Detail

Home - শিক্ষা - অস্ট্রেলিয়ার স্কুলে অভিভাবক সমাবেশ

অস্ট্রেলিয়ার স্কুলে অভিভাবক সমাবেশ

আজ আমার ছেলে ও মেয়ের স্কুলে অভিভাবক-শিক্ষক মিটিং ছিল। স্কুলের নাম রবার্টসন স্টেট স্কুল। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলে গেলাম। দেখলাম বিভিন্ন ক্লাস ও শাখার শিক্ষকরা আলাদাভাবে বসে প্রত্যেক অভিভাবকের সাথে ১০-১৫ মিনিট করে কথা বলছেন। আমার পর্ব এলে আমি বসলাম। আমি যতবার এসব মিটিং এ গিয়েছি ততবার বাংলাদেশী স্টাইলেই মানসিক প্রস্তুতি রেখেছি যে “বাচ্চারা স্কুলে দুষ্টুমি করলে বা পড়া ফাঁকি দিয়েছে এসব শুনবো এবং বাসায় এসে বকা দিব”।

কিন্তু না। শিক্ষকরা সহাস্যে বাচ্চাদের বিস্তারিত কার্যক্রমের বর্ণনা দিলেন, অনেক প্রশংসা করলেন। বাচ্চারা যে অনেক সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে তা জানালেন। আমি যতই জিজ্ঞেস করি যে “কোন সমস্যা আছে কিনা, কোন কনসার্ন আছে কিনা, কোন ইস্যু আছে কিনা” ততই বলেন, নো, কোন সমস্যা নেই। আমাকে হোমওয়ার্ক পারফরমেন্স দেখায়, ক্লাশ একটিভিটিতে কী করেছে তা দেখায়, একস্ট্রা কারিকুলামে কী করেছে দেখায়, ক্লাস এসেসমেন্টে কী করেছে তা দেখায়।খাতা ধরে ধরে লাইনে লাইনে শিক্ষকের পর্যবেক্ষণ দেখায়। সব মিলিয়ে খুব খুশি এবং এবং হাইলি সেটিসফাইড জানায়।

বাচ্চা ক্লাসে কীরকম আচরণ করে, কার সাথে মিশে, কার সাথে খেলে, এটিকেট, ম্যানার ইত্যাকার পারসনাল বৈশিষ্ট্য শিক্ষক বর্ণনা করে আর আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি যে বাবা-মা হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানের যেসব বৈশিষ্ট্য খেয়াল করি তার বর্ণনাও অনুরুপ বৈশিষ্ট্যই মিন করে। কত গভীর ও আন্তরিক তাঁদের পর্যবেক্ষণ।

তাঁদের হাজার সন্তুষ্টি আর ভালো পারফরমেন্স দেখানোর পরেও আমি জিজ্ঞেস করি আমি কি কোনভাবে বাসায় কেয়ার নিতে পারি। ইংরেজি, রাইটিং, বা ম্যাথে? এ প্রশ্নের উত্তরে জানায়, না তোমার কিছুই করতে হবেনা। এরা খুব ভালো করছে এবং যা করার তা আমরা ক্লাসেই করবো।

…………….

বাংলাদেশেও অভিভাবক-শিক্ষক সভা হয়। এটির নাম হয় অভিভাবক সমাবেশ। বিশাল হলরুম। বিশাল ব্যানার, অনেক অতিথি। অভিভাবকরা সামনে বসে। রাজনৈতিক সমাবেশ-মিছিল টাইপের বানিয়ে ফেলি। আমরা সবকিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করি এবং আসল উদ্দেশ্যটুকু হারিয়ে ফেলি। ইফিসিয়েন্সি হয়, ইফেকটিভনেস হয়না। কাজ হয়, ফল হয়না। শিক্ষা অফিসার প্রতিবেদন দেন যে প্রতি স্কুলে অভিভাবক সমাবেশ হয়েছে। ওই সমাবেশের কার্যকরিতা ও টেকসই ফলের খবর আর দেখিনা। অভিভাবক সমাবেশ মানেই উপজেলার বড় নেতারা, উপজেলার বড় স্যারেরা, ইউনিয়নের বড় নেতারা, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা, স্থানীয় মাতবররা কতজন আসে আর কত বক্তব্য যে রাখে তার কোন ইয়ত্বা নেই।বেশিত্রভাগ বক্তব্যই অপ্রাসঙ্গিক। কোন অফিসার বা শিক্ষক যদি অতিথিদের ঠিকমতো এড্রেস না করে আমার মতো সংক্ষিপ্ত প্রয়োজনীয় বক্তব্য দিতে যায় এ নিয়েও কথা হয় যে “আমি অমুক হোমরা-চোমরা, আমার নামটা তিনি বলেননাই” ইত্যাদি ইত্যাদি।

সবাই বক্তব্য দেয়, সব অভিভাবককে সমান উপদেশ দেয়, অভিভাবকের কী করা উচিত, কী করতে হবে তার ফিরিসতি দেয়। প্রত্যেক ছাত্রের জন্য প্রত্যেক অভিভাবকের বাস্তব প্রেক্ষিত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলা হয়না। ফলে এ অভিভাবক সমাবেশের কোন মূল্য হয়না।

এমনিতেই অভিভাবকরা আসতে চায়না। যারা আসে তারাও গরমের মধ্যে এসব আজাইরা বক্তব্য শুনতে হবে মনে করে বাসার প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে স্কুলে আসতে চায়না। আমার বিশ্বাস অস্ট্রেলিয়ার মতো ফলপ্রসূ অভিভাবক-শিক্ষক সভা হলে কমপক্ষে ৯৫ ভাগ (গ্রামে ৮০ ভাগ) বাবা-মা এ সভায় আসবেন।

অনেকে বলবেন যে অস্ট্রেলিয়াতে ক্লাসে ছাত্র মাত্র ত্রিশ জন। তারা পারেন। আমাদের ছাত্র প্রতি ক্লাসে ১০০ এর উপরে আমাদের পক্ষে সম্ভবনা। এ প্রসংগে আমি বলতে চাই, তাঁরা একদিন করে বছরে তিনবার করে, আমাদের এখানে তিনদিন করে বছরে তিনবার করা যেতে পারে। না পারলে ন্যুনপক্ষে তিনদিন করে একবার করা যেতে পারে। আবার আমার দেখা অনেক স্কুলে ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা ত্রিশের মধ্যেও আছে। একবার এক স্কুলে গেলাম ক্লাসে উপস্থিতি ৭-৮ জন। শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম, মোট ছাত্র কতজন তিনি বললেন ৩৭ জন। আলু ফসল তোলার সীজন তাই বাচ্চারা আজ আসেনি। একজন ছাত্রকে দেখিয়ে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম যে ছাত্রটির নাম কি? শিক্ষক বলতে পারেননি। ওই শিক্ষক ওই স্কুলে তিন বছর যাবত পড়ান। এবং সে স্কুলে মোট ছাত্রছাত্রী সংখ্যা খুব বেশি ছিলনা। আবার উল্টো চিত্রও পেয়েছি যে বাংলাদেশে অনেক শিক্ষক শতশত ছাত্রছাত্রীর বিস্তারিত জানেন ও খেয়াল করেন।

এখানেই অস্ট্রেলিয়ার সাথে আমাদের তফাৎ। তাঁদের সকল স্কুলের এবং সব শিক্ষকের প্রায় সমমানের কার্যক্রম। যেখানে বাংলাদেশে স্কুলে স্কুলে শিক্ষকে শিক্ষকে রাতদিন তফাৎ।

বাংলাদেশে আমার বাচ্চারা চারটি জেলার চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে। জেলা-উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে শিক্ষকদের সাথে আমার নিযমিত কথা হতো এবং বাচ্চাদের নিয়ে আলোচনা করতেন। কিন্তু এখানকার মতো এত গভীর, আন্তরিক এবং সম্যক ধারণা ও বাস্তবতার বর্ণনা আমার বাচ্চাদের সম্পর্কে শিক্ষকরা আমাকে দিতে পারেননি।

এটা হয় দুভাবে। কতকটা সিস্টেমের মাধ্যমে হয় আর কতকটা শিক্ষকের ভেতর থেকে আসতে হয়। দুজায়গাতেই আমাদের সমস্যা আছে।

যাই হোক, আমাদেরও হবে। নতুন প্রজন্ম ঠিক পাল্টে দেবে নব উদ্যমে সে আশাবাদ রইলো।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart