীদের এগিয়ে যেতে দিন। সমালোচকদেরও আরও বড় সমালোচক হওয়ার সুযোগ দিন। সবাই বড় হোক! মননে মগজে, কর্মে গুণে সবক্ষেত্রে।

৩।

বিয়ে নিয়ে আরেক ধরণের খবর ভাইরাল হচ্ছে। আমি মনে করি  বাংলার কালো রঙমিস্ত্রী আর পশ্চিমা শাদা মেয়ের বিয়ে নিয়ে যেভাবে নিউজ হচ্ছে আর ট্রল হচ্ছে তাতে সাংবাদিক আর ট্রলকরারা নিজেদের হীনমন্যতা প্রকাশ করছে, কারণ বিশ্বায়নের এ যুগে সবাই সবার সাথে কানেকটেড। যে কেউ যে কাউকে বিয়ে করতে পারে। শাদা বেটি কালো ব্যাটাকে বিয়ে করেনি; পশ্চিমাও পূর্বকে বিয়ে করেনি। বরং পরিচিত ও জানাশোনা একজনকে বিয়ে করেছে।

যদিও উভয়ে উভয়ের অবস্থানকে জেনেই বিয়ে করেছে। কিন্তু সংবাদের ভাষা, বলার ভঙ্গি ও ট্রলের ধাচ দেখলে বোঝা যায় যে তাদের ধারণা পশ্চিমা বেটিকে বিয়ে করে, পূর্ব জিতে গেছে কিংবা কালোকে বিয়ে করে শাদা উদ্ধার করেছে। এ হীনমন্যতা থেকেই এ ধরণের নিউজ ও ট্রল।

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে অনেক বড় মানুষ, ভালো মানুষ, সভ্য মানুষ আছে। আবার পশ্চিমেও ছোট মানুষ, খারাপ মানুষ, অসভ্য মানুষ আছে। সুতরাং পূর্ব বা পশ্চিম কাউকে বড় করে দেখার কিছু নেই, কালো বা শাদা কাউকে হেয় করে দেখারও কিছু নেই।

উভয়ের যোগাযোগ হয়েছে, জানার সুযোগ হয়েছে বলেই বিয়ে হয়েছে। এটা স্বাভাবিক একটি ঘটনা। বিশ্বায়ন ও অনলাইনের এ যুগে এটি বারংবার ঘটবে। মিলিয়নবার ঘটবে। এতে আশ্চর্য বা বিচলিত হবার কিছু নেই।

খবর যদি লিখতেও হয় , সেটা যেন নির্মোহ হয়, ভাষার ধাচ যেন ঠিক হয়, কে জিতে গেলো বা হেরে গেলো সেটা প্রকাশ সমীচীন নয়। কিংবা সোশ্যাল ক্লাশ বা বৈশ্বিক-সামাজিক-শ্রেণী তৈরির উহ্য উপাদান যেন লেখায় বা খবরে না থাকে সেটা বিবেচনা করা সাংবাদিকতায় কাম্য।

.

৪।

এবার নিজের বিয়ের কথা বলি। আমার বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য করা তথা ফর্দ খাওয়ার কয়েকদিন পরেই কনের বড় ভাই সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। বিয়ের কয়েকদিন আগে এ মৃত্যুতে আমাদের বিয়েটি আনন্দঘন পরিবেশ পায় নি। শোঁক আর কান্নার মধ্যেই বিবাহ অনুষ্ঠানটি হয়। তবু দুটি ঘটনা বলি।

.

কনের বাড়ি থেকে অনেকটা পথ হেঁটে এসে গাড়িতে উঠতে হবে। কনে কান্নাকাটি সুর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে চোখের পানি বন্ধ হলেও কান্নার সুর বন্ধ হচ্ছে না। আমি বললাম কাঁদলে ভালো করে কাঁদো, চোখে পানি নেই, কেবল সুর করে কাকে কী শুনাচ্ছো! শুনে আশেপাশের সবাই হেসে উঠলো। কনে লজ্জা পেয়ে কান্নার সুর আরও বাড়িয়ে দিল, সাথে ফুঁপানিও চলতেছে। যাই হোক, হাত ধরে হাটতেছি দুজন। সামনে পেছনে বরযাত্রীর অন্য সকল লোক। হাঁটার ফাঁকে কতক্ষণ পরে নিজের হাতটা ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। দেখলাম সে থামছে না। আমাদের সাথেই সামনের দিকে হাঁটেছে। আমি বললাম, বাহ! তোমার দেখি স্বামীর বাড়ি যাওয়ার খুব আগ্রহ! ছেড়ে দিলাম তোমাকে, কিন্তু তুমি পেছন দিকে না গিয়ে আমাদের সাথে সামনেই হাঁটছো! তার মানে তুমি খুশি মনেই যাচ্ছো আমার সাথে। কান্নাটা কেবল লোক দেখানো। শুনে আশেপাশের মানুষের আবার হাসি। কনে হাসিকান্নার মুখে এক অপরূপ চাহনি দিল আমার দিকে। আমার হাত ধরে দারুণ এক চিমটি।

.

