Detail

Home - ভ্রমণ কাহিনী - খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর…..

খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর…..

খুলনাতে দুদিন:

ভৈরব নদী ও রূপসা নদীর তীরে খুলনা শহর অবস্থিত। ভৈরব এখানে শহর নয়, একটি নদীর নাম। রূপসা ও ভৈরব নদী এখনো যৌবন ধরে রেখেছে। টইটুম্বুর পানিতে। খুলনাতে আসতে ভালো লেগেছে। পদ্মা পার হবার রাস্তা খুব ভালো। মসৃণ আর গাড়ির সংখ্যা কম বিধায় দ্র্রুত টানা যায়। দুপুর আড়াইটায় রওয়ানা দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় খুলনায় পৌঁছে যাওয়া আমার কাছে মিরাকলই মনে হলো। পদ্মা ব্রিজ হয়ে গেলে এ ভ্রমণ আরও সুখকর হবে। গোপালগঞ্জ পেরিয়ে বাগেরহাটের কবিরহাটে থেকে দুধ-চা খেলাম। আলগা পাতি দিয়ে খাঁটি দুধের চা বড় ভালো লাগলো।

খুলনাতে এসেছি অফিসের কাজে। দুটো সভা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৫টি পাটকলে এখন উতপাদন বন্ধ রয়েছে। শ্রমিক নেতাদের বাড়াবাড়ি ও আরও নানান নেক্সাসের ফল এটি। যাই হোক, সরকার লোকসান থেকে বাঁচতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেরকম দুটো পাটকলের এন্টারপ্রাইজ বোর্ডের পরিচালক হিসেবে অর্থ বিভাগের মনোনীত হওয়ায়  এ সভায়  আসা। পাটকল ঘুরে ঘুরে দেখে, এ বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা করে, নথি ঘাঁটাঘাটি করে, ব্যবস্থাপনার ভিতরের ও বাহিরের অনেক গল্প শুনে জানা ও বোঝা অনেক গভীরে পৌঁছেছে। সেসব বিষয়ে না যাই। দার্শনিক ভিউ থেকে বলতে চাই। উথান পতন এ জগতের অমোঘ নিয়ম। ১৯৫০ সালের দিকে যে পাটগুলো রমরমার মধ্য দিয়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করলো, সেই পাটকল এখন নেই নেই অবস্থা। পাটকলের লাভের হিসেব এখন লোকসানে ঠেকেছে, আর শ্রমিক নেতাদের রমরমা অবস্থার প্রতিযোগিতাও এখন শূন্যে ঠেকেছে। পৃথিবীতে একেকটা শিল্প এরকম ভাবে উথান হয়, আবার কেমন যেন নিভিয়ে যায়।  মৃত শিল্প, পাঠ শিল্প যেমন এখন নিবু নিবু। তেমনি আইটি বা সফ্টওয়্যার ব্যবসা কি একসময় ধ্বস নামবে? পৃথিবী তখন কি নিয়ে ব্যস্ত হবে? পরিবর্তিত পৃথিবীর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে পাট শিল্পও টিকতো। বেশি চালাক মানুষদের কারণে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় কাঠামো একটা ছেড়ে আরেক ফিগিরে নামে। হাতের কাছে থাকতে মানিক কাঙ্গাল হতে চায়। সে সময় খুব দূরে নয় যখন ইউটিউব, গুগল, অমুক তমুক ব্যবসায় ধ্বস নামবে, যদি না তারা পরিবর্তনকে গ্রহণ করে অনায়াসে।

সেসব কথা থাক। খুলনার কথা বলি। খুলনা মাছের অভয়ারণ্য। পাইরশা মাছ ভাজা ও ঝোল দিয়ে রান্না দুটোই অমৃত। ভেটকি মাছ খেয়ে মুখে লেগে আছে স্বাদ। স্বরপুরিয়া মিষ্টিও খেতে ভালো লাগলো। রাস্তা-ঘাটা উন্নত, মসৃণ। গাড়িঘোড়া কম হওয়ায় অনেক স্পীডে গাড়ি চালানো যায়।

খুলনার সার্কিট হাউজ, নদীর পাড়ে বিভাগীয় কমিশনারের বাংলো, খান জাহান আলী সেতুর রাতের দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। শহরের অলিগলি ঘুরে আরও অনেক স্মৃতিতে জমা হয়েছে। সব কথা আর না বলি। কেবল খুলনা জেলায় প্রচলিত একটি গান শেয়ার করি। এ পালকি গানে কন্যা বিদায়ের ক্ষণটি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

‘আরে ওরে অমেলা সুন্দরী

ওঠে চলে যায় দেশে।

হাতের পাতের খায়ইয়ে অমেলা

মানুষ করলাম তোরে।

আর কতোদিন থাকপা অমেলা

মা বাপরো ঘরে।

তখন কান্দিতে লাগল অমেলা

কইতে লাগিল

কত টাকা পাইয়ে বাপজান

অমেলারে খাইলে বেচে

টাকা লইনি কড়ি লইনি

মাজান শুধুই মুখের বাণী

তখন কান্দে ওরে অমেলা

মায়ের গুলা ধরে

আর কেন্দোনা অমেলা

কইয়ে বুঝাই তোরে

তারায় করে ঝিঁকির মিকির চাঁদে আলো করে’।

(স্মরণ করছি: খুলনার বিভাগীয় কমিশনার স্যার ও ভাবী, জেলা প্রশাসক স্যার, খুলনা; আমার বন্ধু ইকবাল, উপপরিচালক,  স্থানীয় সরকার, খুলনা; ঢাবি মার্কেটিং এর বন্ধু শরীফুল, প্রফেসর খুলনা ইউনিভার্সিটি; ও প্রিয় অনুজ এনডিসি, খুলনা)

……………………………..

বাগেরহাটে এক বেলা।

খান জাহান আলী জাদুঘরে একটি প্লেট দেখে অবাক হলাম। একটি প্লেট রয়েছে যা এমন উপকরণ দিয়ে বানানো যে ওই প্লেটে যদি কেউ বিষাক্ত খাবার দেয় তবে প্লেটের রঙ বদলে যেতো। তার মানে কেউ মেরে ফেলার জন্য বিষ মেশাতে পারবেনা। গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা এরকম প্লেটে ভাত খেতেন। তার মানে তখনও শত্রু ছিল, তখনও রাজসিংহাসন হারানোর ভয় ছিল, তখনও ষড়যন্ত্র ছিল।

আরেকটি প্লেট দেখলাম ৫০০ বছর আগের তৈরি। প্লেটের দুটো স্তর। উপরের স্তরে খাবার রাখা হবে। আর দ্বিতীয় স্তরে গরম পানি দেওয়া থাকে, যাতে গরম পানির ভাপে উপরের স্তরে রাখা খাবার ঠান্ডা না হয়। ৫০০ বছর আগের এ ওভেন সিস্টেম দেখে আমি যারপরনাই অবাক হলাম।

খান জাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের গভর্ণর পদে যোগ দেন। পরবর্তী জীবনে নানা ধাপ পেরিয়ে জৈনপুর থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ এবং প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। তার এই বাহিনীতে কয়েকজন সূফি ও প্রকৌশলী ছিল। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানীর দিকে না যেয়ে অজ্ঞাত কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে আসেন।

৫০০ বছর আগের তৈরি ষাট গম্বুজ মসজিদ। হযরত খান জাহান আলী (র:) এ স্থাপনা তৈরি করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সব গম্বুজ হিসেব করলে ৮১টি গম্বুজ রয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খানজাহান (রঃ) ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদুর চট্রগ্রাম, মতামত্মরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আমি কেবল ভাবছিলাম ৫০০ বছর আগে আমাদের মতো কত রহিম করিমের জন্ম ওখানে ছিল। কিন্তু আর কেউ কিছু করেছে কিনা জানি না। তবে খান জাহান আলী যে স্থাপনা করে গেলেন তা সত্যিই অতুলনীয়। বোঝা যায়, কেবল খাওয়া, পরা, ঘুমানোর জন্য পৃথিবীতে আসেননি। জন্ম যখন হয়েছে তখন বাড়তি কিছু করতে হবে এই ছিল অভিপ্রায়। ভারত, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানী যেখানেই ঘুরেছি, সেখানেই দেখলাম অমরত্ব লাভের জন্য আগের দিনের পয়সাওয়ালারা বা ক্ষমতাওয়ালারা এরকম স্থাপনা, দিঘী, ভবন ইত্যাদি করেছে। হয়তো তারা অমর হয়েছে, হয়তো হয়নি। নরসিংদীর মাটির তলে পাওয়া স্থাপত্যনগরীরে কথা ভাবলেই বোঝা যায় সব ধ্বংস হবে, কিছুই রবে না ভবে। তবু আমরা অমর হতে চাই, তবু আমরা কিছু্ একটা করতে চাই।

ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত বাগেরহাট শহর দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। নদীর পাড় ঘেষে অবৈধ স্থাপনা, ও নোংরা আবর্জনাগুলো সরিয়ে নান্দনিক পার্ক করা গেলে সুন্দর পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে বাগেরহাট শহর।

……………..

যশোর যাবো। তবে তার আগে খুলনা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এ বন্ধু সিফাতের বাসায় লাঞ্চ করে যেতে হবে- এই হলো সিফাতের আবদার। আর পাশের রবীন্দ্রনাথের শশুর বাড়ি। তথা মৃণালিণীর বাড়ি। মৃণালিণী কে? সবাই জানি রবীন্দ্রনাথের বধুর নাম মৃণালিনী। কিন্তু তার আসল নাম কি? কী তাঁর পরিচয়?

খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের বেণীমাধব রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন জোড়সাঁকুর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী এস্টেটের বেতনভূক্ত কর্মচারি। বেণিমাধবের কন্যা ভবতারিণী দেবী ওফে পদ্ম ওরফে ফুলি ওরফে ফেলির সাথে ১৮৮৩ সালে বিয়ে হয় রবি ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর আর ফেলির বয়স ছিল ১১ বছর। বিয়ের পরে ঠাকুর পরিবার নাম রাখে তাঁর মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথের বাপের শশুরবাড়ি তথা রবি ঠাকুরের মামার বাড়িও  এ দক্ষিণ ডিহি গ্রামে। মামারাই এ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রবি ঠাকুরকে বিয়ে করান।

বেনী মাধব রায় চৌধুরীর দুচালা টিনের ঘর ছিল যেটি ভেঙ্গে দোতলা দালান তৈরি করা  হয়। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর দুই পুত্র এবং তিন কন্যাসহ সন্তান ছিলেন পাঁচ জন: মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ। এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে। মৃণালিনী দেবী মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। পরবর্তীতে উক্ত দুতলা বাড়িটি বেহাত হয়ে যায়, নানান লোকে নানান কাজে এ দুতলা বাড়ি ব্যবহার করেন। ১৯৯৫ সালে এটি পুনরূদ্ধার করা হয়। নাম দেওয়া হয় রবীন্দ্র কমপ্লেক্স।

রবি ঠাকুর আর মৃণালিনী দেবীর অনেক বিষয় আমার আগেই পড়া ছিল। বাড়ি আর ছবি দেখতে দেখতে আমার অনেক কথাই মনে পড়লো। মৃণালিনীর মুখের অনেক কথা যেন আমি কানের কাছে শুনতে পেলাম। কী কী বললো সে কথা আর না বলি। সব কথা কি আর বলা লাগে? জগতের সকল কিশোরীর জীবন একরকমই, তবে বাংলার কিশোরীদের জীবন অন্যরকম। প্রায় একই রকম জীবন গল্প, প্লট, বৈশিষ্ট্য, উথান, পতন, পরিণাম। সুখ তাঁদের গলা দিয়ে নামে না, বরং দলা পাকিয়ে উগড়ে উগড়ে উঠে। তবু সমাজ সংসার, সংস্কৃতিকে মেনে নেয়। শুধু হাতের বালা, কপালের সিঁধুর দিয়ে নয়; মননে মগজে প্রকাশে গোপনে মানিয়ে নিজেকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে বিস্তীর্ণ সাগরে গলা উঁচিয়ে রাখতে হয়।

06.02.2021

………………

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর “কপোতাক্ষ নদ” কবিতায় লিখেছেন

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।…

সেই নদ দেখবো বলে গেলাম যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে সাগরদাঁড়ি গ্রামে । সেখানে গিয়ে কবির পৈত্রিক জমিদারী ও বাড়িঘর দেখলাম। নৌকায় ভেসে ভেসে স্বপরিবারে কপোতাক্ষ নদের কলকল ধ্বনি শ্রবন করে তৃষ্ণা মেটালাম। কবির বাড়ির বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নে বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্নতত্ব বিভাগের একজন কাস্টোডিয়ান। ভদ্রমহিলা খুবই সপ্রতিভ ও ভালো জ্ঞান রাখেন। খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে সব বললেন। আমি কম সময়ে অনেক বিষয় জানতে পারলাম। আরও অনেক পর্যটক ছিল সেখানে। মানুষের আগ্রহ আছে কবির বিষয়ে তা বোঝা গেল। প্রতিটি স্মৃতিচিহ্ন দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এত সুন্দর বাড়ি, জমিদারী ও আরাম আয়েশ  ছেড়ে তিনি কেন ফ্রান্স এর ভার্সাই নগরীতে গেলেন। গত বছর আমি ফ্রান্সের ভার্সাই ঘুরে এলাম। এবার যশোরের সাগরদাঁড়িতে কবির বাড়ি ঘুরলাম। কী কাকতালীয়!

কপোতক্ষ নদ ছেড়ে দূরে গেলেও কবি যশোরের এ অবারিত সৌন্দর্য ভুলতে পারেনি। স্মৃতিকাতর দেশপ্রেমিক প্রকৃতি প্রেমিক কবির মেধাবী  ও সৃষ্টিশীল মনন জেগে উঠেছিল। তাই আমরা পেয়ে গেলাম একজন বড় কবি। পরিবর্তন বা কষ্ট মানুষকে বদলে দেয়, ব্যাটে বলে ম্যাচ করে বিস্ফোরিত হলে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।

সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথমা পত্নী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণমহাভারতপুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়েছেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।

জীবনঘনিষ্ঠ উপকরণ নিয়েই একজন কবির অন্তর্গূঢ় সত্তাটি গড়ে ওঠে। সমকালীন সমাজ, জীবন, পরিবেশ সৃষ্টিশীল মনকে বার বার আন্দোলিত করে। যশোরের গ্রামীণ জীবন, কপোতাক্ষ নদ, কলকাতার আলো হাওয়া, জমিদারী প্রথা, সনাতন ধর্মীয় সংস্কৃতি, বিদ্বান ইমামের কাছে কিতাব পড়া ইত্যাকার বহুমাত্রিক শিক্ষণের মাধ্যমে মধুসূদনের মনন ও মগজ গড়ে ওঠে। ফলে রেনেসাঁ যখন মানুষকে ধর্মীয় কুসংস্কার, জড়তা ও নানামুখী অন্ধকার প্রবণতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে নতুন কিছু ভাবতে শেখায়, তখন সমাজসংশ্লিষ্ট সব প্রপঞ্চেই তা বাঙময় হয়ে ওঠার প্রেরণা পায়। মধুসূদন দত্ত এই রেনেসাঁসের কবিপুরুষ। যিনি তাঁর যুগকে আপন প্রতিভার বলে, নিজের মতো করেই চালনা করেছেন।

কবি ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানের আবহাওয়া এবং বর্ণবাদিতার কারণে বেশি দিন ইংল্যান্ডে থাকেন নি। তারপর তিনি ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ।

মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার অল্পকাল পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন।

06.02.2021

………………..

যশোরের কেশবপুর থেকে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে যাবো। দেশের সর্ববৃহত ফুল চাষের অঞ্চল দেখতে। কেশবপুরের কপোতাক্ষ নদীর পাশ দিয়ে যাওয়া সড়ক ধরে চলছে আমার গাড়ি। দুপাশের জমি, চাষাবাদ প্রকল্প, মাছের খামার, জমির মাঝে তাল ও নারকেলের সারি, সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে আমার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ডুবে যাওয়ার আগে লাল সূর্য তার আলো ফেলছে সারিবদ্ধ ইরির চিকচিকে জলে। এভাবে চলতে চলতে যশোর অঞ্চলের গ্রামীন জীবন, ঘরবাড়ি, মানুষের চলাফেরা ইত্যাদি দেখতে দেখতে পোঁছে গেলাম ফুলের অভয়ারণ্য গদহালীতে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ভালো করে দেখতে পারিনি।

গদখালীতে ফুল চাষ শুরু হয়েছিলো কিভাবে? আশির দশক থেকে তথা চার দশক আগে শের আলী সর্দারের হাত ধরে এখানে শুরু হয় ফুলের চাষ আর এলাকার ক্ষেতখামার থেকে বিদায় নিতে শুরু করে ধান পাট বা এ ধরণের প্রচলিত শস্য। এই ধরণের ফুল পশ্চিমবঙ্গে অনেক হয়। পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মাটি তো এক-  এ ভাবনা থেকেই। তখনই শুরু করলো কৃষকরা ফুল চাষ। অনেক ধরণের ফুলের চাষ হয়, তবে বিশেষ করে গোলাপ, গাঁদা আর অর্কিড, পাতাবাহার, রজনীগন্ধার বাগান রয়েছে অসংখ্য। এর বাইরেও চোখে পরে পলি হাউজ বা ফুল চাষের বিশেষ ঘর।

ভারত ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চাষিদের আনা হচ্ছে স্থানীয় কৃষকদের সহায়তার জন্য বিশেষ করে পলি হাউজগুলো তৈরিতে সহায়তার জন্য।  আবার বিএডিসি যে গবেষণা করে সেখানেও তারা সহায়তা করেন। ফুল চাষে কৃষকদের লাভ হচ্ছে আবার জাতীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা থাকছে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই ফুল চাষ এবং নিত্য নতুন ফুলের জাত নিয়ে সরকারী বেসরকারি গবেষণাও শুরু হয়েছে।আর এতসব উদ্যোগের কারণেই অন্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষেই চার পাঁচ গুন বেশি লাভবান হচ্ছে কৃষকরা।

ফলে গদখালীর ফুলের সুবাসও ছড়িয়ে পড়ছে দেশ দেশান্তরে।

সারিবদ্ধভাবে দোকানে দোকানে অনেক ফুল। সাজিয়ে রাখা হয়েছে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুলে নিলো আমার মা, মেয়ে ও বউ।

ফুলেরা ফুলের মাঝেই সুন্দর- ইহা আবারও প্রমাণিত হলো।

……………………………

রাতে ব্যাডমিন্টন খেললাম যশোর সার্কিট হাউজে। যশোর জেলার অফিসাররা খেলছিল। আমি ও আমার ছেলে স্পন্দন জয়েন করেছি । ভালো সময় কাটলো। পরের দিন নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লাম। সকালের মিষ্টি আলোয় যশোর কালেক্টরেট ভবন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী সুন্দর! প্রাচীন স্থাপনা, নয়নাভিরাম দৃশ্য আর সামনে ফুলে ফুলে হলুদে ছেয়ে আছে পুরো প্রশ্বস্ত আঙিনা। আনন্দে আত্মহারা হয়েই প্রবেশ করলাম বাগানে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে যশোর কালেক্টরেটের নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। যশোর কালেক্টরেট স্থাপিত হয় ১৭৮৬ সালে। ১৭৮১ সালে জেলা ঘোষনার পর প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন Mr. Tilman Henckell (1781-1789) জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কালেক্টরেটের দায়িত্ব পান। যশোর কালেক্টরেট নিজস্ব ভবন তৈরী হয় ১৮০১ সালে। কালেক্টরেট ভবনটি দড়াটানা, যশোর এ অবস্থিত। এটি শহরের প্রাচীনতম স্থাপনারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি। এই ভবনের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ২০০ বছরের ইতিকথা। ভবনটি বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। বর্তমান ভবনের একতলা স্থাপিত হয় ১৮৮৫ সালে এবং দোতলা নির্মিত হয় ১৯৮২ সালে। গবেষকরা রেকর্ড রুমে পেতে পারেন সিপাহী বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহের নথি ও নজির তূল্য মামলা।

……………..

মেহেরপুর যাবো যশোর থেকে। পথে ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা। গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ করে। রাস্তা ফাঁকা। রাস্তার মান ভালো। চওড়া ও মসৃণ। কুমিল্লা সিলেট রোডের মতো গাড়ির ভীড় নেই। সিএনজি একেবারেই নেই মনে হলো। গাড়িঘোড়া কম। তবে মাঝে ছাগল হাঁটে রাস্তায়। ফাঁকা রাস্তা পেলে ছাগল একটু হাঁটতেই পারে। নামই তো ছাগল, কামতো ছাগলের মতোই হবে। তাই মাঝে মাঝে ড্রাইভার ছাগলের সম্মানে গাড়ি ধীর গতির করে।

পথে ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার ডিসি অফিসে একটু থামি, রিফ্রেশড হই। আবার চলি। কখনো আম বাগান পার হই, কখনো তিল-মশুর-কলাইয়ের প্রান্তর পার হই, কখনো সূর্যমুখীর বাগানে নেমে হাঁটি। এসব করতে করতেই পথ আগাচ্ছে। এত ব্যতিব্যস্ত চলার মাঝে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন আসে। এক আত্মীয় ফোন করে। বাড়ি তাঁর চুয়াডাঙ্গা হলেও আত্মায় আত্মায় মিলে যে আত্মীয় হয় সে আত্মীয় এখন থাকে অস্ট্রেলিয়া। একসময একসাথে থাকতাম ব্রিসবেনে। চলন্ত গাড়ির চুয়াডাাঙ্গা ক্রস করে। সেখানে এক ব্রিজের মাঝে গাড়ি দাঁড়ায় কারো হাত নাড়ানো দেখে। কলসী ভর্তি খেঁজুড় গুড়, কলা, বড়ই, মাসকলাইর বড়া আর কত কিছু দিয়ে গাড়ির পেছনে ভরে যায়। আমার মাথায় আসেনা যে, অস্ট্রেলিয়া থেকে কীভাবে স্বপন ভাই এত কিছু পাঠিয়ে দিল নিজের বাড়ি থেকে । তাঁর ছোট ভাইকে দিয়ে। মূল রাস্তা থেকে ১০ কিলো দূরে যে বাড়ি সেখান থেকে মটর সাইকেলে করে নিয়ে এসেছে এত কিছু! স্বপন ভাইয়ের ভালোবাসায় কাতর হয়েছি আর এত কিছু পাঠানোর কারিশমা দেখে তব্দা হয়ে গাড়িতে বসে আছি। সদ্য গাছ থেকে পাড়া বড়ই খেতে খেতে আয়েশ করে গাড়িতে চলছি।

…………….

আমঝুঁপি নীলকুঠি, মেহেরপুর সম্পর্কে আগে কিছু জানতাম না। দেখতে নেমে গেলাম। সবকিছু দেখে ও জেনে অবাক হয়েছি।

বাংলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দী খাঁর  মৃগয়ার স্মৃতি রয়েছে এখানে। পলাশীর পরাজয়ের নীল-নকশাও রচিত হয়েছিল এখানে এই আমঝুপিতে। জনশ্রুতি রয়েছে যে এখানেই রবার্ট ক্লাইভের সাথে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল।  যার ফলে নবাব সিরাজদ্দৌল্লাহ পরাজিত হন, আর বাংলার সূর্য অস্তমিত হয় ২০০ বছরের তরে।

প্যারী সুন্দরী ছিল বিদ্রোহের অবিস্মরণীয় চরিত্র। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার মিরপুর উপজেলার জমিদারের কনিষ্ঠ কন্যা।  আজীবন লড়েছেন মাটি ও মানুষের পক্ষে, দেশমাতৃকার স্বার্থে। নীলকরদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম কিংবদন্তিতুল্য।

এই নীলকুঠি ছিল অত্যাচারের আস্তানা। নির্যাতিত নীলচাষীদের আন্দোলনে বাংলার বুকে নিশ্চিহ্ন হয় নীল চাষ। ১৯৭৮ সালে এই আমঝুঁপিটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর হয়।

নিচে একটি ছবি দিলাম একটি কক্ষের। কক্ষটি এত মসৃণ যে কোনো সাপ বা পোকামাকড় ঢুকতে পারতো না। স্নেকপ্রুফ রুম!

…………..

মেহেরপুর জেলা শহরে প্রবেশ করেই জেলা প্রশাসক মনসুর স্যারকে ফোন করলাম। স্যার মধ্যাহ্ন ভোজনের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু আমরা মুজিবনগর দেখে কুষ্টিয়াতে ব্যাক করবো বলে সময়াভাবে স্যারের সাথে দেখা করতে পারিনি। ভোজনও হয়নি। (পাওনা থাকলো, স্যার ঢাকায় এলে উশুল করে নিবো)। দ্রুতই চলে গেলাম মুজিবনগরে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। সেই আমের বাগানে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন সরকার  উপস্থিত থেকে আমাদের সময় দিয়েছেন, ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

-ড. সফিকুল ইসলাম।

(লেখাটি ভালো লাগলে নিচে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। কিংবা ইমেইল করতে পারেন অনুভূতি জানিয়ে Shafiq.bcs@gmail.com। শেয়ার করতে পারেন ফেসবুকে বা লিংকডইনে। )

Share Now
Author

Dr. Shafiqul Islam

(BBA, MBA, DU; Mphil, Japan; PhD, Australia) Deputy Secretary, Government of Bangladesh. Chief Executive Officer, Cumilla City Corporation, Local Government Division, Ministry of LGRD
error: Content is protected !!

My Shopping Cart