ইউরোপ ভ্রমন: ইতালির মিলান শহর
ভেনিস থেকে মিলান যাবো, যে শহরে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির দ্যা লাস্ট সাপার ম্যুরাল অবস্থিত। মিলানে কার কাছে যাবো তার ঠিক নেই। ঢাবির বন্ধু শিপু এখন মিলান থাকে। ফেসবুকে জানিয়েছিলাম যে যেতে পারি। শিপু আমাকে খুব আন্তরিকভাবে ফোন দিয়ে জানালো আমি যেন যাই। যাবো কি যাবোনা ভাবছি, তবু ভেনিস থেকে মিলানের টিকেট কেটে ট্রেনে উঠিয়ে দিল এনাম, কিবরিয়া, ও হানিফ ভাই। ট্রেন চলছে, দুপাশে রাশি রাশি জমি-খাল-প্রান্তর পেছনে ফেলে ট্রেনে বসে আমি ধাবিত হচ্ছি ভেনিস থেকে মিলানের পথে।
.
ট্রেনে বসেই সাজু ভাইয়ের ফোন পাই। বললেন ‘‘ভাই, আমি শিপুর বড় ভাই‘‘। মিলানে কীভাবে নামবো টিকেট কাটব তার পরামর্শ দিল। পরে বললাম, ভাই কি ফ্রি আছেন?
বললেন যে ফ্রি আছেন।
আমি বললাম চলেন দুই ভাই মিলে ঘুরি মিলান সিটি। বললেন, আচ্ছা।
সেই থেকে শুরু। গাড়ি নিয়ে এলেন আর একের পর এক দেখাতে থাকলেন।
কিছু মানুষ সারাজীবন আপনার সাথে চললেও আপনার উপর প্রভাব ফেলতে পারেনা। কিছু মানুষ কয়েকঘন্টায় আপনার জীবন দর্শন ও ভাবনার সব খোলনলচে বদলে দিতে পারে। সাজু ভাই তেমনি একজন।
মিলান ট্রেন স্টেশনে নেমেই পরের দিনের জেনেভা যাওয়ার টিকিট কিনলাম স্টেশন থেকে। আমার সময় আর গন্তব্য বলার পরে কাউন্টারের লোকটি কম্পিউটারে কি টেপাটিপি করে টিকেট ধরিয়ে দিল।
প্রথমে সাজু ভাই এক বন্ধুর এখানে গেলেন। চাঁটগায়ের ব্যবসায়ী মিলানে থাকেন। সবে মিলে কফি খেলাম। ওনারা স্ট্রং ডোজ নিলেও আমি কাপোচিনোতে সন্তুষ্ট।
.
কফি শেষ করে দুজনে বেরিয়ে পড়ি। রাজবাড়ি দেখি, দুমো দেখি, ইমানুয়্যাল গ্যালারি দেখি। Duomo বিশ্বের বৃহত্তম গোথিক ক্যাথেড্রাল এবং ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম গির্জা। বিল্ডিং নির্মান শুরু ১৩৮৬ এবং প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলেছে! এর মার্বেল চমতকার এবং এর ছাদে ১৩৫ টি স্পিরি এবং ৩২০০ মূর্তি রয়েছে। ক্রুশবিদ্ধ খ্রীষ্ট রয়েছে। এই দোমো কেন্দ্র করে মিলানের হাব। দোমোর সামনে বসে কবুতরকে কিছু খাওয়ালাম আর ছবি তুললাম।
.
এরপরে অনেক দূর হেঁটে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির বিখ্যাত শিল্পকর্ম “দি লাস্ট সাপার” নামের একটি ম্যুরাল দেখতে গেলাম। এই ম্যুরালে ১২ জন শিষ্যসহ যিশুকে দেখানো হয়। এই শিল্পকর্মটিসহ ভিঞ্চির আরও বেশ কিছু কাজে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মিথলজির প্রভাব পাওয়া যায়।
তারপরে দেখলাম রাজবাড়ি। যেটাকে রয়েল প্যালেস বলে যেখানে ডিউক অব মিলান থাকতো। এ রাজবাড়ি মধ্যযুগ তথা ১৬ শতকে নির্মিত হয়। সাত হাজার বর্গমিটারের এ রাজবাড়ি এখন মিলান সিটির আর্টকেন্দ্র। এখানে সমসাময়িক বিভিন্ন সংগ্রহ প্রদর্শন করা হয়, জাদুঘর অংশ রয়েছে। বছরে প্রায় ১৫০০ মাস্টারপিস দেখানো হয়। রাজবাড়িটি দেখে আমি ভাবছিলাম সবদেশের রাজারাই এক। প্রজাদের রক্ত চোষে প্রাচীর তৈরি করে। খাজনার নামে চলে নানান অত্যাচার। যুদ্ধের খরচ সহজে মেটায় রাজা, প্রজার ক্ষুধা নিবারণের অর্থ থাকেনা রাজার হাতে।
.
ফ্যাশন এবং ডিজাইনের জন্য প্রসিদ্ধ শহর মিলান। তাই একে আবার বিশ্বের ফ্যাশন এবং ডিজাইন ক্যাপিটাল বলা হয়। ইমানুয়্যেল ভিট্টরি গ্যালারীর চারপাশে অনেক ব্রান্ডের দোকান। গ্যালারিটি নীল কাঁচ, মার্বেল মোজাইক, আর বড় ডোম মিলে অনবদ্য স্থাপনা। নয়নজুড়ানো স্থাপনা। ছবি তুললাম কয়েকটি। দেখছিলাম মন ভরে। ও হ্যাঁ, এই শহরের পরিচয় ফুটবলের জন্যও আছে। নামকরা সব ফুটবলের মাঠ এবং ফুটবল দল যেমন ইন্টার মিলান, এসি মিলান এই শহরের নামে।
.
হাঁটি আর দেখি, আর সাজু ভাই কথা বলে। সিগারেট টানে ধোঁয়া ছাড়ে আর কথা বলে। আমি মিলানের ঐতিহাসিক সব স্থাপনা, রাস্তাঘাট, মানুষের চলাফেরা দেখে দেখে অবাক হই , সাজু ভাইয়ের কথায় আরও বেশি মুগ্ধ হই। আমার মাথা ঘুরে, জীবন তুচ্ছ মনে হয়, দুনিয়াকে বেফানা লাগে।
টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি না , সে এক অন্য জগতের কথা বলছেন সাজু ভাই। বছর পার করা মানে জীবন না, প্রতি মুহুর্তেই জীবন খুঁজে নেন সাজু ভাই।
.
আমি হাসতে থাকি জীবন ভাবনায় হারাই। বব মারলের নানান গান শোনাতে থাকেন। জ্যামাইকান ধারার আরো অনেক শিল্পীর গান। বাউল গান আর গণসংগীত । প্রতি গানের শানেনুযুল বলেন অর্থ বলেন। আমার মুগ্ধতা বাড়তে থাকে, সংসার তুচ্ছ লাগে।
দুপুরে ঘুরাঘুরি শেষে একটি স্থানীয় পিতজার দোকানে যাই। দুটো পিৎজা অর্ডার দেন। ক্ষুধার্ত পেটে ইয়াম্মি পিৎজা অমৃত লাগে। ঝাঁল ঝাঁল পিতজায় আমার তৃপ্তি চরম শিখরে ।
সাজু ভাই প্রায় ২৫ বছর ধরে আছেন মিলানে, চাকরির পাশাপাশি সামাজিক কাজ করেন, ভলান্টিয়ার হন, শ্রম আন্দোলনে আছেন এখানে।
.
বিকালে নিয়ে যান অনেক দূরে নদী দেখাতে। মিলান থেকে দূরে অরণা এলাকায়। নদীর নাম টিসিনো যেটি সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত প্রবাহমান। পুরো পথটা ড্রাইভিং করে নিয়ে যান। এত সুন্দর! আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। সবুজ পাহাড় আর নদীতে একাকার। আমি লাইভে থাকি ফেসবুকে। সাজু ভাই হাল্কা টোনে গভীর কথা বলেন। গাড়িতে গান বাজে, সাজু ভাই তর্জমা করে, উপমা দেয়, ঠাট্টা করে, সিগারেটে সুখটান দেয়, মাঝে মাঝে গান গায়। বব মার্লে , মাটির গান, মানুষের মন জয় করার গান, বিদ্রোহের গান, বিদ্রুপের গান একের পর এক বাজতে থাকে। গান শুনি, দৃশ্য দেখি, আর আমি হাসি আর ভাবি।
সাজু ভাই এ এক অন্যরকম সঙ্গ দিলেন। কেউ বাড়ি গাড়ির কথা বলে, কেউ গবেষণা পাবলিকেশন পান্ডিত্য দেখান, কেউ ক্ষমতা দেখান।
আর সাজু ভাই এসব কিছুই না দেখিয়ে আমাকে জীবন দেখিয়ে দিলেন।
সাজু ভাই , আপনি আমার মনে থেকে যাবেন সারাজীবন। আর আপনার মাধ্যমে দেখা মিলান সিটিও থেকে যাবে আমার মননে মগজে।
.
রাতে ফিরি সাজু ভাইয়ের বোন তথা আমার ঢাবি বান্ধবী শিপুর বাসায়। টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো দেখে আমি বলি ‘‘কী দরকার ছিল এতকিছুর।‘‘ বত্তা শাক আর সিদল শুঁটকির লেটকা ভর্তাটা হেভি ছিল। খেতে খেতে হাতের আঙ্গুল চাটতে চাটতে শিপুরে বলি ‘‘তোর বোম্বাই মরিচের আচারের রেসিপি নিব‘‘ আর মনে মনে ভাবি ‘‘তোর ধৈর্য্য আর ত্যাগের দীক্ষা তো নিয়েছিই ।বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতে নাই। তাই দিলামনা। কিউট দুইটা বাবুর জন্য এত্তগুলা আদর। ভালো থাক নিরন্তর।‘‘
.
শান্ত স্নিগ্ধ এ মিলান শহরটি আমার কাছে সব মিলে আর্টিস্টিক মনে হয়েছে। পুরাতনকে ধরে রাখার ও সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার একটা চেষ্টা , ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ও যত্নে লালন করার একটা প্রয়াস আমি শিখলাম মিলান থেকে।
শিপুর আতিথিয়েতা আর সাজু ভাইয়ের সঙ্গ,
হয়ে থাকলো এ ভ্রমনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
2019
স্যার,পুরাটাই পড়লাম, এককথায় অসাধারণ!!