পরের দিন বউভাত। বউভাতে গোসলের আগে একটা পর্ব আছে। বেশকটা ছোট ছোট মেরা পিঠা বানিয়ে বউয়ের হাতে দেওয়া হয়। বউ সবগুলো পিঠা জোরে উঠানে ছুঁড়ে মারে। বর সবগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসতে হয়। যতটা খুঁজে আনতে পারে ততটা বাচ্চা হবে- এই হলো অন্ধ-বিশ্বাস। আমার বউ মাশাল্লাহ স্পোর্টস এক্সপার্ট। চাকতি নিক্ষেপে প্রথম হতো। সুতরাং মেরা পিঠা এমনভাবে মারা শুরু করলো যে আমার প্রতিবারে কোমর ব্যথা হওয়ার যোগাড়, সারা উঠানের দূর দূরান্ত থেকে কুড়িয়ে আনতে আনতে আমি কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম।

৫।

আমার মা খালারা তিনবোন। আমার মা বড়। আমার বড় খালার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি খুব ছোট। তখনকার কিছুই মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, খালার সাথে পাল্কির ভেতরে আমি বসে আছি।

খালাকে বাপের বাড়ি ভল্লবপুর থেকে শশুর বাড়ি শিমরাইল নিয়ে যাচ্ছে। তখনকার দিনে মনে হয় নতুন বউয়ের সাথে একটা ছোট বাচ্চা দিয়ে দেওয়া হতো। যদি ছোটখাটো কোন কাজে লাগে। আমি কোন কাজে লেগেছিলাম কিনা মনে নেই।

তবে এটুকু মনে আছে। পাল্কির ভেতরে আমি আর খালা বসা। গরমে আমি ঘামছি, খালাও ঘামছে। খালা সুর ধরে কাঁদতেছে। চোখ মুছতেছে। শুরুর দিকে আমার মায়া লেগেছিল। আমি ভাবছিলাম খালাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও ভয়ে ও খালার মায়ায় একটু কেঁদেছিলাম বোধ হয়। বিয়ে, স্বামী, বউ এতকিছুর রহস্য বোঝার বয়স তখনো হয়নি। যাক খালার কান্না চলছিল। পরে কানের সাথে মনে হয় এডজাস্ট হয়ে গেছিল। বেহারার হাঁটার তালে তালে কান্নার সুরের দোলাচলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিনা সেটা মনে করতে পারছিনা। তবে এও মনে আছে বেহারারা মৃদু তালে লাঠি হাতে হাঁটছে, আর বরযাত্রীর অন্যরা বাইরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। আমি দুএকবার উঁকি মেরে দেখেছিলাম। তখন সুদিন (বর্ষাকাল নয়) ছিল। মসুরি, কলাই, সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে, ইরি ধানের মেলাবন বিল পেরিয়ে চলছিল বেহারারা। পাল্কির চারপাশের দৃশ্যটা এখনো চোখের সামনে ভাসে।

.৬।

শেষ করি “ফারাক স্রিফ ইতনা সা থা” নামে একটা উর্দু কবিতা দিয়ে। বিয়ে ও মৃত্যু নিয়ে সুন্দর কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করেছেন জ্যোতির্ময় নন্দী। কি সুন্দর “মিল” মৃত্যু ও বিয়েতে, চমৎকার বর্ণনা:

“তোমার পাল্কি উঠলো,

আমার খাটিয়া উঠলো,

ফুল তোমার উপরেও ঝরলো,

ফুল আমার উপরেও ঝরলো,

তফাত শুধু এটুকুই ছিলো – তুমি সেজে গেলে, আমাকে সাজিয়ে নিয়ে গেলো।

তুমিও নিজের ঘরে চললে,

আমিও নিজের ঘরে চললাম,

তফাত শুধু এটুকুই ছিলো – তুমি নিজেই উঠে গেলে, আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো।

মাহফিল ওখানেও ছিলো,

লোকজন এখানেও ছিলো,

তফাত শুধু এটুকুই ছিলো – ওখানে সবাই হাসছিলো, এখানে সবাই কাঁদছিলো।

কাজি ওখানেও ছিলো,

মৌলভি এখানেও ছিলো,

দুটো আয়াত তোমার জন্যে পড়লো,

দুটো আয়াত আমার জন্যে পড়লো, তোমার বিয়ে পড়ালো,

আমার জানাজা পড়ালো,

তফাত শুধু এটুকুই ছিলো – তোমাকে করলো আপন, আমাকে করলো দাফন।”

.

বিবাহনামা শেষ করলাম। সবার জন্য শুভকামনা। বিয়ের আগে, বিয়ের পরে, ও মৃত্যুর পরে সব পর্বে যেন ভালো থাকি।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart